১৮৪তম অধ্যায়
ক্ষিতি আদি পাঞ্চভৌতিক সৃষ্টি
“ভরদ্বাজ কহিলেন, ‘ভগবন্! পূৰ্ব্বকালে সৰ্ব্বলোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা মনে মনে যে পৃথিব্যাদি পঞ্চভূতের সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তৎসমুদয় কি? আর প্রজাপতি ব্রহ্মা হইতে জরায়ুজ, স্বেদজ প্রভৃতি সহস্র সহস্র ভূতের সৃষ্টি হইয়াছে, তবে পৃথিবী প্রভৃতি পাঁচটিই বা কি নিমিত্ত মহাভূত বলিয়া পরিগণিত হইল, তাহা আমার নিকটে কীৰ্ত্তন করুন।
“ভৃগু কহিলেন, তপোধন! অপরিমেয় পদার্থই মহৎশব্দবাচ্য হইয়া থাকে। পৃথিব্যাদি পঞ্চভূত অপরিমেয় বলিয়া মহাভূতনামে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। এই জগতে যে-কোন পদার্থ আমাদের নয়নগোচর হয়, তৎসমুদয়ই ঐ পঞ্চভূত হইতে উৎপন্ন। মনুষ্যগণের দেহ পঞ্চভূতাত্মক। চেষ্টা উহার বায়ু, ছিদ্র উহার আকাশ, অগ্নি উহার তেজ, রুধিরাদি দ্রব্যপদার্থ উহার জল এবং মাংসাদি উহার পৃথিবী। কি স্থাবর, কি জঙ্গম, সমুদয় পদার্থই এইরূপে পঞ্চভূতদ্বারা নির্ম্মিত হইয়াছে। প্রাণীগণের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ও পঞ্চভূতাত্মক, শ্রোত্র আকাশাত্মক [আকাশধৰ্ম্মা—শুন্যে শব্দ ধ্বনিত হইয়া শ্রবণগোচর হয়], ঘ্রাণ পৃথিব্যাত্মক [পৃথিবীধৰ্ম্মা-গন্ধগুণ মৃত্তিকায় থাকে, তাহা ঘ্রাণদ্বারা অনুমেয়], রসনা জলাত্মক [জলবৰ্ম্মা—জলাদি রসের অনুভব হয় রসনায়], ত্বক বাতাত্মক [বাতধৰ্ম্মা— চামড়া বায়ুর স্পর্শ গ্রহণ করে] ও চক্ষু তেজোময় [তেজোধৰ্ম্মা—চক্ষু তেজ দর্শন করে]।
“ভরদ্বাজ কহিলেন, ‘ব্ৰহ্মন্! কি স্থাবর, কি জঙ্গম সমুদয় পদার্থই যদি পঞ্চভূতদ্বারা নিৰ্ম্মিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে স্থাবরদেহে কি নিমিত্ত পঞ্চভূত লক্ষিত হয় না? দেখুন, বৃক্ষলতাদি শ্রবণ, দর্শন, আঘ্রাণ, আস্বাদন বা স্পর্শ করিতে পারে না। উহাদের শরীরেও রুধিরাদিদ্রব পদার্থ [তরলবস্তু], অগ্নিস্তূপ [ঘনীভূত অগ্নিতাপ] তেজ, অস্থিমাংসাদিরূপ পৃথিবী, চেষ্টারূপ বায়ু ও ছিদ্ররূপ আকাশ বিদ্যমান নাই; তবে উহারা কিরূপে পাঞ্চভৌতিক বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে?’
“ভৃগু কহিলেন, “ব্‘হ্মন্! বৃক্ষলতাদি স্থাবরগণ নিতান্ত ঘনীভূত বলিয়া স্থূলদৃষ্টিতে উহাদের মধ্যে আকাশ লক্ষিত হয় না বটে, কিন্তু যখন প্রতিনিয়ত উহাদের ফলপুষ্পেগম হইতেছে, তখন বিশেষ পৰ্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে উহাদের মধ্যে যে আকাশ আছে, তাহা অবশ্যই প্রতীয়মান হইবে। যখন উত্তাপদ্বারা উহাদের পত্র, ত্বক, ফল ও পুষ্পসমুদয় স্নান ও বিশীর্ণ হইয়া যায়, তখন আর উহাদিগের স্পর্শজ্ঞানবিষয়ে সংশয় কি? যখন বায়ু, অগ্নি ও বজ্রের শব্দে উহাদের ফুলপুষ্প বিশীর্ণ হইয়া পড়ে, তখন নিশ্চয়ই বোধ করিতে হইবে যে, উহাদের শ্রবণশক্তি বিদ্যমান রহিয়াছে। দর্শনহীন জন্তু কখনই স্বয়ং পথ চিনিয়া গমন করিতে পারে না। অতএব যখন লতাসমুদয় বৃক্ষের নিকট আগমন, উহাকে পরিবেষ্টন ও ইতস্ততঃ গমন করে, তখন উহাদের দর্শনশক্তি অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে। যখন বৃক্ষলতাদি পবিত্র ও অপবিত্র গন্ধ এবং বিবিধ ধূপদ্বারা রোগবিহীন হইয়া পুস্পিত হইতেছে, তখন তাহারা নিঃসন্দেহে আঘ্রাণ করিতে পারে। যখন উহারা মূলদ্বারা সলিল পান করিতে সমর্থ হয়, তখন নিশ্চয়ই উহাদিগের রসনেন্দ্রিয় বিদ্যমান আছে। যেমন মুখদ্বারা উৎপলনাল [পদ্মনাল-পদ্মের ডাঁটা] গ্রহণ করিয়া জল শোষণ করা যায়, তদ্রূপ পাদপগণ পবনসহযোগে মূলদ্বারা সলিল পান করে। এইরূপে যখন উহাদিগকে সুখদুঃখসংযুক্ত এবং ছিন্ন হইলে পুনরায় প্ররোহিত হইতে দেখা যায়, তখন অবশ্যই উহাদের জীবন স্বীকার করিতে হইবে। উহাদিগকে অচেতন বলিয়া নির্দেশ করা কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে। বৃক্ষাদি স্থাবরপদার্থ মূলদ্বারা যে জলগ্রহণ করে, অগ্নি ও বায়ু সেই জল জীর্ণ করিয়া থাকে। ঐ জলের পরিপাক হওয়াতেই ঐ সকল স্থাবর-পদার্থ লাবণ্যবিশিষ্ট ও পরিবৰ্দ্ধিত হয়।
পঞ্চভূতের পৃথক পৃথক্ গুণবিশ্লেষণ
‘পঞ্চভূত জঙ্গমগণের শরীরে ভিন্ন ভিন্নরূপে অবস্থিত থাকাতেই তাহারা অঙ্গসঞ্চালনাদি ক্রিয়া নির্ব্বাহ করিতে পারে। ঐ পঞ্চভূত প্রত্যেকে পাঁচ পাঁচ প্রকারে বিভক্ত হইয়া জীবগণের শরীরে অবস্থান করিতেছে। পৃথিবী ত্বক, মাংস, অস্থি, মজ্জা ও স্নায়ুরূপে; তেজঃ, অগ্নি, ক্রোধ, চক্ষু, উষ্মা [উষ্ণতাপ], জঠরানলরূপে; আকাশ শ্রোত্র, ঘ্রাণ, মুখ, হৃদয় ও কোষ্ঠ রূপে এবং জল শ্লেষ্ম, পিত্ত, স্বেদ, রস ও শোণিতরূপে অবস্থিত এবং বায়ু প্রাণ, ব্যান, অপান, উদান ও সমান রূপে রহিয়াছে। প্রাণ প্রাণীগণের গমনাদিক্রিয়াসম্পাদন ও ব্যান উদ্যমসাধন এবং অপান গুহ্যদেশে ও সমান হৃদয়ে অবস্থান করে; আর উদান বায়ুদ্বারা তাহারা নিঃশ্বাস পরিত্যাগ ও শব্দ উচ্চারণ করিতে সমর্থ হয়; এইরূপে এই পঞ্চবিধ বায়ু দেহিগণের চেষ্টা সমাধান করিয়া থাকে। ভূমি হইতে গন্ধ, জল হইতে রস এবং তেজোময় চক্ষুদ্বারা রূপ ও বায়ুদ্বারা স্পর্শজ্ঞান হইয়া থাকে।
‘পৃথিবীর পাঁচ গুণ-গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ ও শব্দ; তন্মধ্যে গন্ধের বিষয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। গন্ধ নয় প্রকার-ইষ্ট, অনিষ্ট, মধুর, কটু, দূরগামী, বিচিত্র, স্নিগ্ধ, রুক্ষ ও বিশদ। গন্ধগুণ পৃথিবী হইতেই উৎপন্ন হইয়া থাকে।
‘জলের চারি গুণ—রস, রূপ, স্পর্শ ও শব্দ। তন্মধ্যে রসের বিষয় কহিতেছি, শ্রবণ কর। রস ছয় প্রকার—মধুর, লবণ, তিক্ত, কষায়, অম্ল ও কটু। রসগুণ জল হইতে উৎপন্ন হইয়াছে।
‘তেজের তিন গুণ—শব্দ, স্পর্শ ও রূপ। এক্ষণে তেজঃপ্রভাবে যেরূপ সমুদয় দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। রূপ যোড়শ প্রকার—হ্রস্ব, দীর্ঘ, স্থূল, চতুষ্কোণ, বর্ত্তুল, শুক্ল, কৃষ্ণ, রক্ত, নীল, পীত, অরুণ, কঠিন, চিক্কণ, মধুর, স্নিগ্ধ ও অতি দারুণ। রূপ তেজ হইতে উদ্ভূত হইয়াছে।
‘বায়ুর দুই গুণ—শব্দ ও স্পর্শ। স্পর্শ একাদশ প্রকার—উষ্ণ, শীত, সুখকর, দুঃখজনক, স্নিগ্ধ, বিশদ, খর, মৃদু, রুক্ষ, লঘু ও গুরু। স্পর্শগুণ বায়ু হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে। তন্মধ্যে আকাশের একমাত্র গুণ শব্দ। শব্দ সাত প্রকার-ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ। এই সপ্তবিধ শব্দ পটহাদিতে [কর্ণপটহাদিতে—কর্ণচ্ছিদ্রের মধ্যে ঢাকের চামড়ার ন্যায় একপ্রকার পরদা থাকে; তাহাতে বাহিরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হইয়া শ্রবণগোচর হয়] বিদ্যমান দেখা যায় বটে, কিন্তু উহারা আকাশ হইতেই উদ্ভূত হইয়াছে। মনুষ্যাদি প্রাণী এবং মৃদঙ্গ, ভেরী, শঙ্খ ও রথ প্রভৃতি অপ্রাণীদিগের যেসমস্ত শব্দ গ্রহণ করা যায়, তৎসমুদয়ই আকাশসম্ভূত; এই নিমিত্ত শব্দ আকাশজ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। বায়ু লোকের শব্দজ্ঞানের কারণ। লোকে বায়ুর অনুকূলতাবশতঃই শব্দ অবধারণে সমর্থ ও উহার প্রতিকূল তানিবন্ধনই শব্দজ্ঞানে অসমর্থ হয়। প্রাণীগণের শরীরস্থিত ত্বগাদি ইন্দ্রিয়সমুদয় বাতাত্মক প্রাণদ্বারাই ক্রমে ক্রমে পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে। ফলতঃ জল, অগ্নি ও বায়ু ইহারা নিরন্তর জীবগণের শরীরে অবস্থান করিয়া উহাদের জীবন রক্ষা করিতেছে। উহারা প্রাণীগণের শরীরের মূল।”