১৮৯তম অধ্যায়
সহদেবদুঃশাসন ও কর্ণভীমযুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এদিকে মহাবীর দুঃশাসন রোষাবিষ্ট হইয়া রথবেগে ভূমণ্ডল বিকম্পিত করিয়া সহদেবের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর সহদেব তাঁহাকে আগমন করিতে দেখিয়া ভল্লাস্ত্রদ্বারা তাঁহার সারথির শিরস্ত্রাণসমলঙ্কৃত মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তিনি এত শীঘ্র উহার শিরচ্ছেদন করিলেন যে, দুঃশাসন ও অন্যান্য সৈনিকপুরুষেরা উহার কিছুমাত্র অবগত হইতে পারিলেন না। তখন দুঃশাসনের অশ্বগণ যন্ত্রবিহীন হইয়া স্বেচ্ছানুসারে ইতস্ততঃ গমন করিতে লাগিল। মহাবীর দুঃশাসন তদ্দর্শনে সারথি নিহত হইয়াছে অবগত হইয়া নির্ভয়ে স্বয়ং অশ্মরশ্মি গ্রহণ ও লঘুহস্ততা প্রদর্শনপূর্ব্বক যুদ্ধ করিতে আরম্ভ। করিলেন। তখন কি বিপক্ষ, কি স্বপক্ষ, সকলেই তাঁহার সেই অদ্ভুত কার্য্য অবলোকন করিয়া ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিল। মহাবীর সহদেব তদ্দর্শনে ক্রোধভরে দুঃশাসনের অশ্বগণের উপর সুতীক্ষ্ণ শরনিকর নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। অশ্বগণ মাদ্ৰীতনয়ের শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া অবিলম্বে ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। তখন দুঃশাসন একবার অশ্বরশ্মি গ্রহণ ও শরাসন পরিত্যাগ এবং একবার কার্মুক গ্রহণ ও অশ্বরশ্মি পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। মহাবীর সহদেব এই সুযোগে তাঁহাকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন।
“অনন্তর মহাবীর কর্ণ দুঃশাসনের সাহায্যার্থ তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর তদ্দর্শনে পরমযত্নসহকারে আকর্ণপূর্ণ তিনভল্লে কর্ণের বাহু ও বক্ষঃস্থল আহত করিলেন। তখন সূতপুত্র দণ্ডঘট্টিত ভুজঙ্গের ন্যায় প্রতিনিবৃত্ত হইয়া নিশিত শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক ভীমসেনকে নিবারণ করিতে লাগিলেন; এইরূপে কর্ণ ও ভীমসেনের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। তাঁহারা নেত্র বিঘূর্ণনপূর্ব্বক বৃষভদ্বয়ের ন্যায় ঘোরতর নিনাদ পরিত্যাগ করিয়া ক্রোধভরে মহাবেগে পরস্পরকে শরবিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তৎকালে ঐ দুই মহাবীর পরস্পর অতিশয় সন্নিকৃষ্ট ছিলেন, সুতরাং শরপ্রয়োগবিষয়ে নিতান্ত অসুবিধা উপস্থিত হওয়াতে তাঁহারা তৎক্ষণাৎ গদাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। মহাবীর ভীম গদাঘাতে কর্ণের রথকূবর চুর্ণ করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইল। তখন মহারথ কর্ণ ভীমের রথাভিমুখে গদা নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহার গদা চুর্ণ করিলেন। অনন্তর ভীমসেন পুনরায় কর্ণের প্রতি এক গুব্বা গদা নিক্ষেপ করিলে মহাবীর কর্ণ মহাবেগসম্পন্ন সুপুঙ্খ বহুসংখ্যক সায়কদ্বারা উহা বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন সেই ভীমনিক্ষিপ্ত ভীষণ গদা কর্ণের শরপ্রভাবে মন্ত্রাভিহত ভূজঙ্গীর ন্যায় প্রতিনিবৃত্ত হইয়া ভীমসেনের বিপুল ধ্বজে নিপতিত হইয়া সারথিকে বিমোহিত। করিল। পরে বিপুলবিক্রম ভীমসেন ক্রোধমূর্হিত হইয়া কর্ণের প্রতি আটবাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক অম্লানমুখে তাঁহার শরাসন, তূণীর ও ধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন; মহাবীর কর্ণও সত্বর অন্য এক সুবর্ণপৃষ্ঠ দুরাসদ শরাসন ধারণপূর্ব্বক শরনিকরদ্বারা বৃকোদরের অসমুদয় ও পার্ষ্ণিসারথিদ্বয়কে সংহার করিলেন। তখন অরাতিনিসূদন ভীমসেন স্বীয় রথ পরিত্যাগপূর্ব্বক সিংহ যেমন পর্ব্বতশৃঙ্গে আরোহণ করে, তদ্রূপ নকুলের রথে সমারূঢ় হইলেন।
অর্জ্জুনদ্রোণাচার্য্যযুদ্ধে প্রশংসাবাদ
“হে মহারাজ! ঐ সময় মহারথ দ্রোণাচাৰ্য্য ও তাঁহার শিষ্য অর্জ্জুন উভয়ে লঘুসন্ধান ও রথের বিচিত্র গতিদ্বারা মানবগণের নয়ন ও মন বিমোহিত করিয়া বিচিত্র যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন; অন্যান্য যোধগণ সেই গুরুশিষ্যের অদ্ভুত সংগ্রাম অবলোকনে সমরে নিবৃত্ত হইয়া কম্পিত হইতে লাগিল। তখন সেই বীরদ্বয় রথের বিচিত্র গতি প্রদর্শনপূর্ব্বক পরস্পরকে দক্ষিণপার্শ্বস্থ করিতে চেষ্টা করিলেন। যোধগণ তাঁহাদিগের অসামান্য পরাক্রমদর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইল। হে মহারাজ। গগনমার্গে আমিষলোলুপ শ্যেনদ্বয়ের যেরূপ যুদ্ধ হইয়া থাকে, দ্রোণ ও অর্জ্জুনের সেইরূপ তুমুল সংগ্রাম হইতে লাগিল। দ্রোণাচার্য্য অর্জ্জুনকে পরাজিত করিবার নিমিত্ত যে যে কৌশল করিলেন, মহাবীর ধনঞ্জয় স্বীয় কৌশলপ্রভাবে তৎসমুদয় নিবারণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে অস্ত্রকোবিদ আচাৰ্য্য অর্জ্জুনকে কৌশলক্রমে পরাজিত করিতে অসমর্থ হইয়া পরিশেষে ঐন্দ্র, পাশুপত, ত্বাষ্ট্র, বায়ব্য ও বারুণ-অস্ত্র আবিষ্কৃত করিলেন; মহাবীর অর্জ্জুনও ঐ সমুদয় অস্ত্র দ্রোণের শরাসনমুক্ত হইবামাত্র ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে মহাবীর অর্জ্জুন অস্ত্রদ্বারা আচার্য্যের অস্ত্রজাল ছেদন করিলে মহাবীর দ্ৰোণ দিব্যাস্ত্রদ্বারা তাঁহাকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন; অর্জ্জুনও অনায়াসে তৎসমুদয় নিরাকৃত করিলেন। ফলতঃ দ্রোণাচাৰ্য্য জিগীষু হইয়া ধনঞ্জয়ের প্রতি যে যে অস্ত্র পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন, অর্জ্জুনশরপ্রভাবে তৎসমুদয়ই ব্যর্থ হইয়া গেল। এইরূপে পার্থশরে দিব্যাস্ত্রসমুদয়ও ধ্বংস হইলে মহাবীর দ্রোণাচার্য্য মনে মনে অর্জ্জুনের ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন এবং অর্জ্জুন তাঁহার শিষ্য, এই নিমিত্ত তিনি আপনাকে ভূমণ্ডলস্থ সমুদয় অস্ত্রবেত্তা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করিলেন। তিনি ধনঞ্জয়কর্ত্তৃক নিবারিত হইয়া আনন্দ ও গর্ব্ব প্রকাশপূর্ব্বক পরমপ্রীতিসহকারে তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় নভোমণ্ডল সহস্র সহস্র দেব, ঋষি, গন্ধর্ব্ব, সিদ্ধ, অপ্সরা, যক্ষ ও রাক্ষসগণে সমাকীর্ণ হওয়াতে বোধ হইল যেন, উহা পুনরায় ঘনঘটায় আচ্ছন্ন হইয়াছে। তখন মহাত্মা অর্জ্জুন ও দ্রোণের স্তুতিসংযুক্ত দৈববাণী বারংবার শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। পরিত্যক্ত শরজাল প্রভাবে দশদিক আলোকময় হইলে সিদ্ধ ও মুনিগণ সমরক্ষেত্রে সমাগত হইয়া কহিতে লাগিলেন, ‘ইহা মানুষ, আসুর, রাক্ষস, দৈব বা গান্ধর্ব্ব যুদ্ধ নহে; ইহা ব্রাহ্ম যুদ্ধ, তাহাতে সন্দেহ নাই।’ কখন দ্রোণাচার্য্য পাণ্ডবকে, কখন পাণ্ডবও দ্রোণকে অতিক্রম করিতেছেন; ইঁহাদের দুইজনের মধ্যে কাহারও বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হয় না। এইরূপ বিচিত্র যুদ্ধ আর কখন আমাদের দৃষ্টিগোচর বা শ্রুতিগোচর হয় নাই। যদি সাক্ষাৎ রুদ্র আপনার দেহ দুইভাগে বিভক্ত করিয়া আপনি আপনার সহিত যুদ্ধ করেন, তাহা হইলেই এই যুদ্ধের উপমাস্থল হইতে পারে; নচেৎ ইহার উপমা নাই। দ্রোণাচাৰ্য্য জ্ঞান ও শৌর্য্যে অদ্বিতীয়; অর্জ্জুনও উপায় ও বলে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। বিপক্ষগণ ইঁহাদিগকে কদাচ সংগ্রামে বিনষ্ট করিতে সমর্থ হয় না। ইঁহারা ইচ্ছা করিলে দেবগণের সহিত সমুদয় জগৎকে বিনষ্ট করিতে, পারেন। হে মহারাজ! অন্তর্হিত ও প্রকাশিত প্রাণীগণ এইরূপে সেই বীরদ্বয়ের বিক্রমদর্শনে তাঁহাদিগকে প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
“অনন্তর মহামতি দ্রোণাচাৰ্য্য সমরে মহাবীর অর্জ্জুন ও অন্তর্হিত প্রাণীগণকে সন্তপ্ত করিয়া ব্রাহ্ম-অস্ত্র আবিষ্কৃত করিলেন। তখন পর্ব্বতপাদপসম্বলিত সমুদয় ভূমণ্ডল বিচলিত, বিষম সমীরণ প্রবাহিত, সাগরসকল সংক্ষুব্ধ এবং উভয়পক্ষীয় সেনা ও অন্যান্য জীবগণ নিতান্ত ভীত হইতে লাগিল; কিন্তু মহাবীর অর্জ্জুন অসম্ভ্রান্তচিত্তে ব্রাহ্ম অস্ত্রদ্বারা দ্রোণের ব্রহ্মাস্ত্র নিরাকৃত করিয়া সমুদয়কে প্রশান্ত করিলেন। এইরূপে সেই বীরদ্বয় কেহ কাহাকে পরাভব করিতে সমর্থ না হইলে পরিশেষে সঙ্কুলযুদ্ধ সমুপস্থিত হইল। তখন আর কোন বিষয়ই অবগত হইতে পারিলাম না। আকাশমণ্ডল শরজালে সমাচ্ছন্ন হওয়াতে খেচরগণের গতিরোধ হইল।”