১৭৯তম অধ্যায়
ভীষ্ম-পরশুরামের প্রথম দিনের যুদ্ধ
“ভীষ্ম কহিলেন, “হে রাজন! অনন্তর আমি সমরাভিলাষী পরশুরামকে সহাস্যমুখে কহিলাম, “ভগবন! আমি রথে আরূঢ় আছি; আপনি ভূতলে অবস্থান করিতেছেন; সুতরাং এক্ষণে আপনার সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইতে আমার উৎসাহ হইতেছে না। আপনি যদি যুদ্ধে অভিলাষী হয়েন, তাহা হইলে রথারোহণ ও কবচ ধারণ করুন।” তখন তিনি আমাকে সহাস্য-আস্যে [হাস্যযুক্ত মুখে] কহিলেন, “হে ভীষ্ম! মেদিনী আমার রথ, চারি বেদ আমার অশ্ব, বায়ু আমার সারথি ও বেদমাতা গায়ত্রী আমার বর্ম্ম; আমি তদ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইব।” এই কথা বলিয়া মহাতেজাঃ জামদগ্ন্য শরজালদ্বারা চতুর্দ্দিক আচ্ছন্ন করিলেন।
“অনন্তর দেখিলাম, তিনি অদ্ভুতদৰ্শন মনঃকল্পিত অতি বিস্তীর্ণ নগরোপম, দিব্যাশ্মযোজিত [উত্তম অশ্বে বাহিত], আয়ুধ ও কবচে পরিপূর্ণ, সুবৰ্ণালঙ্কৃত ও চন্দ্ৰসূৰ্য্যলাঞ্ছিত [চন্দ্ৰসূৰ্য্যাঙ্কিত চিহ্নে চিহ্নিত], দিব্যরথে আরোহণ করিয়া রহিয়াছেন। তাঁহার প্রিয়সখা অকৃতব্ৰণ ধনুর্ধারণ এবং অঙ্গুলিত্র [দস্তানা] ও তূণীর [বাণ রাখিবার চৰ্ম্মাদিনির্মিত তূণাধার] বন্ধন করিয়া তাহার সারথ্যে [সারথির কাৰ্য্যে] নিযুক্ত আছেন। তখন জামদগ্ন্য ‘এস’ বলিয়া আমাকে যুদ্ধার্থ আহ্বান করিয়া বারংবার আক্ৰোশ করিতে লাগিলেন। আমি তদ্দর্শনে নিতান্ত সন্তুষ্ট হইয়া মহাবলপরাক্রান্ত, ক্ষত্ৰিয়ান্তকারী, দিবাকরতুল্য তেজস্বী পরশুরামের সন্নিধানে একাকী গমনপূর্ব্বক তিনটি বাণদ্বারা তাঁহার অশ্বগণকে নিগৃহীত [নিপীড়িত] করিয়া, রথ হইতে অবতীর্ণ হইলাম এবং শরাসন পরিত্যাগ করিয়া অর্চ্চনা করিবার নিমিত্ত পদব্রজে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া যথাবিধি অভিবাদনপূর্ব্বক কহিলাম, “ভগবন! আপনি আমার তূল্য ও আমা অপেক্ষা সমধিক বলশালী হইলেও আমি আপনার সহিত যুদ্ধ করিব। এক্ষণে আশীর্ব্বাদ করুন, যেন আমারই জয়লাভ [প্রবল প্রতিপক্ষ পরশুরামের নিকট জয়াশীর্ব্বাদ প্রার্থনা তাঁহাকে পরাজিত করিবার এক প্রকৃষ্ট পথ। যুদ্ধে পরাজয় বা পশ্চাৎপদ ক্ষত্রিয়ের বিশেষতঃ ভীষ্মের পক্ষে অকীৰ্তিকর; ব্রাহ্মণ পরশুরামের নিকট জয়াশীর্ব্বাদ যাচ্ঞায় সে দোষ নাই; তাই তাঁহার এই অপূর্ব্ব কৌশল। মধুকৈটভবধে বিষ্ণুও এ কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলেন। ব্ৰাহ্মাণভক্ত ভীষ্ম বিপ্ৰদেহ বিশেষতঃ গুরুর গাত্রে বাণবিদ্ধ করিবেন না, বাণবধে ব্যতীত যুদ্ধজয়ই বা হয় কিরূপে? সুতরাং প্রতিপক্ষ পরশুরামের নিকট আশীর্ব্বাদ প্রার্থনার ইহাও অন্যতম কারণ।] হয়।”
‘পরশুরাম কহিলেন, “হে মহাবাহো! যে ব্যক্তি সম্পত্তিলাভের অভিলাষ করে, তাহার এইরূপ অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য এবং যাহারা উৎকৃষ্ট লোকের সহিত সংগ্রাম করে, তাহাদিগের ইহাই ধৰ্ম। তুমি যদি এইরূপে আমার নিকট আগমন না করিতে, তাহা হইলে আমি তোমাকে অবশ্যই শাপ প্ৰদান করিতাম। এক্ষণে ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিয়া যত্নপূর্ব্বক সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। আমি তোমার জয় প্রার্থনা করি না; প্রত্যুত আমি তোমাকে পরাজিত করিবার নিমিত্তই উপস্থিত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি গমন করিয়া ধর্ম্মানুসারে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। আমি তোমার আচরণে প্রীতি লাভ করিয়াছি।”
“তখন আমি তাহাকে নমস্কার করিয়া সত্বর রথে আরোহণপূর্ব্বক পুনরায় শঙ্খধ্বনি করিলাম। অনন্তর পরস্পর জিগীষাপরবশ [জয়াভিলাষে একান্ত আগ্ৰহান্বিত] হইয়া বহু দিবস যুদ্ধ করিলাম। জমদগ্ন্য প্রথমতঃ আমাকে আনতপর্ব্ব [নতসন্ধিস্থল] ষষ্ট্যধিক নবশত [পক্ষযুক্ত ৯ শত ৬৩টি] শরদ্বারা প্রহার করিলেন; তদ্বারা আমার চারিটি অশ্ব ও সারথি প্রতিরুদ্ধ [গতিহীন] হইল; কিন্তু আমি পূর্ব্ববৎ অবস্থান করিতে লাগিলাম। পরে আমি দেবতা ও ব্রাহ্মণগণকে নমস্কার করিয়া সহাস্যমুখে তাহাকে কহিলাম, “ভগবন! আপনি মৰ্য্যাদাশূন্য [অভিমানশূন্য] হইলেও আমি আপনাকে গুরু স্বীকার করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু এক্ষণে আমার ধর্ম্মানুগত বাক্য শ্রবণ করুন। আপনার শরীরমধ্যে যেসমস্ত বেদ ও ব্ৰহ্মতেজ আছে এবং আপনি যে সুমহৎ তপানুষ্ঠান করিয়াছেন, আমি তাহাতে আঘাত করিব না। শস্ত্ৰ উদ্যত করিলেই ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্ৰিয়ত্বপ্রাপ্ত হইয়া থাকেন; অতএব আপনি যে ক্ষত্রিয়তেজ পরিগ্রহ করিয়াছেন, আমি তাহাকেই প্রহার করিব। এক্ষণে আপনি আমার শরাসনের বল ও বাহুবীৰ্য্য নিরীক্ষণ করুন। আমি এখন সুতীক্ষ্ণ শরদ্বারা আপনার কামুক ছেদন করিব।” আমি এই বলিয়া এক নিশিত ভল্ল নিক্ষেপ করিয়া তাঁহার কামুককোটি [ধনুকের ছিলা] ছেদনপূর্ব্বক ভূতলে নিপাতিত করিলাম।
“অনন্তর আমি তাঁহার রথ লক্ষ্য করিয়া সন্নতপর্ব্ব [ঈষৎ নতসন্ধি] শরশত [একশত বাণ] প্রয়োগ করিলে বায়ুপ্রেরিত [বায়ুবেগে চালিত] ঐ শরজাল ঐ শরজাল [বাণসমূহ] তাঁহার শরীরে বিদ্ধ হইয়া রুধিরাক্ষরণ [রক্তমোক্ষণ] করিয়া ভীষণ ভুজঙ্গের ন্যায় সঞ্চারণ করিতে লাগিল। তখন শোণিতলিপ্তকলেবর [রক্তমাখা দেহ] মহাতেজঃ পরশুরাম ধাতুস্ৰাবী [নির্গলিত ধাতু] মেরুর ন্যায়, হেমন্তের অবসানে রক্তস্তবকমণ্ডিত [লোহিতবর্ণ গুচ্ছশোভিত] অশোকের ন্যায় ও কুসুমশোভিত কিংশুকের [পলাশের] ন্যায় অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিলেন।
“অনন্তর তিনি ক্ৰোধপরায়ণ হইয়া অন্য কামুক গ্রহণপূর্ব্বক হেমপুঙ্খ [সোণার পাখা] পরিশোভিত নিশিত শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। সেইসকল সর্প, অনল ও বিষ তুল্য, মহাবেগসম্পন্ন, মৰ্মভেদী ভয়ঙ্কর শরজাল আমাকে কম্পিত করিল। অনন্তর আমি আপনাকে [নিজেকে] প্রকৃতিস্থ [সুস্থ] করিয়া ক্ৰোধাভরে শরশতদ্বারা পরশুরামকে প্রহার করিলে তিনি আশীবিষসদৃশ সূৰ্য্যাগ্নিসঙ্কাশ [সূৰ্য্য ও অগ্নির ন্যায় দীপ্তিশালী]। সেই শরশতদ্বারা নিতান্ত পীড়িত হইয়া হতবুদ্ধি [অচৈতন্য] হইলেন। আমি তখন রোষ পরিত্যাগপূর্ব্বক কৃপাবশে [দয়ায় বাধ্য] ও শোকাবেগে একান্ত অধীর হইয়া কহিলাম, ‘যুদ্ধে ও ক্ষত্রিয়ধর্মে ধিক! আমি ক্ষত্ৰিয়ধর্ম্মপ্রভাবে ধর্ম্মাত্মা ব্ৰাহ্মণ গুরুকে শরপ্ৰহারে নিপীড়িত করিয়া সাতিশয় পাপানুষ্ঠান করিয়াছি।’ তদবধি আমি তাহাকে আর প্রহার করিলাম না। অনন্তর ভগবান মরীচিমালী [সূৰ্য্য] পৃথিবী পরিতপ্ত করিয়া অস্তাচলচুড়াবলম্বী [অস্তমিত] হইলেন।”