১৭১. তপতীর উপাখ্যান, তপতীরূপমুগ্ধ সম্বরণের বিস্ময়
একসপ্তত্যধিকশততম অধ্যায়।
অর্জুন কহিলেন-হে গন্ধর্বরাজ! তুমি যে তাপত্য বলিয়া আমাকে সম্বোধন করিলে, তাহার যথার্থ অর্থ কি? আমরা কুন্তীপুত্র, কি কারণে তাপত্য বলিয়া আহুত হইলাম? কাহার নামই বা তপতী ছিল? হে সাধে! সবিশেষ জানিতে অভিলাষ করি। গন্ধর্বরাজ অর্জুনের বাক্যে প্রীত হইয়া ত্রিলোক প্রখ্যাত অদ্ভুত উপাখ্যান কীর্তন করিতে লাগিলেন। অর্জুন ও শ্রবণমানসে অবহিতচিত্ত হইলেন। গন্ধর্বরাজ কহিলেন, হে অর্জুন! আমি যে কারণে তপতীতনয় বলিয়া তোমাকে সম্বোধন করিলাম, সেই রমণীয় বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত কীর্তন করিলে সমুদায় বুঝিতে পারিবে; স্থিরচিত্তে শ্রবণ কর। যিনি ভূলোক ও দ্যুলোকে আলোক প্রদান করিতেছেন, সেই সূৰ্য্যদেব সৰ্বাঙ্গসুন্দরী তপতীর জন্মদাতা। সাবিত্রীর পর ইহার জন্ম হয়। তপতী তপোনুক্তরা ও ত্রিলোক প্রখ্যাত ছিলেন। সুরাসুর গন্ধর্বারোমধ্যে কোন কামিনীই তপতীসদৃশ রূপশালিনী ছিলেন না। একদা সূৰ্য, পদ্মপলাশলোচন। সদাচারসম্পন্ন কন্যাকে প্রাপ্তযোবনা দেখিয়া রূপ,গুণ, শ্রুত ও শীল সম্পন্ন এক অনুরূপ পাত্র অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন; কিন্তু তিনি ত্রিভুবন মধ্যে কন্যার উপযুক্ত পাত্র দেখিতে পাইলেন না। এই কারণে তাঁহার অন্তঃকরণ বলবতী চিন্তায় একান্ত আক্রান্ত হইয়াছিল, সমুদয় সুখ ও শান্তি এককালে তাঁহা হইতে তিরোহিত হইল।
এই সময়ে কুরুবংশাবতস ঋক্ষতনয় মহাবল পরাক্রান্ত মহারজ সম্বরণ শুশ্রুষা পরতন্ত্র, অহঙ্কার শূন্য, বিশুদ্ধচিত, একান্ত ভক্তিমান্ ও সমধিক শ্রদ্ধাশালী হইয়া অর্ঘ্য, মাল্য, ধূপ, দীপ প্রভৃতি বিবিধোপহরে ও নিয়মেপিরাসতপস্যাহকরে প্রতিদিন উদয়কলে ভাল ভাস্করের আরাধনা করতেন; সূৰ্য্যদেব রাজার আরাধনে সাতিশয় প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া মহাকুলোত, অসামান্য রূপসম্পন্ন, কৃতজ্ঞ, ধৰ্মাৰ্থবো, নৃপোত্তম সম্বরণকেই স্বীয় দুহিতা তপতীর অনুরূপ পতি বলিয়া বিবেচনা করিলেন। পরিশেষে তাহাকেই কন্যা দান করিতে তাহার সম্পূর্ণ মনোরথ হইল। যাদৃশ সূৰ্য্যকিরণে নভোমণ্ডল আলোকময় হয়, সেইরূপ এই মহীপালের অদ্ভুত প্রভাবে ভূলোক উদ্ভাসিত হইয়াছিল। যাদৃশ ব্ৰহ্মবাদী মহর্ষিগণ উদয়কালে আদিত্যকে আরাধনা করেন, সেইরূপ ব্রাহ্মণের প্রজাবর্গ মহারাজ সম্বরণের পূজা করিত। তিনি দেখিতে অতি কান্ত ছিলেন, এই নিমিত্ত মিত্রমণ্ডলীর নিকটে চন্দ্ৰতুল্য প্রতীয়মান হইতেন এবং অতি তেজস্বী ছিলেন বলিয়া, শক্রবর্গ তাহাকে প্রচণ্ড দিবাকরের ন্যায় নিতান্ত দুনিরীক্ষ্য বোধ করিত; সূৰ্য্যদেব সেই সুশীল ও সদ্গুণসম্পন্ন সম্বরণকে তপতী দান করিতে মনোনীত করিলেন।
একদা মহাবল শ্রীমান্ সম্বরণ মৃগয়ার্থ গিরিকাননে গমন করিলে তথায় তাঁহার অপ্রতিম অশ্ব মৃগয়াবিহার-পরিশ্রমে ও ক্ষুৎপিপাসার আতিশষ্যে একান্ত কাতর হইয়া তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। অশ্ব বিনষ্ট হইলে রাজ। একাকী পৰ্বতোপরি পদচারে সঞ্চরণ করিতে করিতে সহসা কমলায়তলোচনা এক সৰ্বাঙ্গসুন্দরী কুমারীকে দেখিতে পাইলেন। তিনি সেই অসহায় অবলারত্নকে নির্নিমেষলোচনে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন; কন্যার অসামান্য রূপলাবণ্য সন্দর্শন করিয়া রাজা অনুমান করিলেন, বুঝি কমলাসনা লক্ষনী বা দিবাকরের স্মলিতভা অবনীতে অবতীর্ণ হইয়া থাকিবেন। সেই অঙ্গনারত্নের আকার ও তেজঃপুঞ্জ প্রভাবে তাঁহাকে প্রদীপ্ত হুতাশনশিখা এবং প্রসন্নতা ও কমনীয়তাগুণে বিমলা শশিকলা বলিয়া ভ্রান্তি জন্মিল। তিনি শৈলশিখরে অরূঢ় থাকিয়া হিরন্ময়ী প্রতিমার প্রতিরূপ হইয়াছিলেন; এমন কি, তাঁহার রূপ ও বেশবিন্যাসপ্রভাবে বৃক্ষলতার সহিত সমুদায় শৈলই সুবর্ণময় প্রতীত হইতেছিল। তাহাকে অবলোকন করিয়া রাজার ত্রিলোকের মহিলার প্রতি অবজ্ঞা জন্মিল; তিনি মনে করিলেন, এই কামিনীকে নয়নগোচর করিয়া এত দিনে চক্ষুদ্বয়ের সম্যক্ ফল লাভ করিলাম। জন্মাবধি যে কিছু দেখিয়াছিলাম, কেহই এই রমণীয় রূপের অনুরূপ নহে বলিয়া তর্ক করিতে লাগিলেন। তিনি তদীয় গুণময় পাশে সংষতচিত্ত ও সংযতনে হইয়া সে স্থান হইতে প্রস্থান করিতে সমর্থ হইলেন না এবং ইতিক ব্যবিমূঢ় হইয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। কিয়ং ক্ষণ পরে তাঁহার মনে উদয় হইল, বি বিপত। ত্রিলোক মইন করি। এই দুর্লভ রূপের সৃষ্টি করিয়াছেন। ফলতঃ রাজ কন্যার এইরূপ রূপসম্পত্তি সন্দর্শন করিয়া তাহাকে অলোকসামান্য বলি বা জ্ঞান করিলেন। অনুপম রূপের কি অপ্রতিম মহিলা! রাজ দেখিতে দেখিতে মদনবাণে একান্ত পীড়িত হইয়া নিতান্ত চিন্তাকুল হইলেন। পরিশেষে অতি তীব্র গরানলে দগ্ধপ্রায় হইয়া সেই নিরহুঙ্কার মনোহরা কামিনীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে সুন্দরি! তুমি কে? কাহার পরিগৃহীতা? এখানেই বা কি নিমিত্ত আসিয়াছ এবং কি কারণেই বা একাকিনী এই জনশূন্য অরণ্যে সঞ্চরণ করিতেছ? তোমার সাঙ্গ অতি সুন্দর ও নানাবিধ অলঙ্কারে অলঙ্কত; কিন্তু বোধ হয়, তোমার এই মনোহারিণী মূর্তিই যেন সকল অলঙ্কারের অলঙ্কারস্বরূপ হইয়াছে। তোমাকে দেবনারী বা অরকুমারী, যক্ষের বা রাক্ষসী, গন্ধর্বকুলজা বা নাগবনিত। বলিয়া বোধ হয় না; তুমি মানুষ ও নও। আমি যত স্ত্রীলোক দেখিয়াছি বা শুনিয়াছি, কেহই তোমার সদৃশ হইতে পারে না। হে চারুবদনে! আমি তোমার চন্দ্র হইতেও কমনীয় মুখমণ্ডল নিরীক্ষণ করিয়া অবধি কন্দর্পরে একান্ত জর্জরিত হইয়াছি।
ভূপাল সেই নির্জন অরণ্যানীমধ্যে নিতান্ত কাতর ও একান্ত কামার্ত হইয়া কন্যাকে বারম্বার এইরুপ কহিতে লাগিলেন, কিন্তু কিছুই প্রত্যুত্তর পাইলেন না; অনন্তর সেই কামিনী সৌদামিনীর ন্যায় তৎক্ষণাৎ তথা হইতে অন্তর্হিত হইলে রাজ। উম বৎ হার অনুসন্ধানে ইতস্তত ভ্রমণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাঁহাকে আর দেখিতে পাইলেন। কন্যার অদর্শনে রাজা বহুবিধ বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া মুহূৰ্তকাল নিশ্চেষ্ট হইয়; তথায় দণ্ডায়মান রহিলেন।