১৬৮তম অধ্যায়
ভীষ্মের পুনৰ্ব্বার সন্ধি-বিগ্রহাদি রাজনীতি কথন
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ। কিরূপ মনুষ্য শান্তস্বভাব? কাহারা ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান সময়ে হিতকাৰ্য্য করিয়া থাকে, তৎসমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন। হিতকারী ও হিতবাক্যশ্রোতা সুহৃদ্ অতি দুর্ল্লভ; অতএব আমার মতে অতুল ঐশ্বৰ্য্য, সম্বন্ধী ও বান্ধবগণ অপেক্ষা সুহৃদ্ই শ্রেষ্ঠ।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! কোন্ কোন্ ব্যক্তির সহিত সন্ধি করা কৰ্ত্তব্য ও কোন্ কোন্ ব্যক্তির সহিত সন্ধি করা অকৰ্ত্তব্য, তাহা সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যাহারা লুব্ধ, ধৰ্ম্মবর্জ্জিত, শঠ, ক্ষুদ্রাশয়, পাপপরায়ণ, শঙ্কিতচিত্ত, উদযোগবিহীন, দীর্ঘসূত্রী, কুটিল, লোকনিন্দিত, গুরুদারাপহারী, ব্যসনাসক্ত, দুরাত্মা, নির্লজ্জ, নাস্তিক, বেদনিন্দক, কামাসক্ত, অসত্যপরায়ণ, লোকের দ্বেষভাজন, নিয়মলঙ্ঘনশীল, নিৰ্ব্বোধ, কৃতঘ্ন, ছিদ্রান্বেষণতৎপর, মৎসরান্বিত, সুরাপায়ী, নির্দ্দয়, দুঃশীল, অধীর, নৃশংস ও বঞ্চক; যাহারা সৰ্ব্বদা কুমন্ত্রণা করিয়া মিত্রের অপকার ও অন্যের অর্থ অপহরণ করিতে ইচ্ছা করে, মিত্রের নিকট উপযুক্ত ধন লাভ করিয়াও সন্তুষ্ট না হয়, মিত্রকে সতত অকার্য্যসাধনে নিযুক্ত করে, অনবহিত ও ক্রোধাবিষ্ট হইয়া অযোগ্য লোকের সহিত অকস্মাৎ বিরোধ এবং কল্যাণকর মিত্রগণকে পরিত্যাগ করিতে প্রবৃত্ত হয়, মিত্রের অজ্ঞানতানিবন্ধন অল্পমাত্র অপকার হইলেও তাহার প্রতি দ্বেষপরায়ণ হইয়া কেবল স্বকার্য্যসাধনের চেষ্টা করে, মিত্রের ন্যায় বাক্যপ্রয়োগ করিয়া শত্রুর ন্যায় কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয় হিতকাৰ্য্যকে বিপরীত জ্ঞান করে, মঙ্গলকাৰ্য্যে কদাচ প্রবৃত্ত না হয় এবং সতত প্রাণীগণের বধসাধনে নিরত থাকে, তাহাদিগের সহিত সন্ধি করা কদাপি বিধেয় নহে। যাঁহারা সৎকুলোদ্ভব, সদ্বক্তা, জ্ঞানবিজ্ঞান-বিশারদ, রূপগুণসম্পন্ন, সৎসংসর্গপরায়ণ, সৰ্ব্বজ্ঞ, লোভমোহবর্জ্জিত, মাধুৰ্য্যগুণসম্পন্ন, সত্যপ্রতিজ্ঞ, জিতেন্দ্রিয়, ব্যায়ামশীল, সৎকুলসম্ভূত, কুলরক্ষক ও নির্দোষ বলিয়া প্রথিত যথাশক্তি সৎকার করিলেই যাঁহারা পরিতুষ্ট হয়েন, যাঁহাদিগের অকস্মাৎ ক্রোধ বা বিরাগ উপস্থিত না হয়, যাঁহারা বিরক্ত হইয়াও মনকে পবিত্র রাখেন, স্বয়ং ক্লেশ স্বীকার করিয়াও সুহৃৎ-কাৰ্য্য সাধন করেন, মিত্রের প্রতি কদাচ বিরাগ-প্রদর্শনে প্রবৃত্ত না হয়েন, ক্রোধ, লোভ ও মোহের বশীভূত হইয়া মিত্রকে নির্দ্ধন পুরুষ ও যুবতী রমণীদিগের প্রতি বলপ্রকাশ করিতে পরামর্শ প্রদান না করেন, লোষ্ট্র ও কাঞ্চন সমান জ্ঞান করেন এবং মিত্রের প্রতি একান্ত অনুরাগনিবন্ধন আত্মাভিমানশূন্য হইয়া পরিজনদিগকে নিগ্রহ করিয়াও সুহৃৎকাৰ্য্যসাধনে যত্নবান্ হয়েন, তাঁহারাই সন্ধি করিবার উপযুক্ত পাত্র। যে নরপতি ঐ প্রকার লোকদিগের সহিত সন্ধিস্থাপন করেন, তাঁহার রাজ্য শুক্লপক্ষীয় চন্দ্রকিরণের ন্যায় দিন দিন পরিবর্দ্ধিত হইতে থাকে। অস্ত্রশস্ত্রবিশারদ জিতক্রোধ মহাবলপরাক্রান্ত ও কুলশীলগুণসম্পন্ন মহাত্মাদিগের সহিত সন্ধি করা সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। আমি ইহার পূর্বে যে যে প্রকার লোকের সহিত সন্ধিস্থাপন করিতে নিষেধ করিয়াছি, কৃতঘ্ন ও মিত্রঘাতক তাহাদের সকলের অপেক্ষা নিকৃষ্ট; অতএব সেই সমস্ত দুরাচারদিগকে যত্নপুৰ্ব্বক পরিত্যাগ করাই উচিত।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মিত্রদ্রোহী ও কৃতঘ্ন কাহাকে কহে, বিশেষরূপে শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইতেছে; অতএব আপনি উহা সবিস্তর কীৰ্ত্তন করুন।”
সংসর্গের দোষ—গৌতমের অধোগতি
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! এই উপলক্ষে উত্তরপ্রদেশনিবাসী স্লেচ্ছদিগের দেশে যাহা ঘটিয়াছিল, সেই পুরাতন বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা মধ্যদেশনিবাসী গৌতমনামে এক ব্রাহ্মণ ভিক্ষার্থে পর্য্যটন করিতে করিতে এক ব্রাহ্মণবজ্জিত গ্রামকে যারপরনাই সমৃদ্ধিসম্পন্ন দেখিয়া তন্মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। ঐ গ্রামে এক সৰ্ব্ববর্ণবিশেষজ্ঞ [সকল জাতির অবস্থায় অভিজ্ঞ] ধনবান দস্যু বাস করিত। ঐ দস্যু ব্রাহ্মণভক্তিপরায়ণ, সত্যপ্রতিজ্ঞ ও অতিশয় দানশীল ছিল। ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ সেই দস্যুর গৃহে উপনীত হইয়া তাহার নিকট এক বৎসরের উপযুক্ত খাদ্যসামগ্রী ও বাসস্থান প্রার্থনা করিলেন। ব্রাহ্মণ প্রার্থনা করিবামাত্র দস্যু তাঁহার বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট করিয়া তাঁহাকে নূতন বস্ত্র ও এক যুবতী, দাসী প্রদান করিল। তখন গৌতম যারপরনাই আহ্লাদিত হইয়া পরমানন্দে সেই দস্যুর গৃহে বাস করিয়া দাসী-কুটুম্বদিগের ভরণপোষণ করিতে লাগিলেন। ঐ স্থানে বাসনিবন্ধন তাঁহার বাণশিক্ষা করিতে বিশেষ যত্ন উপস্থিত হইল। তখন তিনি প্রত্যহ অরণ্যে উপস্থিত হইয়া দস্যুগণের ন্যায় বনবাসী হংসদিগকে বিনষ্ট করিতে আরম্ভ করিলেন। সৰ্ব্বদা দস্যুদিগের সহবাস হওয়াতে ক্রমে ক্রমে তাঁহার হিংসাপরায়ণ নির্দ্দয় হত্যাকারী দস্যুর ন্যায় আচরণ হইয়া উঠিল। তখন তিনি নিরন্তর কেবল পক্ষিবধবৃত্তি আশ্রয় করিয়াই সেই দস্যুগ্রামে পরমসুখে কালহরণ করিতে লাগিলেন।
“এইরূপে বহুদিন অতীত হইলে একদা এক জটাজিনধারী স্বাধ্যায়নিরত বিনীতমূৰ্ত্তি দেবজ্ঞ ব্রাহ্মণ সেই দস্যুগ্রামে সমাগত হইলেন। ঐ পবিত্রস্বভাব ব্রহ্মচারী গৌতমের প্রিয়সখা ছিলেন। তিনি কদাচ শুদ্ৰান্ন প্রতিগ্ৰহ করিতেন না, সুতরাং সেই দস্যুসমাকীর্ণ গ্রামে ব্রাহ্মণগৃহ অন্বেষণপূৰ্ব্বক চারিদিক পৰ্য্যটন করিতে করিতে পরিশেষে গৌতমগৃহে প্রবেশ করিলেন। ঐ সময়ে গৌতমও হংসভার স্কন্ধে লইয়া শরাসন ও অস্ত্র ধারণপূৰ্ব্বক রুধিরাক্ত কলেবরে স্বীয় আবাসে সমুপস্থিত হইলেন। সমাগত দ্বিজবর গৌতমকে গৃহদ্বারে উপস্থিত দেখিবামাত্র তাঁহাকে চিনিতে পারিয়া সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে বিপ্র! তুমি মধ্যদেশে সদ্বংশে জন্মগ্রহণপূৰ্ব্বক মোহবশতঃ কি নিমিত্ত দস্যুভাবাপন্ন ও গর্হিত কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছ? এক্ষণে পূর্ব্বতন বেদপারগ বিখ্যাত জ্ঞানিগণকে স্মরণ করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। তুমি সেই মহাত্মাদিগের কুলের কলঙ্কস্বরূপ হইয়াছ। যাহা হউক, অতঃপর স্বয়ং আপনার তত্ত্ব অনুধ্যানপূর্ব্বক সত্য, শীল, দম ও দয়ার অনুবর্ত্তী হইয়া অবিলম্বে এই স্থান পরিত্যাগ করা তোমার উচিত।
‘আগন্তুক ব্রহ্মচারী এই কথা কহিলে গৌতম আর্ত্তস্বরে তাঁহাকে কহিলেন, মহাত্মন্! আমি নিৰ্দ্ধন ও বেদজ্ঞানবিহীন, এই নিমিত্তই ধনাকাঙ্ক্ষী হইয়া এই স্থানে আগমন করিয়াছি। আজ আপনাকে দর্শন করিয়া কৃতার্থ হইলাম। আপনি অনুগ্রহ করিয়া এই রজনী আমার আবাসে অতিবাহিত করুন; কল্য প্রাতঃকালে আমরা উভয়েই এ স্থান হইতে প্রস্থান করিব। গৌতম এই কথা কহিলে ব্রহ্মচারী তাঁহার প্রতি দয়া করিয়া সে রাত্রি সেই স্থানেই অবস্থান করিলেন; কিন্তু নিতান্ত ক্ষুধিত হইয়াও কোন বস্তু ভোজন বা স্পর্শ করিলেন না।”