১৭৭তম অধ্যায়
কৌরবপক্ষীয় রাক্ষস অলায়ুধের অভিযান
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর কর্ণ ও ঘটোৎকচের এইরূপ মহাযুদ্ধ হইতেছে, এমন সময় মহাবলপরাক্রান্ত রাক্ষসেন্দ্র অলায়ুধ পূর্ব্ববৈর স্মরণপূর্ব্বক বিকটদর্শন অসংখ্য রাক্ষসসৈন্যে পরিবৃত হইয়া রাজা দুর্য্যোধনসমীপে উপস্থিত হইল। পূর্ব্বে মহাবীর ভীমসেন উহার জ্ঞাতি বিক্রমশালী ব্রাহ্মণঘাতী বক, মহাতেজাঃ কিৰ্মীর এবং উহার পরমবন্ধু হিড়িম্বকে বিনাশ করিয়াছিলেন। ভীমসেনের এই বৈরাচরণ মহাবীর অলায়ুধের অন্তঃকরণে এতাবৎকাল জাগরূক্ ছিল। এক্ষণে সে নিশাযুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছে অবগত হইয়া ভীমসেনকে নিহত করিবার বাসনায় সমরাভিলাষে মত্তমাতঙ্গের ন্যায় এবং রোষাবিষ্ট ভুজঙ্গের ন্যায় সমাগত হইয়া রাজা দুর্য্যোধনকে কহিতে লাগিল, ‘হে মহারাজ! দুরাত্মা ভীমসেন যে আমার পরমবান্ধব হিড়িম্ব, বক ও কিৰ্মীরকে নিধন এবং আমাদিগকে ও অন্যান্য রাক্ষসগণকে পরাভব করিয়া হিড়িম্বার ধৰ্মলোপ করিয়াছে, তাহা আপনি অবগত আছেন; অতএব আজ আমি কৃষ্ণসহায় পাণ্ডবগণকে এবং সবান্ধব হিড়িম্বাতনয়কে হস্তী, অশ্ব ও রথের সহিত সংহারপূর্ব্বক অনুচরগণসমভিব্যাহারে ভক্ষণ করিব বলিয়া স্বয়ং উপস্থিত হইয়াছি। এক্ষণে আপনি স্বীয় সৈন্যগণকে নিবারণ করুন; আমি পাণ্ডবদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব।’
“হে মহারাজ! ভ্রাতৃগণপরিবৃত রাজা দুর্য্যোধন অলায়ুধের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে রাক্ষসেন্দ্র! আমার সৈনিকপুরুষেরা সকলেই বৈরনিৰ্যাতনে সমুৎসুক হইয়াছে; ইহারা কখনই স্থিরচিত্তে অবস্থান করিতে সমর্থ হইবে না; অতএব আমরা তোমাকে তোমার সৈন্যগণের সহিত পুরোবৰ্ত্তী করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব।’
“হে কুরুরাজ! রাক্ষসে অলায়ুধ দুৰ্য্যোধনের বাক্য স্বীকার করিয়া ঘটোৎকচের রথসদৃশ ভাস্বর রথে আরোহণপূর্ব্বক রাক্ষসগণসমভিব্যাহারে সত্বর ভীমতনয়ের প্রতি ধাবমান হইল। উহার রথও ঘটোৎকচের ন্যায় প্রমাণ, বহু তোরণে চিত্রিত ও ঋক্ষচর্মে পরিবৃত ছিল। ঐ রথে মাংসশোণিতভোজী মহাকায় একশত অশ্ব সংযোজিত হইয়াছিল। উহাদের আকার হস্তীর ন্যায় এবং কণ্ঠস্বর রাসভের ন্যায়। ঐ রথের নির্ঘোষ মেঘগর্জ্জনের ন্যায় গম্ভীর। ঘটোৎকচসদৃশ মহাবলপরাক্রান্ত মহাবাহু অলায়ুধের বৃহৎ কার্মুকও ঘটোৎকচের শরাসনের ন্যায় সুদৃঢ় জ্যাসম্পন্ন, বাণসকল সুবৰ্ণপুঙ্খ, সুশাণিত ও অক্ষপ্রমাণ এবং সূর্য্য ও অনলসদৃশ রথকেতুও গোমায়ুকুলে পরিরক্ষিত ছিল। উঁহার রূপও ঘটোৎকচের অপেক্ষা ন্যূন ছিল না। রাক্ষসে অলায়ুধ দীপ্ত অঙ্গদ, উষ্ণীষ, মাল্য, কিরীট, খড়্গ, গদা, ভূশণ্ডী, মুষল, হল, শরাসন এবং বারণচর্ম্মসদৃশ [হস্তিচর্ম্ম] বর্ম্মধারণপূর্ব্বক সেই অনলভাস্বর [অগ্নির ন্যায় প্রদীপ্ত] রথে সমারূঢ় হইয়া পাণ্ডবসেনা বিদ্রাবিত করিয়া সমরাঙ্গনে চপলাযুক্ত জলদের ন্যায় বিরাজিত হইল। ওদিকে পাণ্ডবপক্ষীয় মহাবলপরাক্রান্ত বর্ম্ম ও চর্ম্মধারী নরপতিগণ হৃষ্টচিত্তে চতুর্দ্দিকে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।”