১৯১তম অধ্যায়
‘অশ্বত্থামা হত’ বলাইতে কৃষ্ণের প্ররোচনা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ। পূর্ব্বকালে দেবরাজ রোষাবিষ্ট হইয়া যেমন সংগ্রামে দানবগণকে সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ দ্রোণাচার্য্য পাঞ্চালগণের প্রাণনাশ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবপক্ষীয় মহাবলপরাক্রান্ত মহারথগণ দ্রোণের অস্ত্রে নিপীড়িত হইয়া ভীত হইলেন না। মহারথ পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ নিঃশঙ্কচিত্তে দ্রোণের সম্মুখীন হইলেন এবং পরিশেষে দ্রোণের শর ও শক্তিদ্বারা সমাহত হইয়া চতুর্দ্দিকে ভীষণ নিনাদ করিতে লাগিলেন। এইরূপে পাঞ্চালগণ দ্রোণশরে নিপীড়িত ও আচার্য্যের অস্ত্রসমুদয়ে ভীষণরূপে চতুর্দ্দিক সমাকীর্ণ হইলে পাণ্ডবেরা অশ্ব ও যোধবর্গের নিধনদর্শনে ভয়ে নিতান্ত অভিভূত হইয়া জয়াশা পরিত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন, বসন্তসময়ে সমৃদ্ধ হুতাশন যেমন বন দগ্ধ করে, তদ্রূপ পরমাস্ত্রবিৎ দ্রোণাচার্য্য আমাদিগকে বিনষ্ট করিবেন। সংগ্রামে উহার প্রতিদ্বন্দ্বী হইতে কেহই সমর্থ নহেন। ধর্ম্মপরায়ণ অর্জ্জুন কখনই উহার প্রতিদ্বন্দ্বী হইবেন না।
“হে মহারাজ! ঐ সময় পাণ্ডবহিতৈষী ধীমান্ বাসুদেব কুন্তীপুত্রদিগকে দ্রোণশরে নিপীড়িত ও নিতান্ত ভীত দেখিয়া অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য দ্রোণাচাৰ্য্য সংগ্রামে শরাসন ধারণ করিলে ইন্দ্রাদি দেবগণও তাঁহাকে নিহত করিতে সমর্থ নহেন; কিন্তু উনি অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করিলে মনুষ্যেরাও উঁহাকে বিনাশ করিতে পারে। অতএব তোমরা ধর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক কৌশল করিয়া উঁহাকে পরাজয় করিবার চেষ্টা কর; নচেৎ আচার্য্য তোমাদের সকলকেই বিনাশ করিবেন। আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, অশ্বত্থামা নিহত হইয়াছেন, ইহা জানিতে পারিলে দ্রোণ আর যুদ্ধ করিবেন না; এতএব কোন ব্যক্তি তাঁহার নিকট গমনপূর্ব্বক বলুন যে,—অশ্বত্থামা সংগ্রামে বিনষ্ট হইয়াছেন।’
পার্থের উপেক্ষা—যুধিষ্ঠিরাদির অঙ্গীকার
“হে মহারাজ! কুন্তীপুত্র অর্জ্জুন কৃষ্ণের বাক্যশ্রবণে তাহাতে কোনক্রমেই সম্মত হইলেন না; অন্যান্য যোধগণ সম্মত হইলেন এবং ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির অতিকষ্টে উহা অঙ্গীকার করিলেন। অনন্তর মহাবাহু ভীমসেন গদাঘাতে আত্মপক্ষীয় অবন্তীদেশীয় ইন্দ্রবর্ম্মার অরাতিঘাতন অশ্বত্থামানামক মহাগজকে নিপাতিত করিয়া সলজ্জভাবে দ্রোণসমীপে আগমনপূর্ব্বক অশ্বত্থামা নিহত হইয়াছেন বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিতে লাগিলেন। এইরূপে বৃকোদর ‘অশ্বত্থামা’ নামক গজ নিপাতিত করিয়া মিথ্যাবাক্য, প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিলে, দ্রোণাচার্য্য ভীমসেনের সেই দারুণ অপ্রিয় বাক্য শ্রবণ করিয়া প্রথমতঃ নিতান্ত বিষণ্নমনাঃ হইলেন। পরিশেষে স্বীয় পুত্রকে অমিতপরাক্রমশালী ও অরাতিকুলের অসহনীয় মনে করিয়া আশ্বাসযুক্ত হইয়া ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক আপনার মৃত্যুস্বরূপ ধৃষ্টদ্যুম্নের বিনাশবাসনায় তাঁহার অভিমুখে গমন করিয়া তাঁহার উপর সুতীক্ষ্ণ কঙ্কপত্রভূষিত সহস্র শর নিক্ষেপ করিলেন। তখন পাঞ্চালদেশীয় বিংশতিসহস্র মহারথ সেই রণচারী দ্রোণাচার্য্যের উপর চতুর্দ্দিক হইতে শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। আচাৰ্য্য তাঁহাদের শরনিকরে পরিবৃত হইয়া বর্ষাকালীন জলধরসমাচ্ছন্ন দিবাকরের ন্যায় অদৃশ্য হইলেন। অনন্তর তিনি অবিলম্বে পাঞ্চালগণের শরজাল নিবারণপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে বিনাশার্থ ক্রোধভরে ব্রহ্মাস্ত্র প্রাদুর্ভূত করিয়া বিধূম প্রজ্বলিত হুতাশনের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি পুনরায় রোষাবিষ্ট হইয়া সোমকদিগকে বিনাশ এবং পাঞ্চালগণের মস্তক ও পরিঘাকার কনকভূষিত বাহুসমুদয় ছেদন করিতে আরম্ভ করিলেন। নরপতিগণ ভারদ্বাজকর্ত্তৃক নিহত হইয়া বায়ুভগ্ন বনস্পতির ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিলেন। নিপতিত হস্তী ও অশ্বগণের মাংস ও শোণিতে গাঢ় কম সমুৎপন্ন হওয়াতে সমরভূমি অগম্য হইয়া উঠিল। হে মহারাজ! দ্রোণাচাৰ্য্য এইরূপে পাঞ্চালদেশীয় বিংশতিসহস্র মহারথের প্রাণবিনাশ করিয়া ধূমবিরহিত প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় রণস্থলে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি পুনরায় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া একভল্লে বসুদানের শিরচ্ছেদনপূর্ব্বক পঞ্চাশৎ মৎস্য, সহস্র সৃঞ্জয়, অযুত হস্তী ও অশ্বের প্রাণবিনাশ করিলেন।
দ্রোণান্তর্দ্ধানে বিশ্বামিত্রাদির মন্ত্রণাপ্রয়োগ
“হে মহারাজ! ঐ সময় বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, বশিষ্ঠ, অত্রি, ভৃগু, অঙ্গিরা, সিকত, পৃশ্মি, গর্গ, বালখিল্য, মরাচিপ ও অন্যান্য ক্ষুদ্রতর সাগ্নিক ঋষিগণ আচার্য্যকে নিঃক্ষত্রিয় করিতে অবলোকন করিয়া তাঁহাকে ব্রহ্মলোকে নীত করিবার বাসনায় সকলে শীঘ্র সমাগত হইয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে দ্রোণ! তুমি অধর্ম্মযুদ্ধ করিতেছ; অতএব এক্ষণে তোমার বিনাশসময় উপস্থিত হইয়াছে। তুমি আয়ুধ পরিত্যাগ করিয়া একবার আমাদিগকে নিরীক্ষণ কর। আর তোমার এরূপ ক্রূরকার্য্যের অনুষ্ঠান করা কৰ্ত্তব্য নহে। তুমি বেদবেদাঙ্গবেত্তা ও সত্যধর্ম্মপরায়ণ, বিশেষতঃ ব্রাহ্মণ; অতএব এরূপ কাৰ্য্য করা তোমার নিতান্ত অনুচিত; তুমি অবিমুগ্ধ হইয়া আয়ুধ পরিত্যাগপূর্ব্বক শাশ্বতপথে অবস্থান কর। অদ্য তোমার মর্ত্যলোক নিবাসের কাল পরিপূর্ণ হইয়াছে। হে বিপ্র! অস্ত্রানভিজ্ঞ ব্যক্তিদিগকে ব্রহ্মাস্ত্রে বিনাশ করিয়া নিতান্ত অসৎকার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছ; অতএব আয়ুধ অবিলম্বে পরিত্যাগ কর; আর ক্রুরকার্য্যের অনুষ্ঠান করা তোমার কর্ত্তব্য নহে।’
যুধিষ্ঠিরসমীপে দ্রোণের পুত্রনিধনপ্রশ্ন
“হে মহারাজ! মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য ইতিপূর্ব্বে ভীমসেনের মুখে অশ্বত্থামা নিহত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া নিতান্ত বিষয় হইয়াছিলেন, এক্ষণে ঋষিদিগের এই বাক্য শ্রবণ ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে অবলোকন করিয়া অধিকতর বিমনায়মান হইলেন। তখন তিনি একান্ত ব্যথিতহৃদয়ে যুধিষ্ঠিরকে স্বীয় পুত্র বিনষ্ট হইয়াছে কি না জিজ্ঞাসা করিলেন। হে মহারাজ! আচার্য্য যুধিষ্ঠিরকে বাল্যকালাবধি সত্যবাদী বলিয়া জানিতেন। তাঁহার নিশ্চয় জ্ঞান ছিল যে, যুধিষ্ঠির ত্রিলোকের ঐশ্বর্য্যলাভ হইলেও কদাচ মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করেন না। তন্নিমিত্তই অন্য কাহাকেও জিজ্ঞাসা না করিয়া যুধিষ্ঠিরকেই জিজ্ঞাসা করিলেন।
“অনন্তর হৃষীকেশ ‘দ্রোণাচাৰ্য্য জীবিত থাকিলে পৃথিবী পাণ্ডবশূন্য করিবেন’ স্থির করিয়া দুঃখিতচিত্তে ধর্ম্মরাজকে কহিলেন, ‘হে রাজন্! যদি দ্রোণাচাৰ্য্য রোষপরবশ হইয়া আর অর্দ্ধদিন যুদ্ধ করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আপনার সমস্ত সৈন্য বিনষ্ট হইবে। আপনি মিথ্যাকথা কহিয়া আমাদিগকে পরিত্রাণ করুন। এরূপ স্থলে মিথ্যাবাক্যপ্রয়োগ সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর হইতেছে। প্রাণরক্ষাৰ্থ মিথ্যা কহিলে পাপস্পৃষ্ট হইতে হয় না। কামিনীদিগের নিকট, বিবাহস্থলে এবং গো-ব্রাহ্মণের রক্ষাৰ্থ মিথ্যা কহিলেও পাতক নাই।’
যুধিষ্ঠিরের সকৌশল মিথ্যা উক্তি
“হে কুরুরাজ! ঐ সময়ে ভীমসেন যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, ‘হে মহারাজ! আমি দ্রোণাচার্য্যের বধোপায় শ্রবণ করিয়া আপনার সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট অবন্তীনাথ ইন্দ্ৰবর্ম্মার ঐরাবতসদৃশ ‘অশ্বত্থামা’নামক হস্তী সংহারপূর্ব্বক আচাৰ্য্যকে কহিলাম, হে ব্ৰহ্মন্! অশ্বত্থামা বিনষ্ট হইয়াছে, আর কেন আপনি যুদ্ধ করিতেছেন? হে মহারাজ! ভারদ্বাজ তৎকালে আমার সেই বাক্যে অনাস্থা প্রদর্শন করিয়াছিলেন। এক্ষণে আপনি বিজয়াভিলাষী গোবিন্দের বাক্যানুসারে আচাৰ্য্যকে অশ্বত্থামার বিনাশবার্তা প্রদান করুন, তাহা হইলে তিনি কখনই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন না। আপনি সত্যপরায়ণ বলিয়া ত্রিলোকমধ্যে বিখ্যাত আছেন। আচার্য্য আপনার বাক্য অবশ্যই বিশ্বাস করিবেন।
“হে কুরুরাজ! রাজা যুধিষ্ঠির ভীমসেনের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া ও কৃষ্ণকর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া অবশ্যম্ভাবী কার্য্যের অনুল্লঙ্ঘনীয়তাবশতঃ মিথ্যা বাক্যপ্রয়োগে উদ্যত হইলেন। তিনি জয়াভিলাষ ও মিথ্যাকথনভয়ে যুগপৎ আক্রান্ত হইয়া দ্রোণসমক্ষে ‘অশ্বত্থামা হত হইয়াছেন’ এই কথা স্পষ্টবিধানে বলিয়া অব্যক্তরূপে কুঞ্জরশব্দ [অশ্বত্থামা হতঃ ইতি গজঃ।’-যাহাকে বলে ‘হত গজঃ] উচ্চারণ করিলেন; হে মহারাজ! ইহার পূর্ব্বে যুধিষ্ঠিরের রথ পৃথিবী হইতে চারি অঙ্গুলি ঊর্ধে অবস্থান করিত, কিন্তু তৎকালে তিনি এইরূপ মিথ্যাবাক্য কহিলে তাঁহার বাহনগণ ধরাতল স্পর্শ করিল। তখন মহারথ দ্রোণাচাৰ্য্য যুধিষ্ঠিরের সেই বাক্যশ্রবণে পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া জীবিতাশা পরিত্যাগ করিলেন এবং ঋষিগণের সেই বাক্য স্মরণ করিয়া আপনাকে মহাত্মা পাণ্ডবগণের নিকট অপরাধী জ্ঞান ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে সম্মুখে নিরীক্ষণপূর্ব্বক বিচেতনয় হইয়া আর পূর্ব্ববৎ যুদ্ধ করিতে সমর্থ হইলেন না।”