১৮৭তম অধ্যায়
জীবাত্মার লক্ষণ
‘ভৃগু কহিলেন, “ব্ৰহ্মণ! জীবের ধ্বংস নাই। দেহ পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলে জীব উহা হইতে দেহান্তরে গমন করে; কেবল শরীর বিশীর্ণ হইয়া ভূতলে নিপতিত হয়। সমিধ[কাষ্ঠ]সকল ভস্মীভূত হইলে অগ্নি যেমন অদৃশ্য হয়, তদ্রূপ দেহের অবসান হইলে শরীরস্থিত জীব অদৃশ্য হইয়া থাকে।
“ভরদ্বাজ কহিলেন, ‘মহাত্মন! দাহ্যবস্তুর বিনাশে অগ্নিরও বিনাশ হইয়া থাকে। দাহ্যবস্তু না থাকিলে যে অগ্নি বর্ত্তমান থাকে তাহার প্রমাণ কি?
“ভৃগু কহিলেন, ‘হে দ্বিজোত্তম! দাহ্যবস্তুর শেষ হইলে অগ্নি অদৃশ্য হয় বটে, কিন্তু উহার এককালে ধ্বংস হয় না। উহা আশ্রয় অভাবে আকাশে বিলীন হওয়াতে আমরা উহা দর্শন করিতে অসমর্থ হইয়া থাকি। ঐরূপ জীবাত্মাও শরীর পরিত্যাগ করিয়া আকাশে অবস্থান করে এবং নিতান্ত সূক্ষ্ম বলিয়া আমাদের নয়নগোচর হয় না। অগ্নি জ্ঞানময়জীবস্বরূপ। উহা বায়ুর সহিত সঙ্গত হইয়া দেহমধ্যে অবস্থান করে। নিশ্বাসপবন রুদ্ধ হইলেই উহার নাশ হয় এবং উহার নাশ হইলেই দেহ ভূতলে নিপতিত ও বিলীন হইয়া যায়। স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় পদার্থের শরীরের বায়ু আকাশের এবং জ্যোতি বায়ুর অনুগমন করে আকাশ, অগ্নি ও বায়ু ইহারা যেমন পরস্পর একত্র অবস্থান করিতেছে, তদ্রূপ জল ও মৃত্তিকা পরস্পর এক প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। ঐ পঞ্চভূতের মধ্যে আকাশ, অগ্নি ও বায়ু অদৃশ্য এবং মৃত্তিকা ও জল দৃশ্য পদার্থ।
“ভরদ্বাজ কহিলেন, ‘মহাত্মন! প্রাণীমাত্রেরই শরীরে যে অগ্নি, বায়ু, মৃত্তিকা, জল ও আকাশ বিদ্যমান রহিয়াছে, তাহা আপনি সবিশেষ কীৰ্ত্তন করিলেন। এক্ষণে জীবের লক্ষণ কি তাহা কীৰ্ত্তন করুন। পঞ্চজ্ঞানসমন্বিত পাঞ্চভৌতিক দেহে জীবাত্মা কিরূপে অবস্থান করিতেছে? এই মেদ, মাংস, শোণিত, স্নায়ু ও অস্থিসমাকীর্ণ দেহ বিদীর্ণ করিলেও ত’ জীবাত্মা নয়নগগাচর হয় না। যদি এই পাঞ্চভৌতিক দেহের চৈতন্য না থাকে, তাহা হইলে শারীরিক বা মানসিক দুঃখ উপস্থিত হইলে উহা লোকের অনুভূত হইবার সম্ভাবনা কি? আপনার মতে জীবাত্মা কর্ণের সাহায্যে শ্রবণ এবং চক্ষুর সাহায্যে দর্শন করিয়া থাকে, কিন্তু বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলে মনই শ্রবণাদি কার্য্যে ব্যাপৃত রহিয়াছে। যদি মনঃসংযোগ না থাকে, তাহা হইলে লোকের কখনই শ্রবণাদি জ্ঞান জন্মে না। লোকে নিদ্রায় অভিভূত হইলে তৎকালে কখনই তাহার শ্রবণ, দর্শন, আঘ্রাণ, স্পর্শ, আস্বাদন অথবা হর্ষ, বিষাদ, ক্রোধ, ভয়, ইচ্ছা, দ্বেষ, চিন্তা ও বাঙুনিষ্পত্তি করিবার ক্ষমতা থাকে না। অতএব অনর্থক জীবাত্মা স্বীকার করিবার তাৎপর্য্য কি?
“ভৃগু কহিলেন, ‘ব্রহ্মন্! মন পঞ্চভূত হইতে পৃথক নহে। সুতরাং উহাদ্বারা শারীরিক ক্রিয়া নির্ব্বাহ হইবার সম্ভাবনা নাই। একমাত্র অন্তরাত্মা লোকের শরীরে ব্যাপ্ত হইয়া শারীরিক কাৰ্য্যসাধন করিতেছে। সেই অন্তরাত্মাই রূপ, গন্ধ, আঘ্রাণ, দর্শন, স্পর্শ ও আস্বাদন প্রভৃতি কাৰ্য্য করিয়া থাকে। উহারই সুখদুঃখ অনুভব হয়। আত্মার সহিত বিয়োগ উপস্থিত হইলে দেহ আর কিছুই অবগত হইতে সমর্থ হয় না। যখন লোকের শরীরস্থিত অগ্নিস্বরূপ আত্মার বিয়োগনিবন্ধন লোকের রূপ-স্পর্শাদি জ্ঞান কিছুমাত্র থাকে না, তখনই তাহার মৃত্যু উপস্থিত হয়। এই সমুদয় জগৎ জলময়, জল জীবগণের মূর্ত্তিস্বরূপ। লোকবিধাতা ব্রহ্মা আত্মরূপে সমুদয় জীবে অবস্থান করিতেছেন। আত্মা সামান্য গুণসমুদয়ে সংযুক্ত হইলে ক্ষেত্রজ্ঞ এবং ঐ সকল গুণ হইতে বিযুক্ত হইলে পরমাত্মা বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইয়া থাকে। আত্মা পদ্মমধ্যে জলবিন্দুর ন্যায় দেহমধ্যে অবস্থান করিতেছে। উহা সমুদয় জীবের হিতকারী, যোগাদিদ্বারা উহাকে বশীভূত করা যায়। সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিনটি উহার গুণ। দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন আত্মার সুখদুঃখভোগের দ্বার। উহারা আত্মার প্রভাবে চেষ্টাযুক্ত হইয়া কার্য্যে ব্যাপৃত হয়। পরমাত্মা নিগুণ, উহার সহিত কোন কার্য্যেরই সংস্রব নাই। জীবাত্মার বিনাশ নাই। যাহারা আত্মার ধ্বংস নিরূপণ করে, তাহারা মূঢ়। জীবাত্মা কেবল এক দেহ হইতে অন্য দেহে গমন করে, দেহান্তরে গমনই তাহার মৃত্যু।
‘হে দ্বিজোত্তম! আত্মা এইরূপে অজ্ঞানে আবৃত হইয়া গৃঢ়ভাবে সৰ্ব্বভূতে বিচরণ করিতেছে। তত্ত্বদর্শীরাই কেবল অত্যুৎকৃষ্ট সূক্ষ্মবুদ্ধিপ্রভাবে উহা পর্য্যবেক্ষণ করিতে সমর্থ হয়েন। পণ্ডিত ব্যক্তিরা সতত যোগসাধন ও অল্পাহারপ্রভাবে শুদ্ধচিত্ত হইয়া আত্মার সহিত সাক্ষাৎকার লাভ এবং চিত্তপ্রসাদনিবন্ধন শুভাশুভ কৰ্ম্মসমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পরমাত্মায় লীন হইয়া শাশ্বত সুখাস্বাদন করিয়া থাকেন। শরীরমধ্যে অগ্নির ন্যায় প্রকাশময় যে মানসিক জ্যোতিঃ বিদ্যমান রহিয়াছে, তাহাকেই জীবাত্মা বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়।”