১৭শ অধ্যায়
গান্ধারীর দুৰ্য্যোধনদর্শন—শোকোচ্ছ্বাস
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! তখন গান্ধারী দুর্য্যোধনকে দেখিবামাত্র শোকে মূর্চ্ছিত হইয়া ছিন্নমূল কদলীর ন্যায় সহসা ভূতলে নিপতিত হইলেন এবং অনতিবিলম্বেই সংজ্ঞালাভ করিয়া রুধিরাক্তকলেবর সেই রণশয্যায় শয়ান কুরুরাজকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক ‘হা পুত্র! হা পুত্র!’ বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করিতে লাগিলেন। তাঁহার নেত্রজলে দুর্য্যোধনের হারবিভূষিত বিপুল বক্ষঃস্থল অভিষিক্ত হইল। অনন্তর গান্ধাররাজতনয়া সমীপবর্তী হৃষীকেশকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “কেশব! এই জ্ঞাতি বিনাশক ঘোর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইবার সময় দুর্য্যোধন কৃতাঞ্জলিপুটে আমাকে জয়াশীর্বাদ করিতে কহিলে আমি আপনার বিপদ উপস্থিত হইয়াছে বুঝিতে পারিয়া কহিয়াছিলাম, ‘বৎস! যেখানে ধর্ম্ম, সেই স্থানেই জয়। তুমি যখন যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হইতেছ না, তখন নিশ্চয়ই দেবতার ন্যায় স্বর্গলোক প্রাপ্ত হইবে।’ হে মাধব! পূর্বে আমি এই কথা কহিবার সময় পুত্র নিহত হইবে বলিয়া কিছুমাত্র শোক প্রকাশ করি নাই; কিন্তু এক্ষণে বন্ধুবান্ধববিহীন রাজা ধৃতরাষ্ট্রের নিমিত্ত নিতান্ত শোকার্ত্ত হইতেছি। ঐ দেখ, অস্ত্রশস্ত্রবিশারদ যুদ্ধদুর্ম্মদ দুৰ্য্যোধন বীরশয্যায় শয়ান রহিয়াছে। হায়! কালের কি আশ্চর্য্য গতি! যে দুৰ্য্যোধন ক্ষত্রিয়গণের অগ্রগণ্য ছিল, আজ তাহাকে ধূলিশয্যায় শয়ন করিতে হইল। যাহা হউক, ঐ বীর যখন বীরজনোচিত শয্যায় শয়ন করিয়াছে, তখন উহার সুদুর্ল্লভ স্বর্গলোক লাভ হইয়াছে, সন্দেহ নাই। আহা! পূর্বে রমণীগণ যাহার চতুর্দ্দিকে উপবেশন করিয়া ক্রীড়া করিত, এক্ষণে অশিব[অমঙ্গল]জনক শিরা[শৃগাল]গণ তাহার চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া আমোদ করিতেছে। পণ্ডিতগণ যাহার সমীপে সতত সমুপস্থিত থাকিতেন, এক্ষণে গৃধ্রসকল তাহার সমীপে উপবিষ্ট রহিয়াছে। পূর্বে অবলাগণ যাহাকে উৎকৃষ্ট ব্যজনদ্বারা বীজন করিত, আজ পক্ষীগণ তাহাকে পক্ষদ্বারা বীজন করিতেছে। ঐ দেখ, মহাবলপরাক্রান্ত দুর্য্যোধন ভীমসেনের গদাপ্রহারে নিহত হইয়া সিংহনিপাতিত মাতঙ্গের ন্যায় রুধিরাক্তকলেবরে ভূতলে শয়ান রহিয়াছে। যে বীর সমরাঙ্গনে একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা সমানীত করিয়াছিল, যে ত্রয়োদশ বৎসর নিষ্কণ্টকে রাজ্যভোগ করিয়াছিল, আজ সেই মহাধনুর্দ্বরকে স্বীয় দুর্নীতিনিবন্ধন ধরাশয্যা গ্রহণ করিতে হইল। হতভাগ্য দুৰ্য্যোধন মহামতি বিদুর, অন্ধ পিতা ও বৃদ্ধদিগকে অপমান করিয়াই কালগ্রাসে নিপতিত হইয়াছে। হে কৃষ্ণ! পূর্বে এই পৃথিবীকে দুৰ্য্যোধনের শাসনবৰ্ত্তী হস্তী, গো ও অশ্বে পরিপূর্ণ দেখিয়াছি; কিন্তু এক্ষণে ইহাকে অন্যের হস্তগত ও শূন্য প্রায় দেখিতে হইল; অতএব আর আমার জীবনে প্রয়োজন কি? এক্ষণে অবলাগণকে মৃত বীরপুরুষদিগের নিকট গমন ও বিলাপ করিতে দেখিয়া আমার যারপরনাই কষ্ট হইতেছে। ঐ দেখ, দীর্ঘকেশী, বিপুলনিতম্বা, স্বর্ণবেদীসদৃশ লক্ষ্মণের গর্ভধারিণী দুর্য্যোধনের ক্রোড়ে শয়ন করিয়াছে। ঐ বরবর্তিনী পূর্বে দুর্য্যোধনের জীবিতাবস্থায় উহার বাহুযুগল অবলম্বন করিয়া ক্রীড়া করিত। হায়! আজ পুত্রসমবেত দুৰ্য্যোধনকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া আমার হৃদয় কেন শতধা বিদীর্ণ হইতেছে না? ঐ দেখ, লক্ষ্মণমাতা রুধিরাক্তকলেবর স্বীয় পুত্রের মস্তকাঘ্রাণ ও দুর্য্যোধনের দেহ পরিমার্জন করিতেছে এবং কখন পতির ও কখন পুত্রের নিমিত্ত শোকে অধীর হইতেছে। ঐ দেখ, ঐ নিতম্বিনী কখন স্বীয় মস্তকে করাঘাত করিয়া দুর্য্যোধনের বক্ষস্থলে নিপতিত হইতেছে এবং পতিপুত্রের মুখপদ্ম পরিমার্জিত করিতেছে। হে বাসুদের! যদি বেদ ও শাস্ত্ৰসমুদয় সত্য হয়, তাহা হইলে আমার পুত্র যে স্বর্গলোকে গমন করিয়াছে, তাহার আর সন্দেহ নাই।”