১৬তম অধ্যায়
দ্রৌপদী-তিরস্কারে কীচকের ক্ৰোধ
কীচক কহিল, “হে সুশ্রোণি! নির্বিঘ্নে আসিয়াছ ত? আঃ! অদ্য আমার রজনী সুপ্ৰভাত হইল! আইস, এক্ষণে আমার প্রিয়ানুষ্ঠান কর। আমার পরিচারকেরা তোমার নিমিত্ত নানা দেশ হইতে হেমহার, শঙ্খ, বলয়, কুণ্ডল, কৌষেয় বস্ত্ৰ, উৎকৃষ্ট অজিন ও বিবিধ রত্নজাত আহরণ করবে। আমি তোমার নিমিত্ত এক পরম-রমণীয় শয্যা প্ৰস্তুত করিয়াছি; চল, এক্ষণে আমরা তথায় গিয়া মধুপান করি।”
দ্রৌপদী কহিলেন, “রাজমহিষী আমাকে সূরা আহরণ করিবার নিমিত্ত তোমার নিকট প্রেরণা করিয়াছেন। তিনি কহিলেন, “আমি বলবতী পিপাসায় একান্ত কাতর হইয়াছি, অতএব তুমি সত্বর পানীয় আনয়ন কর’।” কীচক কহিল, “তুমি রাজমহিষীর নিকট যাহা প্রতিশ্রুত হইয়া আসিয়াছ, তাহা অন্যে লইয়া যাইবে।” এই বলিয়া দুরাত্মা কীচক দ্রৌপদীর দক্ষিণকর ধারণ করিল। তখন দ্রৌপদী কহিলেন, “অরে পাপাত্মন! আমি গর্ব্বপূর্ব্বক মনেও কখন পতিদিগকে অনাদর করি নাই, অদ্য সেই পুণ্যবলে অবশ্যই তোকে পরাভূত দেখিব।”
দুরাত্মা কীচক দ্রৌপদীর এইরূপ তিরস্কার-বাক্য শ্রবণ করিয়া সহসা তদীয় উত্তরীয়বস্ত্ৰ গ্ৰহণ করিল। তখন দ্রৌপদী নিতান্ত অসহমান হইয়া ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কম্পিতকলেবরে ক্রোধাভরে বলপূর্ব্বক তাহাকে ভূতলে নিক্ষেপ করিলেন। কীচক তৎক্ষণাৎ ছিন্নমূল বৃক্ষের ন্যায় নিপতিত হইল।
কীচককর্ত্তৃক দ্ৰৌপদীর কেশাকর্ষণ-পদাঘাত
দ্রৌপদী কীচককে এইরূপে নিক্ষেপ করিয়া, যে স্থানে রাজা যুধিষ্ঠির উপবিষ্ট আছেন, দ্রুত পদসঞ্চারে সেই সভামণ্ডপে সমুপস্থিত হইলেন। কীচকও দ্রুতপদসঞ্চারে তথায় গমনপূর্ব্বক সহসা দ্রৌপদীর কেশপাশ আকর্ষণপূর্ব্বক ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া ভূপালসমক্ষেই তাঁহাকে পাদপ্রহার করিল। তখন সূৰ্য্যপ্রেরিত রক্ষক রাক্ষস ক্রোধাবিষ্ট হইয়া বায়ুবেগে কীচককে আঘাত করিল। দুরাত্মা কীচক রাক্ষসের আঘাতে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া ছিন্নমূল বৃক্ষের ন্যায় তৎক্ষণাৎ নিশ্চেষ্ট ও বিঘূর্ণিত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল।
অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ও ভীম প্রত্যক্ষে প্রিয়তমা দ্রৌপদীর কীচককৃত পরাভব-দর্শনে নিতান্ত সন্তপ্ত হইলেন। মহামনাঃ ভীমসেন কীচকবধাখিলাষে রোষাবিষ্ট হইয়া দশনে দশন নিষ্টেষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার লোচনদ্বয় রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল এবং উন্নত পক্ষ্মসকল ক্ৰোধানলের ধূমশিখাস্বরূপ বোধ হইতে লাগিল। ললাটদেশ স্বেদ ও ভ্রূকুটি দ্বারা নিতান্ত কুটিল হইয়া উঠিল; তিনি করতল দ্বারা ললাট-মদন ও ক্ৰোধাভরে বারংবার উত্থিত হইবার উপক্ৰম করিতে লাগিলেন। তখন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বৃকোদরকে মত্তমাতঙ্গের ন্যায় বনস্পতির প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে দেখিয়া আত্ম-প্রকাশভয়ে স্বীয় অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা তাঁহার অঙ্গুষ্ঠমর্দ্দন করিয়া নিবারণপূর্ব্বক কহিলেন, “হে সূদ! তুমি কি কাষ্ঠের নিমিত্ত বৃক্ষ অবলোকন করিতেছ? যদি তোমার কাষ্ঠের প্রয়োজন হইয়া থাকে, তবে বহির্দেশের বৃক্ষ হইতে কাষ্ঠ আহরণ কর।”
অনন্তর দ্ৰৌপদী আকার ও ধর্ম্মানুগত প্ৰতিজ্ঞা রক্ষা করিয়া অবিরল-বিগলিত-বাষ্পাকুল-লোচনে দীনচেতাঃ ভর্ত্তৃগণকে অবলোকনপূর্ব্বক সমুপস্থিত হইয়া অতি কঠোর দৃষ্টিপাতে সমুদয় দগ্ধ করিয়াই যেন বিরাটকে কহিলেন, “হে মহারাজ! যাঁহাদিগের পার্ষ্ণিগ্রহণগণ [পাঁচখানা গ্রামের ব্যবধানে স্থিত বিপক্ষ] ও ভয়ে রাত্রিকালে সুখে নিদ্রিত হয় না, যে সমস্ত সত্যনিরত ও ব্রাহ্মণপ্ৰিয় ব্যক্তিরা অর্থাদিগকে অর্থদান করিয়া থাকেন, অন্যের নিকট কদাচ প্রার্থনা করেন না, যাঁহাদিগের দুন্দুভিধ্বনি ও জ্যানিৰ্ঘোষ নিরন্তর কর্ণগোচর হইয়া থাকে, যাহারা অসাধারণ তেজস্বী, দান্ত, বলবান ও সম্ভ্রান্ত, যাহারা মনে করিলে সমুদয় লোক সংহার করিতে পারেন, দুরাত্মা কীচক তাঁহাদিগের মানিনী প্ৰণয়িনীকে পদাঘাত করিয়াছে। যাঁহারা শরণার্থীর একমাত্র শরণ, যাঁহারা প্রচ্ছন্নভাবে এই পৃথিবীতে সঞ্চরণ করিতেছেন, আদ্য তাঁহারা কোথায় রহিলেন? সেই সকল মহাবলপরাক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রিয়তমাকে কীচককর্ত্তৃক পরাভূত দেখিয়া হীনবীৰ্য্যের ন্যায় কেনই বা উপেক্ষা করিতেছেন? এক্ষণে তাঁহাদিগের অমর্ষ ও বলবীৰ্য্য কোথায় রহিল? হায়! দুরাত্মা কীচক আমাকে পরাভব করিতেছে, এক্ষণে তাঁহারাও কিছুই প্ৰতীকার করিলেন না।
“অদ্য জানিলাম, বিরাটরাজ নিতান্ত অধাৰ্মিক, যেহেতু, তিনি এই নিরপরাধিনী অবলার নিগ্ৰহ দেখিয়াও অনায়াসে উপেক্ষা করিয়াছেন। হায়! যখন রাজা কিছুই বিবেচনা করিলেন না, আমি ইহার কি করিব> ইনি রাজা, কিন্তু দুরাত্মা কীচকের প্রতি রাজার ন্যায় কিছুই আচরণ করিতেছেন না। হে মহারাজ! আপনার দস্যুজনসদৃশ এই ধর্ম্মসভামধ্যে কিছুই শোভা পাইতেছে না। এই দুরাত্মা আপনার সমক্ষে আমাকে পরাভব করিল, ইহা নিতান্ত বিসদৃশ হইয়াছে। হে সভ্যগণ! আপনারা কীচকের এই ব্যতিক্রমের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। কীচক অধাৰ্মিক এবং বিরাটও ধর্ম্মজ্ঞ নহেন, আর যাঁহারা ইঁহার উপাসনা করিতেছেন, সেই সমস্ত সভ্যেরাও ধাৰ্মিক বলিয়া পরিগণিত হইতে পারেন না।”
দ্ৰৌপদী অশ্রুমুখী হইয়া এবম্প্রকার রাজাকে তিরস্কার করিলে তিনি কহিলেন, “আমি তোমাদিগের বিগ্রহের বিষয় আদ্যোপান্ত অবগত নহি, অতএব যথার্থ তত্ত্ব না জানিয়া কিরূপে বিচার করিব?”
অনন্তর সভ্যেরা সবিশেষ পরিজ্ঞাত হইয়া কীচকের নিন্দা ও পুনঃ পুনঃ দ্রৌপদীর সাধুবাদপূর্ব্বক কহিলেন, “এই বরবর্ণিনী যাঁহার ভাৰ্য্যা, তিনি পরম ভাগ্যবান, কদাচ তাঁহার অন্তঃকরণে শোক-সন্তাপ প্রবেশ করিতে পারে না। ঈদৃশী সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী মনুষ্যলোকে দুর্লভ, বোধ হয়, ইনি কোন দেবী হইবেন।” সভাসদগণ দ্ৰৌপদীকে অবলোকন করিয়া এইরূপে তাহার প্ৰশংসা করিতে লাগিলেন।
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির স্বীয় প্ৰেয়সীর দুর্দ্দশা-দর্শনে নিতান্ত ক্রোধসন্তপ্ত হইলেন, রোষভরে তাঁহার ললাট হইতে স্বেদবিন্দুসমুদয় বহির্গত হইতে লাগিল। তখন তিনি ক্ৰোধ সংবরণপূর্ব্বক দ্রৌপদীকে কহিলেন, “সৈরিন্ধ্রী! আর এ স্থানে থাকিবার আবশ্যক নাই, তুমি সত্বর সুদেষ্ণার আলয়ে গমন কর। বীরপত্নীগণ স্বামীর নিমিত্ত অশেষবিধ ক্লেশভোগ করিয়া চরমে পতিলোক প্ৰাপ্ত হয়েন; বোধ হয় অদ্যপি তোমার পতিগণের ক্রোধের সময় উপস্থিত হয় নাই; তাহা হইলে অবশ্যই সেই সূৰ্য্যসদৃশ তেজস্বী গন্ধর্ব্বেরা তোমার নিকট আগমন করিতেন। হে সৈরিন্ধ্রী! তুমি নিতান্ত কালানভিজ্ঞ, কেন বৃথা রাজসভায় শৈলুষীর [নির্লজ্জা নটী] ন্যায় ক্ৰন্দনপূর্ব্বক ক্রীড়মান মৎস্যগণের [মৎস্যরাজপুরনিবাসীদিগের] বিয়োৎপাদন করিতেছ, এক্ষণে গমন কর; গন্ধর্ব্বেরা উপযুক্ত সময়ে তোমার অপ্রিয়কারীর প্রাণসংহার পূর্ব্বক তোমার প্রিয়কাৰ্য্য করবেন, তাঁহারা অবশ্যই তোমার দুঃখাপনোদন করিবেন।”
যখন দ্রৌপদী কহিলেন, “যাহারা জ্যেষ্ঠের দূতক্রীড়ানিবন্ধন সাতিশয় শোচনীয় দশা প্রাপ্ত হইয়াছেন, আমি তাঁহাদের নিমিত্ত দুরাত্মাদিগের সংহার করিবেন।”
কৃষ্ণা এই কথা বলিয়া কেশপাশ বিমোচনপূর্ব্বক রোষকষায়িতলোচনে সুদেষ্ণার নিকট গমন করিলেন। পরিশেষে রোদন নিরস্ত হইয়া নেত্ৰজল মার্জিত করিলে তাঁহার মুখমণ্ডল জলধারবিনিমুক্ত শশাঙ্কের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তখন সুদেষ্ণা কহিলেন, “হে শোভনে! কে তোমাকে প্রহার করিয়াছে? তুমি কেন রোদন করিতেছ? অদ্য কাহার সুখ তিরোহিত হইল? কে তোমার বিপ্রিয়ানুষ্ঠান করিয়াছে?” দ্রৌপদী কহিলেন, “আমি আপনার নিমিত্ত সূরা আনয়ন করিতে গমন করিয়াছিলাম, পাপাত্মা কীচক নির্জন কাননের ন্যায় সভামধ্যে ভূপাল-সমক্ষে আমাকে প্রহার করিয়াছে।” সুদেষ্ণা কহিলেন, “দুরাত্মা কীচক কামোন্মত্ত হইয়া তোমাকে অবমাননা করিয়াছে, অতএব তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে বল, আমি নিশ্চয়ই তাহাকে বিনাশ করিব।” দ্রৌপদী কহিলেন, “সেই দুরাত্মা যাঁহাদিগের অপকার করিয়াছে, সেই মহাত্মারাই তাহাকে সংহার করিবেন, বোধ হয়, অদ্যই তাহাকে যমালয়ে গমন করিতে হইবে।”