১৮০তম অধ্যায়
দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধ
ভীষ্ম কহিলেন, “হে রাজন! এ দিকে সারথি আপনার [তাহার নিজের দেহের], আমার ও অশ্বগণের শল্য [যুদ্ধকালে শরীরবিদ্ধ বাণের বেদনা] আপনীত করিল। অনন্তর ভগবান সূৰ্য্য সমুদিত হইলে এবং অশ্বগণ স্নান, জলপান ও বিশ্রামলাভ করিলে পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ হইল। জমদগ্ন্য আমাকে রথারোহণ ও বর্ম্মধারণপূর্ব্বক সত্বর আগমন করিতে দেখিয়া আপনার রথ সুসজ্জিত করিয়া আগমন করিতে লাগিলেন। আমি সমনাভিলাষী। পরশুরামকে আগমন করিতে দেখিয়া কামুক পরিত্যাগপূর্ব্বক সত্বর রথ হইতে অবতীর্ণ হইলাম এবং তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া পুনরায় রথারোহণপূর্ব্বক নিৰ্ভয়ে যুদ্ধাভিলাষে তাহার সন্নিধানে গমন করিলাম।
“অনন্তর আমি তাঁহার প্রতি শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলে তিনিও আমার প্রতি বাণবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। জমদগ্ন্য নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া আমার উপর অনবরত প্ৰদীপ্তমুখ [অগ্নিতুল্য জ্বলিতবদন] উরগের [সর্পের] ন্যায় সাতিশয় ভয়ানক শরজাল প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিলেন; আমিও নিশিত শতসহস্র ভল্লাস্ত্রদ্বারা অন্তরীক্ষে পুনঃ পুনঃ তাহা ছেদন করিতে লাগিলাম। জমদগ্ন্য আমাকে লক্ষ্য করিয়া দিব্যাস্ত্রসমুদয় [প্ৰধান প্ৰধান অস্ত্ৰসকল] প্রয়োগ করিলে আমিও অস্ত্ৰদ্বারা তাঁহার সেই সকল অস্ত্র নিবারণ করিলাম, তখন নভোমণ্ডলে এক সুগভীর শব্দ সমুত্থিত হইল।
“অনন্তর আমি জমদগ্ন্যের প্রতি বায়ব্যাস্ত্র প্রয়োগ করিলে তিনি গুহ্যুকাস্ত্রদ্বারা তাহা প্রতিহত করিলেন। পরে আমি মন্ত্রপূত করিয়া আগ্নেয়াস্ত্র পরিত্যাগ করিলাম। তিনি বরুণাস্ত্রদ্বারা তাহা নিবারণ করিলেন। এইরূপে আমরা পরস্পর অস্ত্ৰজাল নিবারণ করিতে লাগিলাম। অনন্তর তিনি আমাকে বামপার্শ্বস্থ করিয়া ক্ৰোধভরে আমার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন; আমি তৎক্ষণাৎ মূর্চ্ছিত হইয়া রথে নিপতিত হইলাম। সারথি আমাকে পরশুরামের শরে একান্ত নিপীড়িত ও মূর্চ্ছিত দেখিয়া সত্বর রণস্থল হইতে অপবাহিত [অপসারিত] করিল। তখন অকুতব্রণপ্রভৃতি তাঁহার অনুচরবর্গ ও কাশিরাজ কন্যা অম্বা আমাকে বাণিবিদ্ধ, বিচেতন ও তৎপরে রণস্থলে অনুপস্থিত দেখিয়া হৃষ্টমনে আক্রোশ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।
“অনন্তর আমি সংজ্ঞালাভ করিয়া সারথিকে কহিলাম, “হে সূত! আমার বেদনা অপনীত হওয়াতে পুনরায় যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইয়াছি; এক্ষণে তুমি পরশুরামসন্নিধানে আমাকে লইয়া চল।” তখন সারথি মারুতগামী [বায়ুতুল্য দ্রুতগামী] পরমশোভাসম্পন্ন অশ্বদ্বারাচালিত রথে আমাকে বহন করিতে লাগিল। বোধ হইল যেন, অশ্বগণ নৃত্য করিতেছে। অনন্তর রথ অনতিবিলম্বে পরশুরামসন্নিধানে সমুপস্থিত হইল। আমি তখন ক্ৰোধাবিষ্ট ও জিগীষাপরবশ হইয়া তাঁহার প্রতি শরপ্রয়োগ করিতে লাগিলাম। তিনি সেই সরলগামী [সোজাভাবে গতিশীল] শরজাল উপস্থিত হইতে না হইতেই তিন তিন বাণদ্বারা তাহার এক একটি ছেদন করিলেন।
যুদ্ধদৰ্শনভীত অম্বা ও অকৃতব্ৰণের পলায়ন
“অনন্তর আমি তাঁহাকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত অন্তকোপম [যমসদৃশ] অতি প্ৰদীপ্ত এক বাণ প্রয়োগ করিলাম। তিনি তদ্বারা অভিহিত ও তাহার প্রবলবেগের বশবর্ত্তী হইয়া অন্তরীক্ষচ্যুত দিবাকরের ন্যায় ভূতলে নিপতিত ও মুর্চ্ছিত হইলেন। তদ্দর্শনে পৃথিবীস্থ সমস্ত লোক উদ্বিগ্ন হইয়া হাহাকার করিতে লাগিল। অনন্তর তপোধনগণ ও কাশিরাজের দুহিতা অম্বা নিতান্ত উদ্বিগ্ন হইয়া অবিলম্বে তথা হইতে পলায়ন করিলেন। তখন আমি পরশুরামকে আলিঙ্গন করিয়া সশ্রদ্ধ সান্ত্বনাপ্রয়োগপূর্ব্বক সুশীতল পাণিতলদ্বারা আশ্বাসিত করিতে লাগিলাম। তিনি উত্থিত হইয়া শরাসনে শরসন্ধানপূর্ব্বক [ধনুকে বাণ যোজনা করিয়া] অপরিস্ফুটবাক্যে [বাণব্যথাহেতু অস্পষ্ট বাক্যে] আমাকে কহিলেন, “হে ভীষ্ম! তুমি নিহত হইয়াছ মনে কর।” এই বলিয়া তিনি বাণ পরিত্যাগ করিলে উহা আমার বামভাগে নিপতিত হইল। আমি বৃক্ষের ন্যায় বিঘূর্ণিত হইয়া নিতান্ত ব্যাকুল হইলাম। অনন্তর জামদগ্ন্য ক্রুদ্ধ হইয়া আমার অশ্বগণকে বিনাশ করিয়া আমার প্রতি অনবরত শরপ্রয়োগ করিতে লাগিলেন; আমিও সমরবারণ [প্রতিপক্ষবধে সমরের অবসানসাধক] অস্ত্ৰসকল বিসর্জ্জন করিতে লাগিলাম। ঐ সমস্ত শরজাল নভোমণ্ডল আচ্ছন্ন করিয়া আমার ও তাঁহার অন্তরে [উভয়ের মধ্যস্থল] অবস্থান করিতে লাগিল। দিবাকর শরজালসংবৃত হইয়া আর উত্তরপ্রদানে সমর্থ হইলেন না। সমীরণ যেন জলধরদ্বারা অবরুদ্ধ হইয়া উঠিল।
“অনস্তর বায়ুর প্রকম্প, সূৰ্য্যের কিরণ ও শরজালের অভিঘাতে অগ্নি সমুত্থিত হইতে লাগিল; তাহাতে নভোমণ্ডলস্থিত শরসমুদয় ভস্মীভূত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। পরে রাম ক্ৰোধাবিষ্ট হইয়া আমার প্রতি অনবরত লক্ষ-লক্ষ [*লক্ষ হইতে নিখৰ্ব পৰ্য্যন্ত সংখ্যাগুলি অসংখ্যোয়তাবাচক; পরশুরামপ্রযুক্ত অসংখ্য শরসমূহের সংখ্যায় সীমানির্দ্দেশ করা তৎকালে অসম্ভব হইয়াছিল], কোটিকোটি, অযুত-অযুত, অর্বুদ-অর্বুদ, নিখৰ্ব-নিখৰ্ব [*] শর বর্ষণ করিতে লাগিলেন; আমিও আশীবিষসদৃশ শরজালদ্বারা তৎসমুদয় খণ্ড খণ্ড করিয়া শৈলের ন্যায়। ভূতলে নিপতিত করিতে লাগিলাম। হে রাজন! এইরূপে আমাদের ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল। অনন্তর নিশাকাল সমুপস্থিত হইলে ভগবান্ জামদগ্ন্য সংগ্রাম হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন।”