১৮৮তম অধ্যায়
তুমুল সঙ্কুলযুদ্ধ—উভয়পক্ষীয় বহু সৈন্যক্ষয়
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! বৰ্মধারী বীরগণ সমরাঙ্গনেই নবোদিত দিবাকরের উপাসনা করিলেন। অনন্তর তপ্তকাঞ্চনভাস্বর ভাস্কর সমুদিত হওয়াতে সমুদয় জগৎ প্রকাশিত হইলে পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে যে যে সৈন্যগণ যাহাদিগের সহিত সংগ্রামে মিলিত হইয়াছিল, এক্ষণে তাহারা সকলেই পুনরায় সেই প্রতিদ্বন্দ্বীর সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। অশ্বারোহিগণ রথীদিগের সহিত, গজাবরাহিগণ অশ্বারোহিদিগের সহিত, পদাতিগণ গজারোহীদিগের সহিত, অশ্বগণ অশ্বগণের সহিত, পদাতিগণ পদাতিগণের সহিত, রথীগণ রথীদিগের সহিত এবং মাতঙ্গণ মাতঙ্গদিগের সহিত মিলিত হইয়া সংগ্রাম করিতে লাগিল। হে মহারাজ! যোদ্ধৃগণ রজনীযোগে বহু যত্নসহকারে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেই আতপতাপে উত্তপ্ত ও ক্ষুৎপিপাসায় নিতান্ত কাতর হইয়া অচেতনপ্রায় হইলেন। শঙ্খনাদ, ভেরীনিঃস্বন, মৃদঙ্গধ্বনি, বৃংহিতশব্দ, ধনুষ্টঙ্কার, ধাবমান পদাতিগণের চীৎকার, নিপতিত অস্ত্রসমুদয়ের নিঃস্বন, অশ্বের হ্রেষারব ও রথসমুদয়ের ঘর্ঘরনির্ঘোষে মহাতুমুল শব্দ সমুত্থিত হইয়া আকাশমণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিল। ঐ সময় বিবিধ অস্ত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত-কলেবর রণনিপতিত বিচেষ্টমান হস্তী, অশ্ব, রথী ও পদাতিগণের আর্ত্তনাদ শ্রুতিগোচর হইল। তখন সৈন্যগণ শত্রুপক্ষীয় ব্যক্তিদিগকে সংহার করিতে প্রবৃত্ত হইয়া আত্মপক্ষীয়গণকেও বিনাশ করিতে লাগিল। বীরগণনিক্ষিপ্ত তরবারিসকল নিজ্যমান বসনরাশির ন্যায় নিরীক্ষিত ও সেই খড়্গসমুদয়ের শব্দ নিজ্যমান বসনশব্দের ন্যায় শ্রুত হইল। অনন্তর বীরগণ খড়্গ, তোমর ও পরশু নিক্ষেপপূর্ব্বক ভীষণ যুদ্ধ উপস্থিত, করিলে সমরস্থলে গজ, অশ্ব ও নরদেহসম্ভূত শোণিতদ্বারা এক অতি ভীষণ নদী প্রবাহিত হইল। শস্ত্ৰসমুদয় উহার মৎস্য, মাংস, কর্ম্ম, পতাকা ও বস্ত্ৰসমুদয় ফেন এবং সৈন্যগণের আর্ত্তনাদ উহার শব্দস্বরূপ শোভা পাইতে লাগিল। অশ্ব ও গজসমুদয় রজনীতে শর ও শক্তিদ্বারা নিতান্ত নিপীড়িত হইয়াছিল, সুতরাং এক্ষণে স্তব্ধভাবে অবস্থান করিতে লাগিল। শুষ্কবদন বীরগণ চারুকুণ্ডলমণ্ডিতমস্তক ও বিবিধ যুদ্ধোপকরণদ্বারা অসাধারণ শোভা ধারণ করিলেন। ঐ সময় ক্রব্যাদগণ এবং মৃত ও অর্দ্ধমৃত সৈন্যসমুদয়দ্বারা রথসঞ্চালনের পথরোধ হইল। বারণসদৃশ বলবান সৎকুলসম্ভূত বাজিগণ নিতান্ত শ্রান্ত হইয়াছিল, সুতরাং রথচক্র নিমগ্ন হইলে কম্পিতকলেবরে বলপূর্ব্বক অতিকষ্টে রথ আকর্ষণ করিতে লাগিল।
“হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর দ্রোণ ও অর্জ্জুন ভিন্ন আর সকলেই ভয়ে নিতান্ত অভিভূত হইয়াছিল। ঐ বীরদ্বয়ই তৎকালে স্ব স্ব পক্ষের আশ্রয় ও ভয়ত্রাতা হইয়াছিলেন। উহাদের প্রভাবে উভয়পক্ষীয় অনেক বীর শমনসদনে গমন করিলেন। কৌরবসৈন্যসমুদয় নিতান্ত ভীত হইল। পাঞ্চালসৈন্যেরা কোন্ স্থানে রহিয়াছে, তাহা কিছুমাত্র স্থির হইল না। সেই ভীরুজনের ভয়বর্দ্ধন, শ্মশানভূমিসদৃশ সমরাঙ্গনে ক্ষত্রিয়গণের ক্ষয়কালে ধূলিপটল সমুত্থিত হইলে কি কর্ণ, কি দ্রোণ, কি অর্জ্জুন, কি যুধিষ্ঠির, কি ভীমসেন, কি নকুল, কি সহদেব, কি সাত্যকি, কি দুঃশাসন, কি অশ্বত্থামা, কি দুৰ্য্যোধন, কি শকুনি, কি কৃপ, কি মদ্ররাজ, কি কৃতবর্ম্মা, কি অন্যান্য যোদ্ধৃগণ, কাহাকেও লক্ষিত হইল না। তৎকালে ভূমণ্ডল ও দিঙ্মণ্ডল দৃষ্ট হওয়া দূরে থাকুক, আত্মদেহ পৰ্য্যন্ত অদৃশ্য হইয়া গেল। সকলেই ধূলিপটলে সংবৃত হইল। তখন বোধ হইতে লাগিল যেন, পুনরায় নিশা উপস্থিত হইয়াছে। ঐ সময়ে কে কৌরব, কে পাঞ্চাল, কে পাণ্ডব, কিছুই অবধারিত হইল না। ভূমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও আকাশমণ্ডল এবং সম ও বিষম প্রদেশ এককালে অদৃশ্য হইল। বিজয়প্রার্থী নরগণ কি স্বকীয়, কি পরকীয়, যাহাকে প্রাপ্ত হইল, তাহাকেই নিপাতিত করিতে লাগিল। ক্রমে প্রবল বায়ুবেগ ও শোণিতনিষেকদ্বারা রজোরাশি প্রশমিত হইল। তখন হস্তী, অশ্ব, রথ, রথী ও পদাতিগণ রুধিরোক্ষিত হইয়া পারিজাত বনাবলির ন্যায় বিরাজিত হইতে লাগিল। ঐ সময় মহাবীর দুৰ্য্যোধন ও দুঃশাসন, নকুল ও সহদেবের সহিত এবং কর্ণ বৃকোদরের সহিত ও অর্জ্জুন ভারদ্বাজের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। সমুদয় যোদ্ধৃগণ তাঁহাদের সেই আশ্চৰ্য্য সংগ্রাম অবক্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা রথের বিচিত্র গতি প্রদর্শনপূর্ব্বক যুদ্ধ করিয়া পরস্পরের পরাজয়বাসনায় পরস্পরকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া বর্ষাকালীন জলধরের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। তাঁহারা সূৰ্য্যসঙ্কাশ রথে সমারূঢ় হওয়াতে তাঁহাদিগকে শারদ জীমূতের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তখন কোপপূর্ণ মহাধনুর্দ্ধর অন্যান্য যোধগণও পরমযত্নসহকারে স্পর্ধা করিয়া মত্ত মাতঙ্গসমুদয়ের ন্যায় পরস্পরের অভিমুখীন হইতে লাগিল। তৎকালে বোধ হইল যেন, কেহ কাহারও দেহ ভেদ করিতেছেন না, মহারথগণ স্বয়ং নিহত ও নিপতিত হইতেছেন। ঐ সময় যোধগণের ছিন্ন চরণ, বাহু, কুণ্ডলমণ্ডিত মস্তক, কার্মুক, বিশিখ, প্রাস, খড়্গ, পরশু, পট্টিশ, নালীক, ক্ষুর, নারাচ, নখর, শক্তি, তোমর, অন্যান্য বিবিধকার নিশিত অস্ত্রজাল, বিচিত্র বর্ম্ম, নিহত অশ্ব, হস্তী ও বীরগণ, যোধশূন্য ধ্বজবিহীন নগরাকার রথসমুদয়, আরোহিবিহীন শঙ্কিতচিত্ত বায়ুবেগে ধাবমান অশ্বগণ, অলঙ্কৃত নিহত বীরগণ এবং রাশি রাশি ব্যজন, ধ্বজ, ছত্র, আভরণ, বস্ত্র, সুগন্ধি মাল্য, হার, কিরীট, মুকুট, উষ্ণীষ, কিঙ্কিণীজাল, বক্ষঃস্থলার্পিত মণি, নিষ্ক ও চূড়ামণিদ্বারা সংগ্রামস্থল নক্ষত্ৰকুলবিভূষিত নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল।
“অনন্তর অমর্ষিত [ক্রুদ্ধ] নকুলের সহিত ক্রোধোন্মত্ত দুৰ্য্যোধনের ঘোর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। মাদ্রীপুত্র দুৰ্য্যোধনকে অসংখ্য শরে সমাচ্ছন্ন করিয়া হৃষ্টচিত্তে তাঁহাকে দক্ষিণ পার্শ্বস্থ করিলেন। ঐ সময় তুমুল কোলাহল সমত্থিত হইল। রাজা দুৰ্য্যোধন নকুলের দক্ষিণপার্শ্বে থাকিয়াই তাহার প্রতিকারচেষ্টা করিতে লাগিলেন, তখন বিচিত্ৰযুদ্ধমার্গাভিজ্ঞ [১] তেজস্বী নকুল পার্শ্বস্থ প্রতিচিকীর্ষ দুৰ্য্যোধনকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন; দুৰ্য্যোধনও তদ্দর্শনে ক্রোধভরে নকুলকে নিবারণ করিয়া শরজালে পীড়িত ও সমরে পরাঙ্মুখ করিলেন। কৌরবসৈন্যগণ তদ্দর্শনে তাঁহাকে অগণ্য ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিল। তখন মহাবীর নকুল আপনার কুপরামর্শজনিত বহু দুঃখ স্মরণপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনকে ‘থাক থাক’ বলিয়া তৰ্জন করিতে আরম্ভ করিলেন।”