১৭৪তম অধ্যায়
কর্ণ-ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ—পাণ্ডবসৈন্যপলায়ন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর অরাতিনিপাতন কর্ণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে সমরাঙ্গনে অবলোকন করিয়া তাঁহার বক্ষঃস্থলে মর্ম্মভেদী দশশর নিক্ষেপ করিলে, মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহাকে ‘থাক থাক’ বলিয়া পাঁচবাণে বিদ্ধ করিলেন। তৎপরে সেই মহাবীরদ্বয় পরস্পরকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিয়া শরাসন আকর্ণ আকর্ষণপূর্ব্বক পরস্পরকে সুতীক্ষ্ণ সায়কসমূহে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ পাঞ্চালপ্রধান ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথি ও অশ্বগণকে শমনসদনে প্রেরণপূর্ব্বক নিশিতশনিকরে তাঁহার কার্মুক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ধৃষ্টদ্যুম্ন এইরূপে অশ্ব, সারথি ও কার্মুকবিহীন হইয়া গদাগ্রহণপূর্ব্বক রথ হইতে কর্ণসমীপে গমন করিয়া তাঁহার চারি অশ্ব বিনাশ করিলেন। তৎপরে তিনি বেগে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া অর্জ্জুনের রথে আরোহণপূর্ব্বক পুনরায় কর্ণসমীপে গমনোদ্যত হইলে ধর্ম্মসূনু যুধিষ্ঠির তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাতেজস্বী। কর্ণ সিংহনাদ, ধনুষ্টঙ্কার ও শঙ্খ প্রধ্নাপন করিতে আরম্ভ করিলেন।
“হে মহারাজ! ঐ সময় মহারথ পাঞ্চালগণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে পরাজিত অবলোকন করিয়া ক্রোধভরে অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া কর্ণের অভিমুখীন হইল। তৎকালে কর্ণের সারথিও তাঁহার রথে শঙ্খবৰ্ণ, সিন্ধুদেশোদ্ভব বেগগামী অন্য অশ্বসমুদয় সংযোজিত করিল। তখন মেঘ যেমন পর্ব্বতোপরি বারিধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ লব্ধলক্ষ্য মহাবীর রাধেয় পাঞ্চালবংশীয় মহারথদিগের প্রতি আয়ত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। পাঞ্চালসেনাগণ কর্ণকর্ত্তৃক মর্পিত হইয়া সিংহার্দ্দিত মৃগযূথের ন্যায় ভয়ে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল এবং অনেকে অশ্ব, হস্তী ও রথ হইতে ধরাতলে নিপতিত হইতে লাগিল। মহাবীর কর্ণ ধাবমান গজারোহী, অশ্বারোহী ও পদাতিগণের মধ্যে ক্ষুরপ্র-অস্ত্রে কাহারও বাহু, কাহারও ঊরু, কাহারও বা কুণ্ডলালঙ্কৃত মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তৎকালে অন্যান্য মহারথগণ স্ব স্ব গাত্র ও বাহনসকল ছিন্নভিন্ন হইলেও কিছুমাত্র অবগত হইতে পারিলেন না। এইরূপে পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ নিতান্ত অস্থিরচিত্ত হইয়া উঠিল; তখন তৃণস্পন্দনেও তাহাদিগের মনে কর্ণভ্রম উপস্থিত হওয়ায় তাহারা স্বপক্ষীয় যোদ্ধাদিগকেও কর্ণজ্ঞান করিয়া ভয়ে পলায়ন করিতে লাগিল। মহাবীর কর্ণ চারিদিকে শরবর্ষণ করিয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। যোধগণ কর্ণ ও দ্রোণাচার্য্যের শরপ্রহারে বিচেতনপ্রায় হইয়া চতুর্দ্দিক নিরীক্ষণপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল; কেহই সমরে অবস্থান করিতে সমর্থ হইল না।
কর্ণপরাক্রমদর্শনে যুধিষ্ঠিরের ত্রাস
“হে মহারাজ! তখন রাজা যুধিষ্ঠির সৈন্যগণকে বিদ্রাবিত ও পলায়নপর অবলোকন করিয়া অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে ভ্রাতঃ! ঐ দেখ, মহাধনুৰ্ধর কর্ণ এই ভীষণ রজনীতে প্রখর ভাস্করের ন্যায় অবস্থান এবং তোমার আত্মীয়গণ কর্ণশরে ক্ষতবিক্ষত হইয়া অনাথের ন্যায় আর্ত্তনাদ করিতেছে। সূতপুত্র যে কখন শরসন্ধান এবং কখনই বা শর নিক্ষেপ করিয়া সৈন্যগণকে আকুলিত করিতেছে, তাহা কিছুই লক্ষিত হইতেছে না। অতএব হে ধনঞ্জয়! এক্ষণে সময়োচিত কাৰ্য্য অবধারণপূর্ব্বক যাহাতে সূতপুত্রের বধসাধন হয়, তাহা সম্পাদন কর।
“হে মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির এইরূপ কহিলে মহাবীর অর্জ্জুন কৃষ্ণকে কহিলেন,—‘হে কেশব! আজ ধর্ম্মরাজ সূতপুত্রের বিক্রমদর্শনে ভীত হইয়াছেন। দেখ, শত্রুসৈন্যগণ বারংবার আমাদিগকে আক্রমণ করিতেছে; অতএব তুমি অবিলম্বে সময়োচিত কার্য্যের অনুষ্ঠান কর; আমাদিগের সেনাসকল দ্রোণাচার্য্যের শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া ভয়ে পলায়ন করিতেছে; কেহই রণস্থলে অবস্থান করিতে সমর্থ হইতেছে না। মহাবীর কর্ণও নিশিতশরে প্রধান প্রধান রথীদিগকে বিদ্রাবিত করিয়া নির্ভীকচিত্তে রণস্থলে ভ্রমণ করিতেছে। হে বৃষ্ণিশার্দূল! ভুজঙ্গম যেমন কাহারও পাদস্পর্শ সহ্য করিতে পারে না, তদ্রূপ আমি এই সংগ্রামস্থলে সূতপুত্রের পরাক্রম সহ্য করিতে সমর্থ হইতেছি না; অতএব হে কৃষ্ণ! তুমি শীঘ্র কর্ণসমীপে রথসঞ্চালন কর। আজ হয় আমি উহার বিনাশ করিব, না হয় ঐ দুরাত্মাই আমার বধসাধন করিবে।
“বাসুদেব কহিলেন, “হে কৌন্তেয়! আমি অলৌকিক বিক্রমশালী কর্ণকে সুররাজের ন্যায় সমরে বিচরণ করিতে দেখিতেছি। তুমি ও ঘটোৎকচ ভিন্ন আর কেহই উহার প্রতিদ্বন্দ্বী নাই। কিন্তু এক্ষণে কর্ণের অভিমুখীন হওয়া তোমার নিতান্ত অনুচিত। সূতপুত্র তোমার বধসাধনার্থই দেদীপ্যমান মহোল্কাসদৃশ দেবরাজপ্রদত্ত ভীষণ শক্তি অতি যত্নসহকারে রক্ষা করিয়া ঘোররূপে সমরাঙ্গনে অবস্থান করিতেছে। অতএব তোমাদের সতত অনুরক্ত ও হিতৈষী মহাবীর ঘটোৎকচ কর্ণের অভিমুখে গমন করুক। ঐ দেবতুল্য পরাক্রমশালী রাক্ষস মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেনের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছে এবং দিব্য, আসুর ও রাক্ষস-অস্ত্রে উহার বিশেষ পারদর্শিতা আছে, অতএব ঘটোৎকচ অবশ্যই কর্ণকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে।
কৃষ্ণকর্ত্তৃক কর্ণযুদ্ধে ঘটোৎকচের নিয়োগ
“হে মহারাজ! কমললোচন অর্জ্জুন বাসুদেবকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া ঘটোৎকচকে আহ্বান করিলেন। বিচিত্র কবচমণ্ডিত ভীমসেনকুমার অর্জ্জুনের আহ্বান শ্রবণমাত্র খড়্গ ও ধনুর্ব্বাণ ধারণপূর্ব্বক তাঁহার সমীপে সমাগত হইয়া তাঁহাকে ও বাসুদেবকে অভিবাদনপূর্ব্বক সগর্ব্ববচনে কহিলেন,—‘হে মহাত্মন! এই আমি উপস্থিত হইয়াছি, আজ্ঞা করুন, কোন্ কাৰ্য্য সম্পাদন করিতে হইবে?’ তখন বাসুদেব হাস্যমুখে সেই দীপ্তলোচন, মেঘসঙ্কাশ ভীমতনয়কে কহিলেন, ‘হে ঘটোৎকচ! আমি তোমাকে যে কথা কহিতেছি, তাহা শ্রবণ কর। এক্ষণে এই সংগ্রামে তোমারই বিক্রমপ্রকাশের উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইয়াছে, তুমি ভিন্ন অন্য কেহই পরাক্রমপ্রকাশে সমর্থ হইবে না। তোমার নিকট রাক্ষসী মায়া ও বিবিধ অস্ত্র বিদ্যমান রহিয়াছে, অতএব তুমি যুদ্ধসাগরনিমগ্ন পাণ্ডবগণের প্লবস্বরূপ হও। ঐ দেখ, পাণ্ডবসেনাগণ গোপাল [গোরক্ষক রাখাল]-তাড়িত গোসমূহের ন্যায় কর্ণশরে বিদ্রাবিত হইতেছে। দৃঢ়বিক্রম ধনুর্ধারী সূতনন্দন পাণ্ডবসেনামধ্যে প্রধান প্রধান ক্ষত্রিয়গণকে বিনাশ করিতেছে। দৃঢ়চাপধারী যোধগণ অসংখ্য শরবর্ষণ করিয়াও কর্ণশরপ্রভাবে সমরে অবস্থান করিতে নিতান্ত অশক্ত হইয়াছে। এই ঘোর নিশীথসময়ে পাঞ্চালগণ কর্ণশরে নিপীড়িত হইয়া সিংহার্পিত মৃগের ন্যায় ভয়ে পলায়ন করিতেছে। হে ভীমবিক্রম ভীমতনয়! এক্ষণে তুমি ভিন্ন কর্ণকে নিবারণ করা আর কাহারও সাধ্য নহে। অতএব তুমি মাতৃকুল, পিতৃকুল এবং আপনার তেজস্বিতা ও অস্ত্রবলের অনুরূপ কার্য্যে প্রবৃত্ত হও। হে হিড়িম্বাতনয়! মানবগণ পুত্রদ্বারা বন্ধুবান্ধবগণের সহিত ইহলোকে দুঃখ হইতে বিমুক্ত ও পরলোকে উৎকৃষ্ট গতি প্রাপ্ত হইবার মানসেই পুত্র কামনা করিয়া থাকে। অতএব তুমি এক্ষণে পিত্ববান্ধবগণকে দুঃখসমুদ্র হইতে উদ্ধার কর। হে ঘটোৎকচ! তুমি সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলে তোমার অস্ত্রবল অতি ভীষণ ও মায়া অতি দুস্তর হইয়া উঠে। তোমার সমান যুদ্ধনিপুণ আর কেহই নাই। অতএব তুমি এই রজনীতে কর্ণসায়কভিন্ন পাণ্ডবগণকে উদ্ধার কর। হে রাক্ষসশ্রেষ্ঠ! নিশাচরগণ রাত্রিকালে অমিতবলবিক্রমশালী, নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ ও সংগ্রামে নিপুণ হইয়া উঠে। অতএব তুমি এই নিশীথসময়ে মায়াভাবে ধনুর্ধারী কর্ণকে বিনাশ কর। পার্থগণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে অগ্রসর করিয়া দ্রোণকে বিনাশ করিবেন।’
ঘটোৎকচের অভিযান-কর্ণসহ যুদ্ধ
“হে মহারাজ! অনন্তর কেশবের বাক্যাবসান হইলে মহাবীর ধনঞ্জয় ঘটোৎকচকে কহিলেন, ‘বৎস! সমুদয়, পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে তুমি, মহাবাহু সাত্যকি ও মহাবীর ভীমসেন, তোমরা এই তিনজনই আমার মতে সর্ব্বপ্রধান। এক্ষণে তুমি এই রজনীযোগে কর্ণের সহিত দ্বৈরথযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। মহারথ সাত্যকি তোমার পৃষ্ঠরক্ষক হইবেন। পূর্ব্বকালে দেবরাজ যেমন কার্ত্তিকেয়ের সহিত মিলিত হইয়া তারকাসুরকে সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমি অদ্য সাত্যকির সহিত মিলিত হইয়া কর্ণকে বিনাশ কর।’
“ঘটোৎকচ ধনঞ্জয়ের বাক্য শ্রবণানন্তর কহিল, “হে মহাত্ম! কি কর্ণ, কি দ্রোণ, কি অন্যান্য অস্ত্রবেত্তা ক্ষত্রিয়গণ, আমি সকলকেই পরাজিত করিতে পারি। অদ্য সূতপুত্রের সহিত এরূপ যুদ্ধ করিব যে, যতদিন পৃথিবী বর্ত্তমান থাকিবে, ততদিন লোকে আমার সংগ্রামবৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিবে। অদ্য কি শূর, কি শঙ্কিত, কি বদ্ধাঞ্জলি, বিপক্ষীয় কোন ব্যক্তিকেই পরিত্যাগ করিব না; রাক্ষসধর্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক সকলকেই সংহার করিব।’
“হে মহারাজ! অরাতিঘাতন মহাবাহু ঘটোৎকচ এই বলিয়া কৌরবসৈন্যগণকে ভীত করিয়া কর্ণের সহিত তুমুল সংগ্রাম করিতে ধাবমান হইলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ সূতনন্দন হাস্যমুখে সেই দীপ্তাস্য [প্রদীপ্তবদন] ক্রুদ্ধ নিশাচরের অভিমুখীন হইলেন। তখন ইন্দ্র ও প্রহ্লাদের ন্যায় কর্ণ ও ঘটোৎকচের ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল।”