১৭২তম অধ্যায়
কৃতঘ্ন গৌতমকর্ত্তৃক মিত্রবধ
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! গৌতম যে স্থানে শয়ন করিয়াছিলেন, বিহগরাজ রাজধৰ্ম্ম ঐ স্থানের অনতিদূরে অগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া স্বয়ং বিশ্বস্তচিত্তে ব্রাহ্মণের পার্শ্বদেশে শয়ান রহিয়াছিল। পাপাত্মা গৌতম ঐ পক্ষীকে নিশ্চিন্তচিত্তে নিদ্রিত দেখিয়া প্রদীপ্ত বহ্নিদ্বারা তাহার বিনাশসাধন করিলেন। ঐ সময় ঐ কাৰ্য্য যে নিতান্ত পাপজনক, তাহা একবারও তাহার মনে উদিত হইল না; প্রত্যুত যারপরনাই আহ্লাদেরই সঞ্চার হইতে লাগিল। তখন তিনি ঐ পক্ষীকে পক্ষরোমশূন্য [পাখা ও লোমশূন্য] ও অগ্নিতে সুপক্ক করিয়া সেই সমস্ত সুবর্ণের সহিত গ্রহণপূৰ্ব্বক দ্রুতবেগে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন।
“এ দিকে সেই দিবস অতীত হইলে রাক্ষসরাজ বিরূপাক্ষ স্বীয় সখা রাজধৰ্ম্মকে অবলোকন না করিয়া আপনার পুত্রকে কহিলেন, ‘বৎস! আজ রাজধৰ্ম্মকে নিরীক্ষণ করিতেছি না কেন? সে প্রতিদিন প্রাতঃকালে ব্রহ্মাকে বন্দনা করিবার নিমিত্ত তাঁহার নিকট গমন করিয়া থাকে। প্রত্যাগমনসময়ে আমার সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া কখনই গৃহে গমন করে না; কিন্তু অদ্য দুই রাত্রি অতিবাহিত হইল, সে আমার গৃহে আগমন করে নাই। তাঁহার নিমিত্ত আমার মন অতিশয় বিচলিত হইতেছে; অতএব তুমি অবিলম্বে তাঁহার অনুসন্ধান কর। আমার বোধ হইতেছে, সেই স্বাধ্যায়শূন্য ব্রাহ্মণ্যবিহীন দ্বিজাধম গৌতম তাঁহাকে বধ করিয়া থাকিবে। সেই দুরাত্মার ভাবভঙ্গী দেখিয়াই তাহাকে ভীষণাকার নির্দ্দয় দুষ্ট ও দস্যুর ন্যায় অধম বলিয়া বোধ হইয়াছিল। ঐ দুরাত্মা সেই স্থানে গমন করাতেই আমার অন্তঃকরণ অতিশয় বিচলিত হইতেছে। অতএব তুমি শীঘ্র রাজধৰ্ম্মের আবাসে গমন করিয়া সে জীবিত আছে কি না, জানিয়া আইস।
“রাক্ষসরাজ এইরূপ আদেশ করিলে তাঁহার পুত্র অন্যান্য রাক্ষসগণসমভিব্যাহারে সত্বর রাজধৰ্ম্মের আবাসে গমনপূর্ব্বক সেই বটবৃক্ষের সন্নিধানে তাঁহার অস্থিসমুদয় নিপতিত অবলোকন করিল। বকের অস্থি-দর্শনে রাক্ষসতনয়ের দুঃখের আর পরিসীমা রহিল না। তখন সে অবিরল বাষ্পকুললোচনে গৌতমকে গ্রহণ করিবার নিমিত্ত মহাবেগে অন্যান্য রাক্ষসগণের সহিত ধাবমান হইল এবং বহুদূরে গৌতমকে আক্রমণ করিয়া তাঁহাকে রাজধৰ্ম্মের পক্ষাস্থিচরণশূন্য মৃতদেহের সহিত গ্রহণপূর্ব্বক মেরুব্রজে রাক্ষসরাজ বিরূপাক্ষের নিকট গমন করিল। রাক্ষসরাজ সখার মৃতদেহ-দর্শনে যারপরনাই দুঃখিত হইয়া অমাত্য ও পুরোহিতগণসমভিব্যাহারে অনর্গল অশ্রুবিসৰ্জন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় তাহার আবাসমধ্যে রাজধৰ্ম্মের বিয়োগ নিবন্ধন ঘোরতর আর্ত্তনাদ সমুপস্থিত হইল। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই নিতান্ত শোকাকুল হইয়া উঠিল।
রাক্ষসকর্ত্তৃক মিত্রঘাতী গৌতমের বধসাধন
“অনন্তর মিত্রবৎসল বিরূপাক্ষ কৃতঘ্ন গৌতমের উপর যারপরনাই ক্রুদ্ধ হইয়া স্বীয় আত্মজকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘বৎস! তুমি অন্যান্য রাক্ষসগণসমভিব্যাহারে অবিলম্বে এই পাপাশয় ব্রাহ্মণকে বিনাশ কর। ইহার মাংস ভোজন করিয়া রাক্ষসগণ তৃপ্তি লাভ করুক। এই দুরাত্মা অতিশয় পাপপরায়ণ, অতএব আমার মতে তোমাদিগের হস্তে ইহার মৃত্যুলাভ হওয়াই শ্রেয়ঃ।’ রাক্ষসরাজ এইরূপ আদেশ করিলে তত্ৰত্য ঘোরবিক্রম রাক্ষসগণ তাঁহার চরণে প্ৰণিপাতপূৰ্ব্বক কহিল, ‘মহারাজ! এই পাপাত্মা ব্রাহ্মণকে ভক্ষণ করিতে আমাদিগের কিছুতেই প্রবৃত্তি হইতেছে না। আপনি ইহাকে দস্যুদিগের হস্তে সমর্পণ করুন। পাপাত্মাকে আমাদিগের ভক্ষণার্থ প্রদান করা আপনার কর্ত্তব্য নহে।’ রাক্ষসগণ বিনীতভাবে এই কথা কহিলে বিরূপাক্ষ তাহাদের বাক্যে সম্মত হইয়া কহিলেন, ‘অদ্যই কৃতঘ্ন ব্রাহ্মণের দেহ দস্যুগণকে সমর্পণ কর।’
“তখন সেই রাক্ষসগণ বিরূপাক্ষের আজ্ঞানুসারে পট্টিশদ্বারা গৌতমের দেহ খণ্ড খণ্ড করিয়া দস্যুদিগকে প্রদান করিতে লাগিল; কিন্তু দস্যুগণও সেই নরাধমের মাংসভক্ষণে অভিলাষী হইল না। হে ধৰ্ম্মরাজ! যে ব্যক্তি কৃতঘ্ন, রাক্ষসেরাও তাহাকে ভোজন করে না বরং ব্রহ্মগ্ন, সুরাপায়ী, তস্কর ও ব্রতঘ্ন ব্যক্তির নিস্তার আছে, কিন্তু যে ব্যক্তি কৃতঘ্ন, তাহার কিছুতেই নিষ্কৃতি নাই। যে নরাধম মিত্রদ্রোহী, কৃতঘ্ন ও নৃশংস, রাক্ষস বা অন্যান্য কীটেরাও তাহাকে ভক্ষণ করে না।”