১৮৫তম অধ্যায়
দ্রোণবধপর্ব্বাধ্যায়—উভয়পক্ষের যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এইরূপে ব্যাসদেবের আজ্ঞানুসারে স্বয়ং কর্ণবিনাশে নিবৃত্ত এবং ঘটোৎকচবধজনিত দুঃখ ও ক্রোধে একান্ত অভিভূত হইলেন। তিনি ভীমসেনকে অসংখ্য কৌরবসেনা বিদারিত করিতে দেখিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে দ্রুপদতনয়! তুমি দ্রোণাচাৰ্য্যকে নিবারণ কর। তুমি দ্রোণবিনাশের নিমিত্ত শর, কবচ, খড়্গ ও ধনুর্দ্ধারণপূর্ব্বক হুতাশন হইতে উৎপন্ন হইয়াছ। হৃষ্টচিত্তে সমরে ধাবমান হও, তোমার কিছুমাত্র ভয় নাই। জনমেজয়, শিখণ্ডী, যশোধর, দৌর্মুখি, নকুল, সহদেব, পুত্র ও ভ্রাতৃগণে পরিবেষ্টিত দ্রুপদ ও বিরাট, মহাবল সাত্যকি ও অর্জ্জুন এবং প্রভদ্রক, কেকয় ও দ্রৌপদীতনয়গণ—ইহারাও সন্তুষ্টচিত্তে দ্রোণবধবাসনায় বেগে ধাবমান হউন। রথীগণ হস্তী, অশ্ব ও পদাতিগণে পরিবৃত হইয়া মহারথ দ্রোণকে নিপাতিত করুন।’
“হে মহারাজ! তখন সেই সমস্ত যোধগণ মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞাক্রমে দ্ৰোণজিগীষু হইয়া মহাবেগে ধাবমান হইল। শস্ত্রধরাগ্রগণ্য দ্রোণাচার্য্য অনায়াসে সেই সময়ে সহসা সমাগত বীরগণের অভিমুখীন হইলেন। রাজা দুৰ্য্যোধন তদ্দর্শনে রোষাবিষ্টচিত্তে দ্রোণের জীবনরক্ষাৰ্থ সুসজ্জিত হইয়া পাণ্ডবগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন শ্রান্তবাহন পাণ্ডব ও কৌরবগণ পরস্পর তর্জ্জনগৰ্জন করিয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিলে মহারথগণ নিদ্ৰান্ধ ও পরিশ্রান্ত হইয়া সমরে নিশ্চেষ্টপ্রায় হইলেন। সেই প্রাণীগণের প্রাণনাশিনী ত্রিযামা রজনী তাঁহাদিগের পক্ষে সহস্রযামা বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। এই অর্দ্ধরাত্ৰিসময়ে সৈন্যগণ ক্ষতবিক্ষত ও বধ্যমান হইলে উভয়পক্ষীয় ক্ষত্রিয়গণ দীনচিত্তে, উৎসাহশূন্য এবং অস্ত্রশস্ত্রবিহীন হইয়াও লজ্জা ও স্বধর্ম্মপরিপালননিবন্ধন স্ব স্ব সৈন্য পরিত্যাগ করিলেন না। সৈন্যগণ নিদ্ৰান্ধ হইয়া নিশ্চেষ্টভাবে কেহ অশ্বে, কেহ গজে ও কেহ বা রথোপরি শয়ন করিতে লাগিল। সেই সুযোগে অন্য যোধগণ তাহাদিগকে অনায়াসে যমালয়ে প্রেরণ করিল। অনেকে স্বপ্নে বিপক্ষদলকে অবলোকন করিয়া নানাপ্রকার বাক্যোচ্চারণপূর্ব্বক আপনাকে, আত্মীয়গণকে ও শত্রুগণকে সমরে সমাহত করিতে লাগিল। আমাদের পক্ষীয় অসংখ্য বীর শত্রুগণের সহিত সংগ্রাম করিবার মানসে নিদ্রারক্তলোচনে অবস্থান করিতে লাগিল। কতকগুলি নিদ্ৰান্ধ বীরপুরুষ সেই নিদারুণ অন্ধকারে গমনাগমনপূর্ব্বক পরস্পরের প্রাণ বিনাশ করিতে লাগিল। অনেকে নিদ্রায় এইরূপ আচ্ছন্ন হইল যে, শক্তহস্তে নিহত হইয়াও কিছুই অবগত হইতে সমর্থ হইল না।
সাময়িক যুদ্ধবিরতি-অর্জ্জুনের অভিনন্দন
“হে মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন তাহাদিগের এইরূপ চেষ্টা অবগত হইয়া উচ্চস্বরে কহিতে লাগিলেন, ‘হে সেনাগণ! তোমরা বাহনগণের সহিত অন্ধকার ও ধুলিপটলে সমাবৃত এবং নিতান্ত পরিশ্রান্ত ও নিদ্ৰান্ধ হইয়াছ; অতএব যদি তোমাদিগের মত হয়, তাহা হইলে কিয়ৎক্ষণ সমরে নিবৃত্ত হইয়া এই রণভূমিতেই নিদ্রা যাও। অনন্তর নিশানাথ সমুদিত হইলে তোমরা বিনিদ্র হইয়া স্বর্গলাভের নিমিত্ত পুনরায় পরস্পর সমরে প্রবৃত্ত হইবে। তখন কৌরবপক্ষীয় ধর্ম্মজ্ঞ বীরগণ ধার্মিক ধনঞ্জয়ের সেই বাক্যশ্রবণে তাহাতে সম্মত হইয়া ‘হে কর্ণ। হে মহারাজ দুৰ্য্যোধন! পাগুবসেনা যুদ্ধে নিবৃত্ত হইয়াছে; অতএব তোমরাও নিবৃত্ত হও, পরস্পর উচ্চস্বরে বারংবার এই কথা কহিতে লাগিলেন।’ এইরূপে অর্জ্জুনের বাক্যশ্রবণে সমুদয় দেব ও মুনিগণ সন্তুষ্ট হইয়া অর্জ্জুনের বাক্যের প্রশংসা করিতে লাগিলেন। পরিশ্রান্ত সৈনিকপুরুষগণ অর্জ্জুনবাক্যের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া বিশ্রাম করিতে আরম্ভ করিল। আপনার সৈন্যগণ কিয়ৎক্ষণ বিশ্রামের অবকাশ পাইয়া অর্জ্জুনকে এই বলিয়া প্রশংসা করিতে লাগিল, ‘হে মহাবাহো! তোমাতে বেদ, অস্ত্রসমূহ, বুদ্ধি, পরাক্রম, মঙ্গল ও জীবের প্রতি অনুকম্পা বর্ত্তমান রহিয়াছে, অতএব আমরা আশাসিত হইয়া প্রার্থনা করিতেছি, তোমার মঙ্গল হউক। তুমি বাঞ্ছিত ফল লাভ করিয়া পরিতুষ্ট হও।’ মহারথগণ তাঁহাকে এইরূপ প্রশংসা করিতে করিতে নিদ্রায় আচ্ছন্ন হইয়া তৃষ্ণীভূত হইলেন। কেহ কেহ অশ্বপৃষ্ঠে, কেহ কেহ রথে, কেহ কেহ গজস্কন্ধে, কেহ কেহ ক্ষিতিতলে শয়ন করিলেন। অনেকে বাণ, গদা, খড়, পরশু, প্রাস ও কবচ ধারণ করিয়াই পৃথক পৃথক স্থানে নিদ্রিত হইল। নিদ্ৰান্ধ মাতঙ্গগণ ভূরেণুভূষিত [ধূলি] ভুজগভোগসদৃশ [সর্পদেহতুল্য] শুণ্ডদ্বারা নিশ্বাসপরিত্যাগপূর্ব্বক পৃথিবীতল শীতল করিয়া নিশ্বসন্ত পন্নগপরিবৃত পর্ব্বতসমুদয়ের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। সুবর্ণ-যোক্তপরিশোভিত অশ্বগণ কেশরালম্বিত যুপকাষ্ঠ ও খুরাগ্রদ্বারা সমরভূমি বিষম করিয়া ফেলিল। এইরূপে সেই সংগ্রামস্থলে অশ্ব, হস্তী ও যোধগণ নিতান্ত শ্রান্ত ও যুদ্ধে বিরত হইয়া নিদ্রিত হইল। তৎকালে বোধ হইতে লাগিল যেন, সুনিপুণ চিত্রকরগণ ঐ সমস্ত বল চিত্রপটে বিচিত্রিত করিয়াছে। পরস্পরের শরে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ কুণ্ডলধারী তরুণবয়স্ক ক্ষত্রিয়গণ গজকুম্ভের উপর শয়ান থাকাতে বোধ হইতে লাগিল যেন, তাঁহারা কামিনীগণের কুচকলস আলিঙ্গনপূর্ব্বক শয়ন করিয়াছেন।
“হে মহারাজ। অনন্তর নয়নপ্রীতিবৰ্ধন কামিনীর গণ্ডদেশের ন্যায় পাণ্ডুবর্ণ ভগবান্ কুমুদনায়ক চন্দ্রমা মাহেন্দ্ৰী [পুর্ব্ব] দিক অলঙ্কৃত করিলেন। তিনি উদয়পর্ব্বতের সিংহের ন্যায় পূর্ব্বদিকরূপ দরী হইতে বিনিঃসৃত হইয়া তিমিররূপ হস্তিযূথ বিনাশ করিয়া সমুদিত হইতে লাগিলেন। তখন সেই হরবৃষ সমপ্রভ, কন্দর্পচাপসদৃশ, নববধুর হাস্যের ন্যায় মনোহর কুমুদবান্ধব প্রথমতঃ আলোকমাত্র প্রদর্শন করিয়া ক্রমে ক্রমে, সুবর্ণবর্ণ রশ্মিজাল প্রকাশ করিতে লাগিলেন। চন্দ্রকিরণ প্রভাদ্বারা তোমোরাশি উৎসারিত করিয়া শনৈঃ শনৈঃ দিঙ্মণ্ডল, ভূমণ্ডল ও আকাশমণ্ডলে গমন করিল। তখন মুহূৰ্তমধ্যে ভূমণ্ডল জ্যোতির্ম্ময় হইল। তিমিররাশি অবিলম্বেই বিনষ্ট হইয়া গেল। নিশাচর জন্তুগণ কেহ কেহ বিচরণে প্রবৃত্ত ও কেহ কেহ ক্ষান্ত হইল। হে মহারাজ! এইরূপে চন্দ্রমা সমুদিত হইলে সৈন্যগণ সুর্য্যাংশুসন্নিভ পদ্মবনের ন্যায় প্রবোধিত হইতে লাগিল এবং তাহারা মহাসাগরের ন্যায় চন্দ্রোদয় দর্শনে উদ্ধৃত হইয়া উঠিল। তখন লোকবিনাশের নিমিত্ত পরমগতিলাভার্থী বীরপুরুষগণের পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ হইল।”