১৭৪তম অধ্যায়
অম্বার প্রতি মাতামহ হোত্রবাহনের উপদেশ
“ভীষ্ম কহিলেন, “হে রাজন। ধর্ম্মপরায়ণ তাপসগণ কাৰ্য্যনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া অগ্ৰে এই বিষয়ে কিংকর্ত্তব্যতা অবধারণ করিতে লাগিলেন। কেহ কেহ কহিলেন, ‘কন্যাকে পিত্ৰালয়ে লইয়া চল।” কেহ কেহ আমাদিগকে তিরস্কার করিতে অভিলাষ করিলেন; কেহ কেহ বিবেচনা করিলেন, শাল্বরাজসন্নিধানে গমন করিয়া ইহাকে নিয়োগ করা কর্ত্তব্য; কেহ কেহ বলিলেন, “শাল্বরাজ একবার ইহাকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন, এক্ষণে আমরা তথায় গমন করিয়া কি করিব?” অনন্তর তাঁহারা সকলে অম্বাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎসে। এক্ষণে তোমার সন্ন্যাসধর্ম্ম অবলম্বন করিবার প্রয়োজন নাই, তুমি আমাদের হিতকর বাক্য শ্ৰবণ কর, তোমার মঙ্গল হইবে। তুমি পুনরায় পিতৃভবনে গমন কর। পিতা যেরূপ উপায়বিধান করিয়া দিবেন, তুমি তাহাতেই সম্পূর্ণ সুখী হইবে। পিতার ন্যায় স্ত্রীলোকের আর অন্য আশ্রয় নাই। শাস্ত্ৰে কথিত আছে, পিতা অথবা পতিই স্ত্রীলোকের একমাত্র গতি। তাহার মধ্যে উত্তম অবস্থায় ভর্ত্তা ও বিপদকালে একমাত্র পিতাই রমণীগণের আশ্রয় হইয়া থাকেন। সন্ন্যাসাশ্রম নিতান্ত ক্লেশকর; বিশেষতঃ তুমি পরম সুকুমারী [কোমলদেহা-সুখলালিতা] রাজকুমারী; কোনরূপেই ঐ সকল ক্লেশ সহ্য করিতে পরিবে না। আর ইহাতে বিস্তর দোষ; সুতরাং পিতৃগৃহে বাস করাই তোমার শ্রেয়স্কর হইতেছে।”
“অনন্তর অন্যান্য তাপসেরা কহিলেন, “বৎসে! ভূপাল তোমাকে নির্জ্জন অরণ্যে একাকী বাস করিতে দেখিয়া অবশ্যই প্রার্থনা [গ্রহণ করিতে অভিলাষ] করিবেন, অতএব তুমি কদাচ এরূপ অভিলাষ করিও না। অম্বা কহিলেন, “হে তপোধনগণ! আমি পিতৃগৃহে পুনর্ব্বার গমন করিতে সমর্থ হইতেছি না; বান্ধবগণ আমার প্রতি অতিশয় অবজ্ঞা ও ঘৃণা প্রদর্শন করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি বাল্যকালে সুখস্বচ্ছন্দে পরমসমাদরে পিত্ৰালয়ে বাস করিয়াছি; এক্ষণে আর তথায় অবস্থান করিতে আমার অভিরুচি হইতেছে না। আপনাদের মঙ্গল হউক, এক্ষণে তাপসগণকর্ত্তৃক পরিরক্ষিত হইয়া তপানুষ্ঠান করিতে বাসনা করি। তাহা হইলে আমাকে পরলোকে আর এইরূপ দুৰ্দশা ভোগ করিতে হইবে না।”
“তাঁহারা এইরূপ কথোপকথন করিতেছেন, ইত্যবসরে রাজর্ষি হোত্ৰবাহন সেই আশ্রমপদে উপস্থিত হইলেন। তাপসেরা তাহাকে স্বাগতপ্রশ্নপূর্ব্বক [অনায়াসে আগমনের প্রশ্ন] পাদ্য, আসন ও উদক [জল] প্রদান করিয়া পূজা করিলেন। রাজর্ষি উপবেশন করিয়া বিশ্রামসুখ অনুভব করিতে লাগিলেন। তখন তাপসেরা পুনরায় কন্যাকে উপদেশ প্রদানে প্রবৃত্ত হইলেন। রাজর্ষি তাপসমুখে অম্বার বিপদবৃত্তান্তশ্রবণে নিতান্ত উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন এবং কন্যাকে আপনার দুঃখবৃত্তান্ত বর্ণনা করিতে দেখিয়া একান্ত কৃপাপরতন্ত্র হইলেন। অনন্তর তিনি সত্বর সমুত্থিত হইয়া কম্পিতকলেবরে তাঁহাকে অঙ্কে [ক্ৰোড়ে] আরোপিত করিয়া আশ্বাসপ্রদানপূর্ব্বক দুঃখের কারণ নিবেদন করিলেন। তখন রাজর্ষি শোকদুঃখে নিতান্ত কাতর হইয়া কর্ত্তব্য অবধারণপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বৎস! তোমার পিতৃগৃহে গমন করিবার আর আবশ্যকতা নাই; আমি তোমার মাতামহ; তুমি আমার ছন্দানুবর্ত্তিনী [অভিপ্রায়ানুসারে অনুষ্ঠানকারিণী] হইলে আমি অবশ্যই তোমার দুঃখ মোচন করিব। তুমি যে এইরূপ ক্লেশপ্ৰাপ্ত হইতেছে, ইহাতে আমার অন্তঃকরণ নিতান্ত কাতর হইতেছে। এক্ষণে তুমি আমার বাক্যানুসারে তপস্বী জামদগ্ন্যের নিকট গমন কর। ভীষ্ম যদি তোমার বাক্য রক্ষা না করেন, তাহা হইলে সেই কালাগ্নিসমতেজা [প্রলয়ানলতুল্য তেজস্বী] জমদগ্ন্য তাঁহাকে সংহার করিয়া তোমার দুঃখ ও শোক শান্তি করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।
“তখন অম্বা অবিরল বাষ্পাকুললোচনে মধুরবচনে মাতামহ হোত্ৰবাহনকে বারংবার কহিতে লাগিলেন, “তাত! আমি মস্তকদ্বারা অভিবাদন করিয়া আপনার নির্দ্দেশানুসারে সেই লোকবিশ্রুত আৰ্য্য জমদগ্ন্যকে সন্দর্শন করিব। এক্ষণে কিরূপে তথায় গমন করিব এবং কিপ্রকারেই বা তিনি আমার দুঃখবিনাশে কৃতকাৰ্য্য হইবেন, ইহা শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি।’ ”