১৭৭তম অধ্যায়
পরশুরামের ভীষ্মসহ যুদ্ধার্থ যাত্রা
“ভীষ্ম কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! অনন্তর মহাবীর জমদগ্ন্য বারংবার এইরূপ অভিহিত হইয়া গলদশ্রুনয়না কন্যাকে [রোদনপরায়ণা অম্বাকে] কহিলেন, “হে বৎসে! আমি বেদবিৎ ব্রাহ্মণগণের নিয়োগ ব্যতিরেকে কদাচ অস্ত্ৰগ্ৰহণ করিব না; এক্ষণে বল, তোমার আর কি অনুষ্ঠান করিতে হইবে? মহামতি ভীষ্ম ও শাল্বরাজ উভয়েই যাহাতে আমার বশবর্ত্তী হয়েন, তদ্বিষয়ে যত্ন করিব। অতএব তুমি আর শোকাকুল হইও না। আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, ব্রাহ্মণগণের নিয়োগ ব্যতিরেকে কখনই শস্ত্ৰগ্ৰহণ করিব না।”
“অম্বা কহিল, ‘ভগবন! আপনি আমার দুঃখ নিরাকরণ [নিবারণ] করিবেন কহিয়াছেন; ভীষ্মই আমার এই দুঃখের মূল, অতএব আপনি তাঁহাকেই বিনাশ করুন।’ পরশুরাম কহিলেন, “হে রাজকন্যে! ভীষ্ম সৎকারযোগ্য হইলেও আমার নির্দ্দেশানুসারে মস্তকদ্বারা তোমার চরণদ্বয় গ্রহণ করিবেন।” অম্বা কহিল, ‘ভগবন! আপনি যদি আমার হিতানুষ্ঠানের অভিলাষ করেন, তাঁহা হইলে সংগ্রামে আহত হইয়া গৰ্জনশীল অসুরের ন্যায় ভীষ্মকে বিনাশ করুন। আপনি যাহা অঙ্গীকার করিয়াছেন, তাহা প্ৰতিপালন করা কর্ত্তব্য।’
“তাঁহারা উভয়ে এইরূপ কথোপকথন করিতেছেন, এই অবসরে পরমধর্ম্মপরায়ণ অকৃতব্ৰণ কহিলেন, “হে ভৃগুনন্দন! এই কন্যা আপনার শরণাপন্ন হইয়াছে, আপনি ইহাকে পরিত্যাগ করিবেন না। যদি ভীষ্ম রণস্থলে সমাহূত হইয়া আপনার নিকট পরাজয় স্বীকার করেন, তাহা হইলে এই কন্যার কাৰ্য্য সমাহিত ও আপনার বাক্য সত্য হইবে। আপনি তৎকালে সকল ক্ষত্ৰিয়গণের বিনাশ করিয়া ব্ৰাহ্মণসন্নিধানে এইরূপ প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, যদি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়, বৈশ্য ও শূদ্র ব্ৰহ্মদ্বেষী [বেদবিদ্বেষী] হয়, তাহা হইলে আমি তাহাকে বিনাশ করিব। যদি কেহ ভীত হইয়া শরণাপন্ন হয়, আমি জীবন থাকিতে তাহাকে কখনই পরিত্যাগ করিব না। আর যে ব্যক্তি যুদ্ধক্ষেত্রে সমাগত ক্ষত্ৰিয়গণকে পরাজিত করিয়া আপনাকে গর্ব্বিত মনে করিবে, আমি তাহাকে বিনাশ করিব। ভীষ্মও সেই ভাবের বিজয়ী, অতএব আপনি তাহার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হউন।”
“পরশুরাম কহিলেন, “হে তপোধন! আমি পূর্ব্বকৃত প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়া শাস্তির অব্যাঘাতে [অবিরোধে—শাস্তিরক্ষাপূর্ব্বক] এই কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিব। কাশিরাজকন্যার মনোগত কাৰ্য্য অতি গুরুতর, অতএব যথায় ভীষ্ম অবস্থান করিতেছেন, আমি স্বয়ং এই কন্যাকে লইয়া তথায় গমন করিব। আপনি ক্ষত্ৰিয়সংগ্রামে [যুদ্ধে] ইহা বিদিতই আছেন যে, আমি যে সমস্ত শর প্রয়োগ করি, তাহা শরীরদিগের শরীর ভেদ করিয়া গমন করে; অতএব যদি সেই সমরশ্লাষী ভীষ্ম আমার বাক্য রক্ষা না করেন, তাহা হইলে আমি তাঁহাকে বিনাশ করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
“ভগবান্ জমদগ্ন্য মহর্ষিগণের নিকট এইরূপ কহিয়া যুদ্ধযাত্ৰাভিলাষে উদ্যুক্ত হইলেন। তাপসেরাও হুতাশনে আহুতিপ্ৰদান ও জপ সমাপন করিয়া তথায় রজনীযাপনপূর্ব্বক ভীষ্মকে সংহার করিবার নিমিত্ত প্ৰস্থান করিলেন। অনন্তর জামদগ্ন্য রাজকন্যা অম্বা ও তপোধনদিগের সহিত কুরুক্ষেত্রে সমুপস্থিত হইয়া সরস্বতীতীরে বাস করিতে লাগিলেন।”