১৭৭. বিপাশা শতদ্রুপরিচিতি
সপ্তসপ্তত্যধিকশততম অধ্যায়
গন্ধর্বরাজ কহিলেন, হে অর্জুন! তৎপরে মহর্ষি বশিষ্ঠ পুত্রশূন্য আশ্রমপদ-দর্শনে সাতিশয় শোকাকুল হইয়া তথা হইতে পুনরায় নিষ্ক্রান্ত হইলেন। কতক দূর যাইয়া দেখিলেন, এক স্রোতস্বতী বর্ষাপ্রভাবে অতি বেগবতী ও বারিপূর্ণ হইয়া তীরস্থিত বহুবিধ বৃক্ষ উৎপাটন পূর্বক লইয়া যাইতেছে। তদর্শনে মহর্মি পুত্রশোকে অতীব দুঃখিতমনে চিন্তা করিলেন, আমি এই নদীজলে নিমগ্ন হইয়া প্রাণত্যাগ করিব। অনন্তর আপনাকে পাশদ্বার। দৃঢ়তর সংযত করিয়া নদাজলে নিমগ্ন হইলেন। নিমগ্ন হইবামাত্র মহানদী মহযির পাশচ্ছেদ করিয়া দিল এবং স্থলে উথাপিত করিল। মহমি পাশবিমুক্ত ও স্থলে উত্তীর্ণ হইয়া ঐ নদীর নাম বিপাশা রাখিলেন। অনন্তর ক্রমশঃ তাহার শোকবুদ্ধিই প্রবল হইতে লাগিল। তিনি একান্ত কাতরতাযুক্ত আর এক স্থানে অবস্থান করিতে না পারিয়া নদী, পৰ্বত ও সরোবরে পৰ্যটন করিতে লাগিলেন।
একদা প্রচণ্ডগ্রাহবতী হৈমবতী নামে এক স্রোতস্বতী দেখিয়া তাহার প্রবাহে ঝম্প প্রদান করিলেন। সরিদ্বরা ব্রাহ্মণকে অগ্নিসম বিবেচনা করিয়া শতধা বিদ্রুত হইল; এই কারণে তদবধি তাহার নাম শতদ্রু বলিয়া বিখ্যাত হইল। অনন্তর মহর্ষি আপনাকে স্থলগত ও অত্মসংহারে অকৃতকাৰ্য দেখিয়া পুনরায় অশ্রিমে আগমন করিতে লাগিলেন। বিবিধ পর্বত ও বহুবিধ দেশ পৰ্যটন পূর্বক তিনি অদৃশ্যীনম্নিী স্বীয় পুত্রবধূ কর্তৃক অনুসৃত হইয়া আশ্রমে প্রত্যাগমন করিলেন। পরে পশ্চাদ্ভাগে ষড়ঙ্গালঙ্কত পরিপূর্ণার্থ সুসঙ্গত বেদাধ্যয়নশব্দ শ্রবণ করিয়া কহিলেন, কে আমার অনুসরণ করিতেছে? তখন অদৃশ্যন্ত প্রত্যুত্তর করিলেন, হে মহাভাগ! আমি আপনকার শক্তির সহধর্মিণী তপস্বিনী অদৃশ্চন্তী। মহর্ষি কহিলেন, পুত্রি! পূর্বে শক্তির মুখে যেরূপ সাঙ্গবেদধ্বনি শ্রবণ করিয়াছিলাম, তদ্রূপ এই ষড়ঙ্গবেদ কে উচ্চারণ করিতেছে? অদৃশ্য ন্তী কহিলেন, আমার গর্ভে আপনার তনয় শক্তির এক পুত্র উৎপন্ন হইয়াছে, দ্বাদশ বৎসর হইল ঐ পুত্র গর্ভ মধ্যে বেদাধ্যয়ন করিতেছে।
গন্ধর্ব কহিলেন, মহর্ষি বশিষ্ঠ অদৃশ্যন্তী কর্তৃক এইরূপ অভিহিত হইলে হৃষ্টান্তঃকরণে সন্তান বর্তমান পরিজ্ঞাত হইয়া মরণেচ্ছ। হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। অনন্তর বধূ সমভিব্যাহারে প্রতিগমন পূর্বক এক নির্জন বনে রাজা কল্মাষপাদকে দৃষ্টিগোচর করিলেন। রাজা রাক্ষসাবেশ প্রভাবে মহর্ষিকে দেখিবামাত্র অতিমাত্র ক্রোধাবিষ্ট হইয়া গ্রাস করিবার অভিলামে সহসা উত্থিত হইলেন। তখন অদৃশ্যন্তী কূরকর্ম। রাক্ষসকে সম্মুখে দেখিয়া ভীতমনে মুনিসন্নিধানে গিয়া কহিলেন, ভগবন্! সাক্ষাৎ কালান্তক যমের ন্যায় এই বিকটাকার রাক্ষস দণ্ডকাষ্ঠ গ্রহণ পূর্বক আমাদিগের নিকট আগমন করিতেছে, এক্ষণে আপনি ব্যতীত উহাকে নিবারণ করিতে পারে, পৃথিবীতে এমন আর কেহই নাই। হে মহাভাগ! ঐ দারুণদর্শন পাপপরায়ণ রাক্ষস হইতে আমাকে পরিত্রাণ করুন। নিশ্চয়ই ও আমাদিগকে গ্রাস করিবার অভিলাষ করিতেছে। তখন মহর্ষি প্রত্যুত্তর করিলেন, হে পুত্রি! তুমি ভয় পাইও না। এই রাক্ষস হইতে কদাচ কোনরূপ জয়ের আশঙ্কা নাই। তুমি উপস্থিত ভয়কে রাক্ষসভয় বলিয়া বিশ্বাস করিও না। ভূমণ্ডলে মহাবল পরা ক্রান্ত ও সুবিখ্যাত কল্মাষপাদ নামে এক রাজা ছিলেন। তিনিই শক্তি শাপপ্রভাবে এই ভীষণ রাক্ষস হইয়া বনমধ্যে বাস করিতেছেন। এই বলিয়া তেজস্বী মহর্ষি হুঙ্কার পরিত্যাগপূর্বক সমীপন্থ রাক্ষসকে নিবারণ করিলেন। তৎপরে মন্ত্রপূত সলিলদ্বারা অভক্ষণ করিয়া যোগবলে তাঁহার শাপ মোচন করিয়া দিলেন। রাজা কল্মাষপাদ বশিষ্ঠতনয় শক্তির শাপে রাহু গ্ৰস্ত পার্বণ দিবাকরের ন্যায় নিস্তেজ হইয়াছিলেন। সম্প্রতি রাক্ষসাবেশ হইতে বিমুক্ত হইয়া সায়ংকালীন সৌরকিরণম্পর্শে মেঘমণ্ডলীর ন্যায় তেজঃপুঞ্জে সেই সমস্ত বনবিভাগ রঞ্জিত করিলেন। অনন্তর রাজা পূর্ববৎ সংজ্ঞালাভ করিয়া কৃতাঞ্জলি পুটে অভিবাদনপূর্বক অবসরমে ঋষিসত্তম বশিষ্ঠকে কহিলেন, হে মহাভাগ! আমি ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা, আমার নাম কল্মাষপাদ। আমি আপনকার যজমান, অতএব এক্ষণে আপনার যেরূপ অভিলাষ হয়, আদেশ করুন। বশিষ্ঠ প্রত্যুত্তর করিলেন, মহারাজ! ব্যক্তব্যের কাল অতীত হইয়াছে, এক্ষণে রাজধানীতে প্রতিগমনপূর্বক যথাবিধানে রাজ্যশাসন কর। কিন্তু আর কদাচ ব্রাহ্মণের অবমাননা করিও না। রাজা কহিলেন, হে তপোধন! আমি আর কদাচ ব্রাহ্মণকে অবমাননা করিব না; বরং আপনার নির্দেশানুসারে তাহাদিগকে সম্যক সৎকার করিব। হে বেদজ্ঞপ্রধান দ্বিজোত্তম! সম্প্রতি আমি যাহাতে ইক্ষ্বাকুবংশীয়দিগের নিকট অঋণী হই, আপনাকে এরূপ প্রতি বিধান করিতে হইবে। হে সাধে! আমি সন্তান অভিলাষ করি, ইক্ষ্বাকুদিগের বংশরক্ষাৰ্থ আপনাকে শতশীলসম্পন্ন একটি সুসন্তান প্রদান করিতে হইবে। তখন সত্যসন্ধ তপোধন ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাহার বাক্য স্বীকার করিলেন।
অনন্তর বশিষ্ঠদেব মহারাজ কল্মাষপাদের সহিত সুবিখ্যাত অযোধ্যা নগরীতে গমন করিলেন। নগর প্রবেশকালে যেমন দেবগণ দেবরাজ ইন্দ্রকে প্রত্যুদগমন করেন, প্রজাপুঞ্জ মহানন্দ সহকারে সেইরূপে সেই নিষ্পাপ রাজাকে প্রত্যুগমন করিতে লাগিল। রাজা বহুদিনের পর মহর্ষি বশিষ্ঠ সমভিব্যাহারে সেই পুণ্যলক্ষণা অযোধ্যা নগরীতে প্রবেশ করিলেন। অযযাধ্যাবাসী জনগণ পুরোহিতসহিত উদিত দিবাকরের ন্যায় মহীপালকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। অনন্তর শরৎকালীন শণধর যেমন নভোমণ্ডল উদ্ভাসিত করেন, রাজা সেইরূপে নিজ রাজধানী অযোধ্যার শোভা সম্পাদন করিলেন। সেই নগরী পতাকাপরিশোভিত, সুসংসিক্ত ও সুপরিচ্ছন্ন পথসংযুক্ত হইয়া সকলের আনন্দসঞ্চার করিতে লাগিল। তখন হৃষ্টপুষ্ট ও সন্তুষ্টজনাকীর্ণ অযোধ্যা; সুররাজবিরাজিত অমরাবতীর ন্যায় সুশোভিত হইল।
রাজা পুরপ্রবেশ করিলে রাজমহিষী ভর্তার আদেশানুসারে মহর্ষি বশিষ্ঠের সন্নিধানে উপনীত হইলেন। মহর্ষি সন্তানোৎপাদনে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইয়া দিব্য বিধানানুসারে মহিষীর সহবাস করিলেন। অনন্তর তাহার গর্ভলক্ষণ আবির্ভূত হইলে মুনি প্রজানাথকর্তৃক পূজিত হইয়া পুনরায় আশ্রমে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। রাজমহিষী সন্তান উৎপন্ন হইতে অধিকতর বিলম্ব দেখিয়া এক উপলখণ্ডদ্বারা স্বকীয় গর্ভ বিদীর্ণ করিলেন। বিদীর্ণ করিবামাত্র দ্বাদশবর্ষ গর্ভে স্থিত রাজর্ষি অশ্মক ভূমিষ্ঠ হইলেন।