১৮১তম অধ্যায়
তৃতীয় দিনের যুদ্ধ
ভীষ্ম কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! পরদিন প্ৰভাতে মহাতেজাঃ জামদগ্ন্য রণস্থলে সমুপস্থিত হইলে পুনরায় তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইল। দিব্যাস্ত্ৰবিৎ পরশুরাম প্রতিদিন বহুসংখ্যক দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। আমি প্রিয়তর প্রাণরক্ষণে নিরপেক্ষ হইয়া [প্ৰাণের মমতা পরিত্যাগ করিয়া] অস্ত্ৰজাল বিস্তারপূর্ব্বক তাহা নিবারণ করিতে লাগিলাম। অনন্তর তিনি প্ৰাণপণে যুদ্ধ আরম্ভ করিয়া ঘোররূপ কালপ্রযুক্ত [তৎকালোচিত মারণাস্ত্ৰতুল্য] প্রজ্বলিত উল্কার ন্যায় এক শক্তি প্রয়োগ করিলেন। উহা তেজঃপ্রভাবে লোকসমুদয় সমাচ্ছন্ন করিয়া আগমন করিতে লাগিল। আমি শরদ্বারা প্রলয়কালীন ভাস্করের ন্যায় প্রদীপ্ত সেই শক্তি তিনখণ্ডে ছেদন করিয়া ভূতলে পাতিত করিলাম। তখন পবিত্ৰগন্ধসম্পন্ন সমীরণ সঞ্চরণ করিতে লাগিল।
“অনন্তর রাম ক্ৰোধে অধীর হইয়া এককালে দ্বাদশটি শক্তি প্রয়োগ করিলে আমি তাহাদের তেজস্বিতা [তেজোময়তা] ও শীঘ্ৰগামিতা [দ্রুতগতিশীলতা] প্রযুক্ত স্বরূপ-বৰ্ণনে সমর্থ হইলাম না; কিন্তু লোকসংহারার্থ সমুদিত দ্বাদশ দিবাকরের ন্যায় [প্ৰলয়কালীন সূৰ্য্যসদৃশ] প্ৰদীপ্ত নানারূপধারী উল্কাতুল্য সেই শক্তিসমুদয় চতুর্দ্দিক হইতে আগমন করিতেছে দেখিয়া নিতান্ত বিহ্বল হইলাম। অনন্তর বাণনিবাহ[শরসমূহ]দ্বারা তাঁহার অন্য শরজাল ভেদ করিয়া পশ্চাৎ দ্বাদশশর প্রয়োগপূর্ব্বক ঘোররূপ শক্তিসকল প্রতিহত করিলাম। তখন জামদগ্ন্য কাঞ্চনপট্টমণ্ডিত [সোনার পাতে মোড়া], সুবর্ণসম্পন্ন প্রজ্বলিত উল্কার ন্যায় অতি ভয়ঙ্কর শক্তিসকল নিক্ষেপ করিলেন। আমি চর্ম্মদ্বারা তাহাদিগকে নিবারণ ও খড়্গদ্বারা ছেদন করিয়া ভূতলে নিপাতিত করিয়া জামদগ্ন্যেন সারথি ও অশ্বগণের প্রতি অনবরত দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করিতে লাগিলাম। তিনি নির্মোক[পুরাতন ত্বক—খোলস] মুক্ত পন্নগের [সর্পের] ন্যায় হেমচিত্ৰিত [স্বৰ্ণভূষিত] শক্তিসকল ছিন্ন দেখিয়া ক্রুদ্ধমনে দিব্যাস্ত্ৰ বিস্তার করিলেন। তখন সেই শরশ্রেণী শলভাসমূহের [পতঙ্গগণের] ন্যায় সমুপস্থিত হইয়া আমার দেহ, অশ্ব, রথ ও সারথিকে সমাচ্ছন্ন করিলে তদ্বারা রথের যুগ [বোম] ও অক্ষা [চক্ৰ] ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল। পরে আমি জামদগ্ন্যকে লক্ষ্য করিয়া শরক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলে তাঁহার কলেবর শরজালদ্বারা ক্ষতবিক্ষত হইয়া, অজস্র রুধির বর্ষণ করিতে লাগিল। তিনি বাণদ্বারা নিতান্ত সন্তপ্ত হইলেন; আমিও শরসমূহে সাতিশয় বিদ্ধ হইলাম। অনন্তর দিবাকর অস্তাচল-চূড়াবলম্বী হইলে আমাদিগের যুদ্ধ বিরত হইল।”