১৭০তম অধ্যায়
দানবগণের মায়াযুদ্ধ
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে রাজন! অনন্তর নিবাতকবচগণ বহুবিধ আয়ুধ ধারণপূর্ব্বক মহাবেগে আমার প্রতি ধাবমান হইল এবং আমার রথের পথরোধ ও পরিবেষ্টন করিয়া চারিদিক হইতে আমার প্রতি আক্রোশ প্রকাশ এবং অনবরত শরবর্ষণ করিতে লাগিল। পরে অন্যান্য মহাবলপরাক্রান্ত দুৰ্দান্ত দানবেরা শূল, পট্টিশ প্রভৃতি সুতীক্ষ্ণ অস্ত্রশস্ত্ৰ হস্তে লইয়া আমার প্রতি নিক্ষেপ করিল এবং আমার রথােপরি গদা, শক্তি ও সুমহৎ শূলবৃষ্টি করিতে লাগিল। অনন্তর রণস্থলে কালরূপী মহাঘোর প্রহরণধারী নিবাতকবচগণকে একে একে গাণ্ডীবমুক্ত অজিহ্মগ [ঋজুগামী-যাহা সোজাসুজি যায়] দশ দশ বাণদ্বারা বিনাশ করিলাম। এই ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়া অবশিষ্ট সকলেই পলায়ন করিল।
“তখন মাতলি বায়ুবেগে সুপ্ৰণালীক্ৰমে অশ্বচালনা করিলে তাহারা বহুবিধ পথপৰ্য্যটন করিয়া অসুরগণকে মন্থণ করিতে লাগিল। সেই রথে শত শত অশ্ব যোজিত ছিল, কিন্তু তৎকালে মাতলির সুকৌশলে পরিচালিত হইয়া তাহাদিগকে নিতান্ত অল্পসংখ্যক বলিয়া বোধ হইল; কোনক্রমেই বিশৃঙ্খল হইল না। অশ্বের চরণপাত, রথচক্রের ঘর্ঘর-শব্দ ও আমার শরবর্ষণে শত শত অসুরেরা প্ৰাণপরিত্যাগ করিল। তখন অশ্বেরা হতশরাসন ধরাতলপতিত গতাসু অসুর ও সারথিদিগকে চরণদ্বারা আকর্ষণ করিতে লাগিল। অনন্তর নিবাতকবচগণ দিগ্বিদিকসকল রোধ করিয়া আমার প্রতি বহুবিধ অস্ত্ৰক্ষেপ করিতে লাগিল। তখন আমার মন সাতিশয় উৎকণ্ঠাকুল হইয়া উঠিল, কিন্তু মাতলির কি আশ্চৰ্য্য শিক্ষাকৌশল ও অদ্ভুত বীৰ্য্য! তিনি অনায়াসেই সেই মহাবেগে ধাবমান তুরগগণের রশ্মি সংযত করিলেন। পরে আমি আশুগামী বিচিত্ৰ অস্ত্ৰদ্বারা শতসহস্ৰ অস্ত্ৰধারী অসুরগণকে ছিন্নভিন্ন করিলাম।
“ইন্দ্রসারথি মাতলি যুদ্ধে আমার এইরূপ অসাধারণ নৈপুণ্য সন্দর্শন করিয়া সাতিশয় প্রীত হইলেন। অসুরেরা অনেকেই অশ্ব ও রণদ্বারা বিনষ্ট হইল, কতকগুলি পলায়ন করিল, কেহ কেহ বা শরপীড়িত ও আমাদিগের কর্ত্তৃক ভৎসিত হইয়া শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক আমাকে আচ্ছন্ন করিল। তখন আমি অবিলম্বেই মন্ত্রপূত ব্ৰহ্মাস্ত্রদ্বারা শতসহস্ৰ অসুরগণকে দগ্ধ করিলাম। তাহারা একান্ত নিপীড়িত হইয়া ক্ৰোধাভরে শক্তি, শূল ও অসি-বর্ষণদ্বারা পুনরায় আমাকে নিতান্ত উত্ত্যক্ত করিলে পর আমি সুতীক্ষ্ণ তেজঃসম্পন্ন দেবরাজের দয়িত মাধব নামক এক উৎকৃষ্ট অস্ত্ৰগ্ৰহণ করিয়া সহস্ৰ সহস্ৰ ডোমার প্রভৃতি শক্ৰপ্ৰযুক্ত অস্ত্ৰ সকল খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলাম। অনন্তর রোষপরবশ হইয়া দশ দশ বাণদ্বারা অসুরদিগের এক একজনকে বিদ্ধ করিতে লাগিলাম। তৎকালে আমার গাণ্ডীব হইতে ভ্রমরমালার ন্যায় শরনিকর নিৰ্গত হইলে মহাত্মা মাতলি ধন্যবাদ প্ৰদান করিতে লাগিলেন এবং অসুরেরা যে সমস্ত বাণ প্রয়োগ করিল, তিনি তাহারও সমুচিত প্ৰশংসা করিলেন। অসুরেরা পুনরায় আমার প্রতি অস্ত্রনিক্ষেপ করিলে আমিও বাণদ্বারা অসুরগণকে বিদ্ধ করিতে লাগিলাম। অনন্তর যেমন প্রাবৃট্কালে পর্ব্বতশৃঙ্গ হইতে অবিরল জলধারা নিপতিত হইতে থাকে, তদ্রূপ অসুরদিগের ক্ষতবিক্ষত গাত্ৰ হইতে শোণিতধারা বিগলিত হইতে লাগিল। পরে দানবেরা অশনিসমস্পর্শ অতিবেগগামী অজিহ্মগ মদীয় বাণদ্বারা বধ্যমান হইয়া নিতান্ত উদ্বিগ্নচিত্তে আমার সহিত মায়াযুদ্ধ আরম্ভ করিল।”