১৭৬. অজগরপর্ব্বাধ্যায়

১৭৬তম অধ্যায়

অজগরপর্ব্বাধ্যায়

জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন! রথিশ্রেষ্ঠ ধনঞ্জয় ইন্দ্রভবন হইতে প্রত্যাগমন করিলে পর পাণ্ডুনন্দনগণ তাঁহার সহিত মিলিত হইয়া কি কি কর্ম্ম করিয়াছিলেন?

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পাণ্ডুতনয়েরা ইন্দ্রতুল্য প্রভাবসম্পন্ন মহাবীর অর্জ্জুন-সমভিব্যাহারে সেই সুরম্য শৈলে ধনেশ্বরের আক্রীড়ভূমিতে বিহার করিতে লাগিলেন। ধনুৰ্দ্ধরাগ্রগণ্য মহাবীর ধনঞ্জয় তত্ৰত্য অপ্রতিম গৃহ-সমুদয় ও নানাবিধ বৃক্ষে পরিবেষ্টিত ক্ৰীড়াস্থান-সকল অবলোকনপূর্ব্বক সুখে ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডুতনয়গণ যক্ষাধিপতি কুবেরের প্রসাদলব্ধ স্থান প্রাপ্ত হইয়া মর্ত্যলোকের ঐশ্বৰ্য্যে নিম্পৃহ হইলেন; বিশেষতঃ সেই সময় তাঁহাদের পক্ষে নিতান্ত শ্রেয়স্কর হইয়াছিল। মহাত্মা পাণ্ডবগণ বহুদিবসের পর প্রিয় ভ্রাতা ধনঞ্জয়ের সহিত মিলিত হইয়া আনন্দাতিশয্যবশতঃ ঐ স্থানেই অনায়াসে একরাত্রির ন্যায় চারি বৎসর যাপন করিলেন। ইতিপূর্ব্বে বনবাসে তাঁহাদের ছয় বৎসর অতীত হইয়াছিল, এক্ষণে আবার চারি বৎসর অতিবাহিত হওয়ায় তাঁহাদের দশ বৎসর অরণ্যবাস হইল। ঐ দশ বৎসর তাহারা বনে বাস করিয়াও পরমানন্দে জীবনযাত্ৰা নির্ব্বাহ করিয়াছিলেন।

পাণ্ডবভ্রাতৃগণের ভাবী শুভান্বেষণ-মন্ত্রণা

একদা মহাবল-পরাক্রান্ত বৃকোদর, অর্জ্জুন ও ইন্দ্রতুল্য প্রভাবসম্পন্ন মাদ্রীনন্দনদ্বয় একান্তে আসীন হইয়া মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূর্ব্বক প্রিয় ও হিতকর বাক্যে কহিতে লাগিলেন, “হে কুরুরাজ! আমরা কেবল আপনার প্রিয়ানুষ্ঠান ও আপনার প্রতিজ্ঞা সত্য করিবার মানসেই এই বন পরিত্যাগপূর্ব্বক সানুচর দুৰ্য্যোধনের সংহারার্থ গমন করিতেছি না। আমরা একান্ত সুখার্হ; কেবল দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক সুখসমৃদ্ধিসম্ভোগে বঞ্চিত হইয়া একাদশ বৎসর বনে বাস করিতেছি। হে মহারাজ! আমরা আপনার আজ্ঞানুসারে মান ও ধন পরিত্যাগপূর্ব্বক অশঙ্কিতচিত্তে বনে বনে পরিভ্রমণপূর্ব্বক পরিশেষে সেই মন্দবুদ্ধি দুৰ্য্যোধনকে বঞ্চিত করিয়া সুখে অজ্ঞাতবাস করিব। আমরা এক্ষণে অদূরে বাস করিয়া তাহাদিগকে প্রলোভিত করিয়াছি; পরে দূরদেশে গমন করিলে তাহারা কখনই আমাদের উদ্দেশ প্রাপ্ত হইবে না।

“এইরূপে সংবৎসর গূঢ়বাস করিয়া পরিশেষে সেই নরাধম দুর্য্যোধনকে অনায়াসে পরাজয়পূর্ব্বক তাহার সহিত চিরবদ্ধমূল বৈরানিৰ্য্যাতন করিব। অনন্তর আপনি পরমসুখে পৃথিবী পরিপালন করিবেন। আমরা এই স্বর্গোপম পরামরমণীয় স্থানে চিরকাল বাস করিয়া শোকসন্তাপ নিবারণ করিতে পারি, কিন্তু তাহা হইলে ভূমণ্ডলমধ্যে আপনার পরমপবিত্র কীর্ত্তি বিলুপ্ত হইবে, অতএব আপনি কুরুবংশীয়গণের রাজ্যপ্রাপ্ত হইয়া মহৎ যশোলাভ ও সৎক্রিয়ানুষ্ঠান করুন। আর আপনি ধনপতি কুবেরের নিকট যে কিছু প্ৰাপ্ত হইয়াছেন ও প্রাপ্ত হইবেন, তদ্দ্বারা শত্ৰুগণের জয় এবং রাজ্যলাভ অনায়াসেই তৎসমুদয় সুসম্পন্ন হইবে। আপনি এক্ষণে কৃতাপরাধ অরাতিগণকে বিনষ্ট করিতে চেষ্টা করুন। হে রাজন! স্বয়ং বাজপাণিও আপনার সাতিশয় উগ্ৰতেজ সহ্য করিতে সমর্থ হয়েন না, মহাপ্রভাবসম্পন্ন কৃষ্ণ ও সাত্যকি আপনার কার্য্যসিদ্ধির নিমিত্ত দেবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াও ব্যথিত হইবেন না। ধনুৰ্দ্ধর ধনঞ্জয় অতুল-বলশালী, আমিও উহার তুল্য পরাক্রান্ত। ভগবান বাসুদেব যাদবগণসমভিব্যাহারে আপনার অর্থসিদ্ধিবিষয়ে যেরূপ চেষ্টা করিবেন, আমিও অস্ত্রপ্রয়োগনিপুণ মাদ্রীসুতদ্বয়-সহকারে তদ্রূপ চেষ্টা করিব; এইরূপে আমরা সকলে আপনার ঐশ্বৰ্য্যলাভের নিমিত্ত একত্র মিলিত হইয়া আরাতিকুল নির্মূল করিতে প্ৰবৃত্ত হইব।”

মহাত্মা ধর্ম্মানন্দন ভ্রাতাদিগের মত গ্ৰহণানন্তর কুবেরপুরী প্ৰদক্ষিণ এবং সমুদয় গৃহ, নদী, সরোবর ও রাক্ষসগণকে আমন্ত্রণ করিয়া যথাগত পথ অবলোকন করিতে লাগিলেন। পরে গন্ধমাদন-পর্ব্বতের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া প্রার্থনা করিলেন, “হে শৈলেন্দ্র! আমি শক্রগণকে পরাজয় এবং অন্যান্য কর্ত্তব্যকর্ম্মসকল সম্পাদনপূর্ব্বক পরিশেষে জিতেন্দ্ৰিয় হইয়া তপস্যা করিবার নিমিত্ত যেন পুনর্ব্বার তোমাকে দর্শন করি।”

মহাত্মা যুধিষ্ঠির গন্ধমাদনের নিকট এইরূপ প্রার্থনা করিয়া অনুজগণ ও দ্বিজাতিকুল-সমভিব্যাহারে সেই পূর্ব্বপরিচিত পথ দিয়া গমন করিতে লাগিলেন। পর্ব্বতনির্ব্বারে সমুপস্থিত হইলে ঘটোৎকচ তাহাদিগকে বহন করিতে লাগিলেন। তখন মহর্ষি লোমশ কৃতপ্ৰস্থান পাণ্ডবগণকে পিতার ন্যায় উপদেশ প্রদান করিয়া পরম-প্রীতমনে পুণ্যতর দেবগণ-নিলয়ে গমন করিলেন। এদিকে পাণ্ডবগণ আর্ষ্টিষেণকর্ত্তৃক অনুশিষ্ট [উপদিষ্ট] হইয়া পরামরমণীয় তীর্থ, তপোবন ও বৃহৎ বৃহৎ সরোবর সকল অবলোকনপূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন।