জরাসন্ধের রাজ্যাভিষেক
শ্ৰীকৃষ্ণ কহিলেন, “হে রাজন! কিয়ৎকাল পরে ভগবান চণ্ডকৌশিক মগধদেশে পুনর্ব্বার আগমন করিলেন। মহারাজ বৃহদ্ৰথ তাহার আগমনে যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইয়া অমাত্য, ভৃত্যবর্গ, ভাৰ্য্যাদ্বয় ও পুত্রসমভিব্যাহারে তাঁহার সমীপে গমনপূর্ব্বক পাদ্য, অর্ঘ্য ও আচমনীয় দ্বারা তাঁহাকে পূজা করিলেন এবং পুত্র ও রাজ্য তৎসমীপে নিবেদন করিলেন। মহর্ষি মহারাজের পূজাগ্রহণান্তর হৃষ্টচিত্তে তাঁহাকে কহিলেন, ‘রাজন্! আমি দিব্যচক্ষু দ্বারা এই সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইয়াছি, এক্ষণে তোমার এই পুত্র যেরূপ সৌভাগ্যশালী হইবে, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ করা। তোমার এই কুমার রূপবান, সত্ত্বশালী, বলবিক্রমসম্পন্ন ও অতুল ঐশ্বৰ্য্যাধিকারী হইবে, সন্দেহ নাই। যেমন অন্যান্য পক্ষিগণ উড্ডীন বিহঙ্গমরাজ গরুড়ের অনুগমন করিতে পারে না, সেইরূপ কোন ভূপতিই এই কুমারের তুল্য বলশালী হইতে পরিবে না। যে ব্যক্তি ইহার শত্রু হইবে, তাহার অবশ্যই মৃত্যু হইবে। যেমন নদী-তরঙ্গে পর্ব্বতের কিছুই অপকার হয় না, সেইরূপ দেবগণের অস্ত্রাঘাতেও ইহার কিছুমাত্র ব্যথা হইবে না। এ সমস্ত ক্ষত্ৰিয় অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইবে। যেমন সূৰ্য্য অন্যান্য জ্যোতিঃপদার্থগণের প্রভা হ্রাস করেন, সেইরূপ কুমার সকলের তেজ বিনষ্টপ্ৰায় করিবে। যেমন পতঙ্গ সকল অগ্নিতে বিনষ্ট হয়, সেইরূপ ধনবাহনসম্পন্ন সমৃদ্ধ ভূপতিগণ যুদ্ধে ইহার হস্তে প্ৰাণত্যাগ করিবেন। যেমন বর্ষাকালে সমুদ্র অগাধ জলসম্পন্না নদীসকলকে গ্রহণ করে, সেইরূপ ও সমুদয় ভূপতিগণের ঐশ্বৰ্য্য গ্রহণ করবে। যেমন সর্ব্বশস্যধরা বসুন্ধরা কি মহৎ, কি নীচ সকলকেই ধারণ করেন, সেইরূপ এ চারিবর্ণ পালন করিবে। প্রাণীগণ যেমন সমস্ত জগতের আত্মভূত বায়ুর বশীভুত, সেইরূপ ইহারও বশীভূত হইবে। এই কুমার ত্রিপুরান্তকারী দেবাদিদেব মহাদেবকে সাক্ষাৎ দেখিবে।” ভগবান চণ্ডকৌশিক মহারাজ বৃহদ্রথকে এই কথা বলিয়া স্বীয় কর্তব্য কাৰ্য্যের অনুরোধে তাঁহাকে বিদায় দিলেন।
মগধাধিপতি-নগরে প্রবেশপূর্ব্বক জ্ঞাতিবান্ধব সমভিব্যাহারে জরাসন্ধকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া যৎপরোনাস্তি পরিতুষ্ট হইলেন এবং তাহার হস্তে সমস্ত রাজ্যভার সমর্পণপূর্ব্বক পত্নীদ্বয়— সমভিব্যাহারে তপোবনে প্ৰস্থান করিলেন। তাহারা তপোবনে গমন করিলে জরাসন্ধ স্বীয় ভুজবীৰ্য্যপ্রভাবে ভূপতিগণকে বশীভূত করিলেন।”
জরাসন্ধের রাজ্যশাসন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, নরপতি বৃহদ্ৰথ ভাৰ্য্যাদ্বয় সমভিব্যাহারে তপোবনে বহুদিবস তপানুষ্ঠান করিয়া স্বৰ্গে গমন করিলেন। তাঁহার পুত্র জরাসন্ধও চণ্ডকৌশিকোক্ত সমুদয় বার লাভ করিয়া নিষ্কণ্টকে রাজ্য শাসন করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে ভগবান বাসুদেব কংস নরপতিকে সংহার করেন। কংসনিপাতন নিবন্ধন কৃষ্ণের সহিত জরাসন্ধের ঘোরতর শক্ৰতা জন্মিল। মহাবল পরাক্রান্ত জরাসন্ধ গিরি শ্রেণীমধ্যে থাকিয়া কৃষ্ণের বিধার্থে এক বৃহৎ গদা একোনশতবার ঘূর্ণায়মান করিয়া নিক্ষেপ করিল। গদা মথুরাস্থিত অদ্ভুতকর্ম্ম বাসুদেবের একোনশত যোজন অন্তরে পতিত হইল। পৌরগণ কৃষ্ণসমীপে গদাপতনের বিষয় নিবেদন করিল। তদবধি সেই মথুরার সমীপবর্তী স্থান “গদাবসান” নামে বিখ্যাত হইল। হংস ও ডিম্ভক নামে দুই মহাবল-পরাক্রান্ত বীরপুরুষ জরাসন্ধের সহায় ছিল। উহারা নীতিশাস্ত্রে পারদর্শী, মন্ত্রণাপ্রদানে সুনিপুণ, বুদ্ধিমান ও শস্ত্রাঘাতে অবধ্য ছিল। আমি ইতিপূর্ব্বেই কহিয়াছি, উহারা দুইজন এবং জরাসন্ধ এই তিন একত্ৰ হইলে ত্ৰিভুবন জয় করিতে পারে। হে মহারাজ! এইরূপে কুকুর, অন্ধক ও বৃষ্ণিগণ ‘দুর্ব্বল ব্যক্তি বলবানের সহিত স্পৰ্দ্ধা করিবে না।’ এই নীতিবাক্যের অনুসরণক্ৰমে মহাবীর জরাসন্ধকে তৎকালে উপেক্ষা করিয়াছিলেন।
রাজসূয়ারম্ভ-পর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।