১৯০. উভয়পক্ষে সঙ্কুল যুদ্ধ, কৃষ্ণের মধ্যস্থতায় যুদ্ধনিবৃত্তি
নবত্যধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, দ্বিজর্ষভসকল অজিন ও কমণ্ডলু বিধূননপূর্বক উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, তোমাদিগের ভয় নাই, আমরা শত্রুর সহিত যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত আছি। অর্জুন ঈষৎ হাস্য করিয়া তাঁহাদিগকে কহিলেন, আপনার পাশে থাকিয়া দর্শন করুন। যেমন মন্ত্রদ্বারা দশক আশীবিষ নিবারণ করে, তোপ আমিও সূচ্যগ্র বিশিখশতদ্বারা ইহাদিগের নিরাকরণ করিতেছি। এই কথা বলিয়া অর্জুন শুল্কলব্ধ শরাসন আকর্ষণ করিয়া ভীমের সহিত পৰ্ব্বতের ন্যায় দৃঢ়রূপে দণ্ডায়মান হইলেন। অনন্তর নির্ভীক ভীমার্জুন যুদ্ধদুর্মদ কর্ণপ্রমুখ ক্ষত্রিয়বর্গকে নিরীক্ষণ করিয়া দ্রুতবেগে তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিলেন। রণক্ষেত্রে দ্বিজাতিরও বিনাশ দৃষ্ট হইয়া থাকে, এই বলিয়া যুযুৎসু রাজারা দ্রুতবেগে ব্রাহ্মণগণের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং মহাতেজাঃ কর্ণ অর্জুনের প্রতি গমন করিলেন। হস্তী হস্তিনীর নিমিত্ত যুদ্ধাথী হইয়া মহাবেগে যেমন প্রতিপক্ষ গজের প্রতি ধাবমান হয়, সেইরূপ মদ্রেশ্বর শল্য ভীমকে আক্রমণ করিলেন। পরে দুৰ্য্যোধনাদি সকলে ব্রাহ্মণদিগের সহিত সঙ্গত হইয়া ধীরে ধীরে সমরসাগরে অবতীর্ণ হইলেন।
অনন্তর অর্জুন প্রকাণ্ড শরাসন আকর্ষণপূর্বক শত শত নিশিত শরদ্বারা কর্ণকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। রাধেয় সুতীক্ষ্ণ বিশিখশতপ্রহারে বিমোহিত হইয়া অতি কষ্টে অর্জুনের অনুধাবন করিলেন। জিগীষাপরবশ বীরযুগলের ঘোরর সংগ্রাম উপস্থিত হইল। পরস্পর পরস্পরকে বীরত্ব প্রদর্শন পূর্বক কহিতে লাগিলেন, তুমি যাহা করিয়াছ, তাহার প্রতিফল দিতেছি এবং এই মুহূর্তেই আমার বাহুবল প্রদর্শন করিতেছি। কর্ণ অর্জুনের অনুপম ভুজবীয় দর্শনে ক্ৰোধান্ধ হইয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তদীয় সেনাগণ অর্জনযুক্ত তীব্ৰজব বাণ বর্ষণ বিফল করিয়া উচ্চৈঃস্বরে স্বপ্রভুর জয়শব্দ উচ্চারণ করিতে লাগিল। কর্ণ কহিলেন, হে বিপ্রবর! তোমার ভুজবীৰ্য্য, অস্ত্রশিক্ষা ও অক্লিষ্টতা দর্শনে আমি পরম প্রীত হইলাম। হে দ্বিজসত্তম! আমার বোধ হইতেছে, তুমি মুর্তিমান্ ধনুর্বেদ অথবা রাম, সূৰ্য্য বা সাক্ষাৎ ভগবান বিষ্ণু হইবেক। আত্মপ্রচছাদনের নিমিত্ত বিরূপ ধারণপূর্বক আমার সহিত যুদ্ধ করিতেছ। আমি ক্রুদ্ধ হইলে সাক্ষাৎ ইন্দ্র বা পাতনয় কিরীটী ব্যতিরেকে অন্য কেহই আমার সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হয় না।
অর্জুন প্রত্যুত্তর করিলেন, হে কর্ণ! আমি ধনুৰ্বেদ নহি বা প্রতাপশালী রামও নহি; আমি ব্রাহ্মণ, গুরুর উপদেশে ব্রাহ্ম ও পৌরবৃন্দর অস্ত্রে সুশিক্ষিত হইয়াছি। অদ্য তোমাকে পরাজয় করিবার নিমিত্ত রণক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়াছি। রাধেয় এই কথা শ্রবণ করিয়া অর্জুনের দুর্জয় ব্রাহ্মতেজ স্বীকার পূর্বক তৎক্ষণাৎ যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হইলেন। অপর রণপ্রদেশে বলবিদ্যাসম্পন্ন যুদ্ধবিশারদ মত্ত গজেন্দ্রাকার শল্য ও বৃকোদর পরস্পর সমানপূর্বক মুষ্ট্যাঘাত ও জাহান্নদ্বারা ঘোরর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। তাঁহারা উভয়ে প্রচণ্ডবেগে উভয়কে আকর্ষণ ও পাষাণপাতসদৃশ, মুষ্ট্যাঘাত করিতে লাগিলেন। প্রহারবেগে রণস্থলে ঘোরতর চটচটা শব্দ উঠিল। তাহারা দুইজনে ক্ষণকাল তুমুল সংগ্রাম করিলেন। পরে কুরুশ্রেষ্ঠ ভীম বাহুদ্বারা শল্যকে উৎক্ষিপ্ত ও ভূতলে পাতিত করিলেন, তদ্দর্শনে দ্বিজাতিমণ্ডল হাস্য করিতে লাগিলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য! ভীমসেন শল্যকে ভূতলশায়ী করিয়াও তাঁহার প্রাণ বিনাশ করিলেন না। শল্য নিপতিত ও কর্ণ শঙ্কিত হইলে পর সমস্ত রাজগণ অত্যন্ত ভীত হইয়া বৃকোদরকে পরিবেষ্টন করিলেন এবং সকলে একবাক্যে ভীমার্জুনকে সাধুবাদ করিয়া কহিলেন, এই ব্রাহ্মণকুমারের। কাহার পুত্র, ইহাদিগের বাস কোথায়, তৎসমুদায় পরিজ্ঞাত হওয়া উচিত। মহাবল পরশুরাম, দ্রোণ ও পাণ্ডুতনয় কিরীটী ব্যতিরেকে কর্ণের সহিত যুদ্ধ করে, এমন লোক ভূলোকে কে আছে? দেবকীসুত কৃষ্ণ এবং কৃপাচাৰ্য ব্যতিরেকে পৃথিবীতে এমন ব্যক্তি লক্ষ্য হয় না যে, দুর্যোধনের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হয়। বলদেব, পাণ্ডব, বৃকোদর ও মহাবল পরাক্রান্ত দুৰ্য্যোধন ভিন্ন অন্য কোন্ বীর মন্ত্ৰাধিপতি শল্যকে সমরশায়ী করিতে পারে? ব্রাহ্মণেরা অপরাধী হইলেও তাঁহাদিগকে ক্ষমা করা উচিত, অতএব ব্রাহ্মণের সহিত আর যুদ্ধে প্রয়োজন নাই। তবে যদি উহারা পুনর্বার যুদ্ধার্থী হয়েন, তাহা হইলে আমরা হৃষ্টচিত্তে যুদ্ধ করিব, সন্দেহ নাই। কৃষ্ণ ক্ষিতীশ্বরদিগের একার কথোপকথন শ্রবণ এবং ভীমের সেই অদ্ভুত পরাক্রম সন্দর্শন করি তাঁহাদিগকে কুন্তীসূত স্থিরনিশ্চয় করিলেন। পরে রাজগণকে সম্বোধনপূর্বক বিনয়ষচনে কহিলেন, হে ভুপালবৃন্দ! ইহারাই রাজকুমারীকে ধর্মতঃ লাভ করিয়াছেন, তোমরা ক্ষান্ত হও, আর যুদ্ধে প্রয়োজন নাই।
বিস্ময়াবিষ্ট রাজর্ষিগণ কৃষ্ণের অনুনয়ে সংগ্রামে বিরত হইয়া স্ব স্ব গৃহে প্রস্থান করিলেন। অদ্য রঙ্গস্থলে ব্রাহ্মণ জয়ী হইয়াছেন এবং পাঞ্চালী ব্রাহ্মণকর্তৃক বিবাহিতা হইলেন এই কথা বলিতে ৰুলিতে সমাগত জনসমূহ প্রস্থান করিল। রৌরবাজিনধারী ভীম ও অর্জুন বিমধ্যে প্রচ্ছন্ন হইয়া অতি সাবধানে গমন করিলেন। তাহারা শক্ৰহস্ত হইতে বিমুক্ত হইয়া এবং দ্রৌপদীকে লাভ করিয়া মেঘাবরণনিৰ্ম্মক্ত পূর্ণিমাশশধরের ন্যায় ও প্রদীপ্ত সূৰ্য্যদেবের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। এদিকে পুত্রবৎসলা পৃথ পুরো ভিক্ষার্থে গমন করিয়া কি নিমিত্ত অধুনাপি প্রত্যাগত হইল না ভাবিয়া, কতই অনিষ্টশঙ্কা করিতে লাগিলেন। তিনি মনে মনে চিন্তা করিলেন, হয় ত দুরাত্মা ধার্তরাষ্ট্রেরা তাহাদিগকে নিহত করিয়াছে, অথবা নিদারুণ শত্রু মায়াবী নিশাচরগণ হইতে কোনরূপ অনিষ্টপাত হইয়া থাকিবে, তাহাদিগের দুর্ভেদ্য মায়াজালে মহাত্মা ব্যাসদেবের মতেরও বৈপরীত্য জমিয়া থাকে। পৃথা পুত্রস্নেহে আবৃত হইয়া এবম্প্রকার চিন্তা করিতেছেন, আকাশমণ্ডল ঘনাবলাতে আচ্ছাদিত এবং সমস্ত লোক সুষুপ্তপ্রায় হইয়াছে, এমন সময়ে অর্জুন মেঘোপরুদ্ধ অপরাহুদিবাকরের ন্যায় ব্রাহ্মণগণে পরিবৃত হইয়া ভাগবালয়ে প্রবেশ করিলেন।