১৭৯তম অধ্যায়
শাপগ্ৰস্ত অজগরের আত্মপরিচয়-প্ৰকাশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে অবনীনাথ! তেজস্বিগণাগ্রগণ্য ভীমসেন এইরূপে সেই অজগরের বশীভূত হইয়া তাহার অদ্ভুত বীৰ্য্যের বিষয় চিন্তা করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে ভুজগেন্দ্ৰ! তুমি কে? আর আমাকে লইয়াই বা কি করিবে? অনুগ্রহ করিয়া বল। আমি পাণ্ডুতনয়, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের দ্বিতীয় ভ্রাতা, আমার নাম ভীমসেন। আমি অযুতনাগসমবলশালী, অতএব তুমি কিরূপে আমাকে বশীভূত করিলে? আমি অনেকানেক সিংহ, ব্যাঘ্ৰ, মহিষ ও বারণ সংহার করিয়াছি, মহাবলপরাক্রান্ত রাক্ষস, পিশাচ ও পন্নগগণ আমার বাহুবল সহ্য করিতে সমর্থ হয় না, কিন্তু তুমি আমাকে অনায়াসে আক্রমণ করিয়াছ। হে পন্নগবর! এ কি তোমার বিদ্যাবল অথবা বরপ্রভাব? দেখ, আমি সাতিশয় যত্নসহকারেও তোমার নিকট হইতে বিমুক্ত হইতে পারিতেছি না। তুমি অনায়াসেই আমার অসামান্য বলবিক্রম বিনষ্ট করিলে। এখন বিলক্ষণ বোধ করিলাম, মানবগণের বলবিক্রম সকলই বৃথা।”
অক্লিষ্টকর্ম্মা ভীমসেন এইরূপ কহিলে অজগর স্বীয় শরীরদ্বারা তাঁহার সমুদয় শরীর বেষ্টনপূর্ব্বক কেবল বাহুদ্বয়মাত্র পরিত্যাগ করিয়া কহিতে লাগিল, “হে মহাভূজ! আমি নিতান্ত ক্ষুধিত, দেবগণ অদ্য তোমাকেই আমার ভক্ষ্য নিরূপিত করিয়াছেন। দেহিগণের প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় আর কিছুই নাই; অদ্য বহুকালের পর তোমাকে প্রাপ্ত হইয়াছি, কদাচ পরিত্যাগ করিব না। হে শত্রুনিপাতন! আমি যে নিমিত্ত সৰ্পযোনিপ্রাপ্ত ও মহর্ষিগণের কোপে যেরূপে শাপগ্ৰস্ত হইয়াছি এবং যেরূপে আমার শাপান্ত নিৰ্দ্ধারিত হইয়াছে, তাহা সবিশেষ কহিতেছি, শ্রবণ কর। তোমাদের বংশে সমুদ্ভূত আয়ুনামা নৃপবরের বংশধর পুত্ৰ নহুষভূপতির নাম অবশ্যই তোমার কর্ণগোচর হইয়া থাকিবে। আমি সেই নহুষ; ব্রাহ্মণগণের অবমাননা নিবন্ধন মহর্ষি অগস্ত্যের শাপে এই দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়াছি। হায়! আমার কি দুৰ্দৈব! দেখ, তুমি আমার অবধ্য দায়াদ, আজ তোমাকেও ভক্ষণ করিতে হইল! কি করি? আমার প্রতি এইরূপ নিয়ম নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। হে নরোত্তম! কি গজ, কি মহিষ, যে জন্তু হউক, দিবসের ষষ্ঠভাগে মৎকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইলে কোনক্রমেই মুক্ত হইতে সমর্থ হয় না। তুমি তিৰ্য্যাগ্যোনিগত সৰ্পের নিকট পরাভূত হইয়াছ মনে করিয়া লজ্জিত হইও না, ব্রাহ্মণপ্রদত্ত বরপ্রভাবেই আমাকর্ত্তৃক তোমার বীৰ্য্যহানি হইয়াছে। আমি বিমানোপারস্থিত শক্রিাসন হইতে নিপতিত হইবার সময় অতি দীনবচনে মহর্ষিকে শাপান্ত করিতে অনুরোধ করিয়াছিলাম। তিনি আমার কাতরোক্তি-শ্রবণে কারুণ্যরসপরতন্ত্র হইয়া কহিলেন, “রাজন! তুমি কিয়দ্দিন পরে শাপ হইতে মুক্ত হইবে।” অনন্তর ভূমিতলে নিপতিত হইলাম, কিন্তু আমার স্মৃতির কিছুমাত্ৰ বৈলক্ষণ্য হইল না, অদ্যাপি আমার স্মৃতি পূর্ব্বের ন্যায় বিলক্ষণ বলবতী রহিয়াছে।
“হে মনুজশ্রেষ্ঠ! তৎপরে মহর্ষি অগস্ত্য কহিলেন, ‘হে রাজন! যে ব্যক্তি তোমার প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হইবে, সেই তোমাকে শাপ হইতে বিমুক্ত করিবে।’ তখন অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ আমার প্রতি সদয় হইয়া কহিলেন, ‘হে রাজন! তুমি অতি বলবান জন্তুকে আক্রমণ করিলেও তৎক্ষণাৎ তাহার সত্ত্বভ্রংশ হইবে।’ হে বীরবর! আমি এই স্থানে থাকিয়াই সেই সমুদয় অনুকম্পাপরতন্ত্র ব্রাহ্মণগণের বাক্য শ্রবণ করিলাম। অনন্তর তাঁহারা সকলেই অন্তর্হিত হইলেন।
“আমি তদবধি এই সপযোনিপ্রাপ্তিরূপ অপবিত্র নরকে নিমগ্ন হইয়া কালপ্রতীক্ষাপূর্ব্বক জীবনযাপন করিতেছি।”
আত্মজীবনে হতাশ ভীমের বিলাপ
তখন মহাবাহু ভমিসেন ভুজঙ্গকে কহিতে লাগিলেন, “হে মহাসর্প! আমি ক্ৰোধ বা আত্মনিন্দা করিতেছি না, কারণ মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করিলে অবশ্য সুখ ও দুঃখ ভোগ করিতে হয়, অতএব সুখনাশ ও দুঃখাগমে একান্ত অবসন্ন হওয়া নিতান্ত অনুচিত। কোন ব্যক্তি পুরুষকারপ্রভাবে দৈব নিবারণ করিতে সমর্থ হয়। দৈবই সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, পুরুষাৰ্থ নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। দেখ, আমি দৈবপ্রভাবেই স্বীয় ভুজবলে বঞ্চিত হইয়া এই দুরবস্থগ্ৰস্ত হইয়াছি, কিন্তু তন্নিমিত্ত অণুমাত্ৰও পরিতাপ করিতেছি না; কেবল রাজ্যবিচ্যুত ভ্রাতৃগণের নিমিত্ত সতত পরিতপ্ত হইতেছি। হায়! তাঁহারা নিশ্চয়ই আমার অন্বেষণার্থ বিহ্বচিত্তে যক্ষরাক্ষসসঙ্কুল দুৰ্গম হিমাচলের চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইবেন এবং পরিশেষে আমি বিনষ্ট হইয়াছি, এই বোধে নিতান্ত উদ্যমশূন্য হইয়া পরিদেবন করিবেন। হায়! তাঁহারা একান্ত ধর্ম্মপরায়ণ। কেবল আমিই রাজ্যলোভপরতন্ত্র হইয়া তাঁহাদিগকে প্রোৎসাহিত করিয়া রাখিয়াছি। অথবা ধীমান ধনঞ্জয় আমার বিনাশে বিষণ্ন হইবেন না। তিনি সর্ব্বাস্ত্রবেত্তা; কি দেব, কি গন্ধর্ব্ব, কি রাক্ষস, কেহই তাঁহাকে পরাভূত করিতে সমর্থ হয় না। কপটদ্যূতকারী দম্ভপরায়ণ দুৰ্য্যোধনের কথা দূরে থাকুক, সেই মহাবলপরাক্রান্ত বীরপুরুষ একাকী দেবরাজকেও স্থানভ্রষ্ট করিতে পারেন।
“হায়! আমি সেই পুত্রবৎসলা জননীর নিমিত্ত নিতান্ত পরিতাপপ্রাপ্ত হইতেছি। তিনি প্রত্যহ আমাদিগকে “সকলের শ্রেষ্ঠ হও” বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিয়া থাকেন। হে ভুজঙ্গম! আমার বিনাশে তাঁহার সেই চিরসঞ্চিত মনোরথ-সকল এককালে নিৰ্ম্মফল হইবে। হা! নকুল ও সহদেব গুরুজনের নির্দেশাবর্ত্তী। তাহারা আমার বাহুবলে রক্ষিত হইয়াই পুরুষাভিমান করে। আমার বিনাশ হইলে নিশ্চয়ই তাঁহারা উৎসাহশূন্য, হীনবীৰ্য্য ও পরাক্রমহীন হইবে।” মহাত্মা বৃকোদর এইরূপে সংরুদ্ধ-কলেবর ও নিশ্চেষ্ট হইয়া বহুবিধ বিলাপ করিলেন।
বিবিধ অমঙ্গলচিহ্ন দর্শনে উদ্বিগ্ন যুধিষ্ঠিরের ভীমান্বেষণ
এদিকে ধর্ম্মানন্দন যুধিষ্ঠির নানাবিধ অনিষ্টজনক উৎপাতদর্শনে সাতিশয় অসুস্থচিত্ত হইলেন। শৃগালগণ আশ্রমের দক্ষিণদিকে বিত্ৰস্তচিত্তে সূৰ্য্যাভিমান অশিবধ্বনি করিতে লাগিল। একপক্ষা, একনেত্ৰা, একচারণা, মলিনা, ঘোরদশনা বর্ত্তিকা [পক্ষিবিশেষ] আদিত্যাভিমুখে রক্তবমন করিতে লাগিল। প্রচণ্ড রুক্ষ সমীরণের বেগে বালুকা উড্ডীয়মান হইয়া গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন করিল। দক্ষিণভাগে মৃগ ও পক্ষিগণ নিনাদ করিতে লাগিল। পশ্চাদ্ভাগে কৃষ্ণ বায়স “যাও যাও” করিয়া ধ্বনি করিতে আরম্ভ করিল। তাঁহার দক্ষিণবাহু ও বামচক্ষু মুহুর্মুহু স্পন্দিত, চিত্ত চঞ্চল ও বারংবার পদস্থলন হইতে লাগিল।
ধীমান ধর্ম্মরাজ এই সমুদয় দুর্লক্ষণ-নিরীক্ষণে ভীত হইয়া দ্রৌপদীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “পঞ্চালি! ভীমসেন কোথায়?” তিনি কহিলেন, “মহারাজ! ভীমসেন বহুক্ষণ হইল কোন স্থানে গিয়াছেন, কিছুই জানি না।”
তখন মহাত্মা যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনকে দ্রৌপদীরক্ষণে নিয়োগ এবং নকুল-সহদেবকে ব্রাহ্মণগণের হস্তে সমর্পণ করিয়া অনতিবিলম্বেই ধৌম্য-সমভিব্যাহারে ভীমসেনের অন্বেষণে গমন করিলেন। অনন্তর সেই আশ্রম হইতে বহির্গত হইয়া ভীমসেনের চরণচিহ্ন নিরীক্ষণপূর্ব্বক তাঁহার অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইলেন। মহাত্মা ধর্ম্মনন্দন ক্রমে ক্রমে পূর্ব্বদিকে গমন কিরয়া ভীমসেনের অন্যান্য নানাবিধ চিহ্ন অবলোকন করিলেন। বনমধ্যে অনেক যূথপতি হন্তী, শত শত মৃগ ও মৃগেন্দ্রগণকে নিপতিত দেখিয়া বোধ করিলেন, বৃকোদর এই স্থান দিয়া গমন করিয়াছে।
মহারাজ যুধিষ্ঠির পথিমধ্যে মহাবীর বৃকোদরের গমনকালীন উরু-পবনবেগে ভগ্নদ্রুম-সমুদয় নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। এইরূপে ধর্ম্মাত্মা ধর্ম্মানন্দন ঐ সকল চিহ্ন অবলোকনপূর্ব্বক গমন করিয়া পরিশেষে রুক্ষ মারুত পরিপূর্ণ, নিষ্পত্ৰকণ্টকিতদ্রুমসঙ্কুল, জনশূন্য, সুদুৰ্গম গিরিগহ্বমধ্যে ভুজঙ্গভোগপরিবেষ্টিত নিশ্চেষ্ট স্বীয় অনুজকে অবলোকন করিলেন।