১৭৮. পরাশর-জন্মকথা, ভার্গবগণের প্রতি ক্ষত্রিয়ের ক্রোধ
অষ্টসপ্তত্যধিকশততম অধ্যায়।
গন্ধর্বরাজ কহিলেন, হে অর্জুন! অনন্তর অদৃশ্যন্তী ভর্তৃসদৃশ এক বংশধর কুমার প্রসব করিলেন। ভগবান্ বশিষ্ঠদেব জাতমাত্রেই পৌত্রের জাতকর্মাদি ক্রিয়াকলাপ নির্বাহ করিয়া তাঁহার নাম পরাশর রাখিলেন। শক্তি নন্দন পরাশর মহর্ষি বশিষ্ঠকেই পিতা বলিয়া জানিতেন এবং জন্মাবধি তাহাকেই পিতার ন্যায় অনুসরণ করিতেন। ক্রমশঃ তিনি জননী অদৃশ্যম্ভীর সন্নিধানে বিপ্রর্ষি বশিষ্ঠকে তাত বলিয়া আহ্বান করিতে লাগিলেন। তখন অদৃশ্যন্তী পুত্রের এইরূপ মধুরগর্ভ বাগ্বিন্যাস শ্রবণে অশ্রুপূর্ণলোচনে কহিলেন, বৎস! বনমধ্যে এক রাক্ষস তোমার পিতাকে ভক্ষণ করিয়াছে; অতএব এক্ষণে পিতামহকে পিতৃবাক্যে সম্বোধন করিও না। তুমি যাহাকে পিতা বলিয়া সম্বোধন কর, তিনি তোমার পিতামহ, পিতা নহেন।
অনন্তর শক্ত্রিতনয় জননী অদৃশ্যন্তী কর্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া অতিশয় দুঃখিতমনে সর্বলোকবিনাশে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ তদ্বিসয়ে তাহাকে কৃতনিশ্চয় দেখিয়া প্রতিষেধবাক্যে কহিলেন, বৎস! পূর্বকালে কৃতীয় নামে এক সুবিখ্যাত রাজা ছিলেন। তিনি বেদবো মহাত্মা ভাগবদিগের যজমান। রাজা যজ্ঞান্তে সোম পান করিয়া প্রভূত ধনধান্যদ্বারা তাহাদিগের তৃপ্তি সাধন করিতেন। তিনি লোকান্তর প্রস্থান করিলে তদ্বংশীয় নৃপতিদিগের কোন বিশেষ প্রয়োজনার্থ অর্থের আবশ্যকতা হইয়াছিল। অনন্তর তাহারা ভার্গবদিগের অর্থের আতিশয্য জানিয়া তাহাদিগের নিকটে অর্থিভাবে উপস্থিত হইলেন। তখন ভার্গবগণ কেহ কেহ ক্ষত্রিয়ভয়ে সমস্ত অক্ষয় ধনসম্পত্তি ভূগর্ভে নিক্ষিপ্ত, কেহ বা ব্রাহ্মণসাৎ করিলেন। কেহ কেহ উপস্থিত অথীদিগের প্রার্থনানুসারে অর্থ দান করিলেন। এই অবসরে কোন এক ক্ষত্রিয় স্বেচ্ছাক্রমে ভূমি খনন করিয়া ভৃগুগৃহে প্রভূত বিত্ত প্রাপ্ত হইলেন। তখন ক্ষত্রিয়ের সকলে সমবেত হইয়া সেই উৎখাত ধন নিরীক্ষণ করিলেন। তদ্দর্শনে ভাবের। ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ক্ষত্রিয়দিগকে যথোচিত অবমাননা করিলেন। ক্ষত্রিয়েরা অপমানিত হইয়া সুতীক্ষ্ণ শর প্রহারে ভার্গবদিগের শিরচ্ছেদ ও তৎপত্নীগৰ্ভস্থিত আর্ভকদিগের প্রাণসংহারপূর্বক পৃথিবী পৰ্যটন করিতে লাগিলেন। ভৃগুনন্দনের উচ্ছিন্ন হইলে তাঁহাদিগের পত্নীগণ ক্ষত্রিয়ভয়ে একান্ত ভীত হইয়া হিমাচলে পলায়ন করিলেন। তন্মধ্যে কোন মহিলা ভর্তৃকুলবৃদ্ধির নিমিত্ত সভয়ে ঊরুদেশে অতি প্রদীপ্ত এক গর্ভ ধারণ করিয়াছিলেন। এই গৰ্ভসম্বাদ অবগত হইয়া অনতিবিলম্বে এক ব্রাহ্মণী ভীতমনে নির্জনে ক্ষত্রিয়সন্নিধানে গিয়া ইহা নিবেদন করিল। ক্ষত্রিয়েরা গর্ভনাশে কৃতসঙ্কল্প হইয়া তথায় আগমন পূর্বক দেখিলেন, ব্রাহ্মণী স্বতেজঃপ্রভাবে দীপ্যমান রহিয়াছেন। এই অবসরে গর্ভস্থ বালক ব্রাহ্মণীর ঊরুদেশ বিদীর্ণ করিয়া নির্গত হইলেন। নির্গত হইবামাত্র মধ্যাহ্নসূর্যের ন্যায় তিনি ক্ষত্রিয়দিগের দৃশক্তি সংহার করিলেন। ক্ষত্রিয়গণ চক্ষুহীন ঐ গিরিদুর্গে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তৎপরে তাঁহারা হীনজ্যোতিঃ চক্ষুঃ লাভের প্রত্যাশায় সেই অনিন্দিতা ব্রাহ্মণীর শরণাগত হইয়া দুঃখিতমনে নিবেদন করিলেন, ভগবতি! আমরা অতি নরাধম, এক্ষণে প্রার্থনা এই যে, আমরা আপনার প্রসাদে অসং অধ্যবসায় হইতে নিরত হইয়া আপনার অনুকম্পায় পুনরায় চক্ষুঃলভিপূৰ্বক, প্রতিগমন করিতে পারি। হে শোভনে! আপনি পুত্রের সহিত প্রসন্ন হইয়া পুনর্বার দৃষ্টি প্রদানপূর্বক আমাদিগকে পরিত্রাণ করুন।