১৬৭তম অধ্যায়
পাণ্ডবপক্ষের রথিপরিচয়-যুধিষ্ঠিরাদির শৌৰ্য্য
“ভীষ্ম কহিলেন, ‘দুৰ্য্যোধন। তোমার রখী, অতিরথ ও অৰ্দ্ধরথসংখ্যা কীর্ত্তন করিলাম; এক্ষণে যদি পাণ্ডবগণের রথিসংখ্যা শ্রবণ করিতে কৌতুহল হইয়া থাকে, তাহা হইলে তুমি এই সকল ভূপালগণের সহিত অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। রাজা যুধিষ্ঠির স্বয়ং রথী, তিনি হুতাশনের ন্যায় সমরে সঞ্চরণ করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। ভীমসেন একাকী অষ্টরখীর সমান। অযুত নাগতুল্য বলশালী; তাঁহার সদৃশ গদা ও বাণযুদ্ধ করিতে কেহই সমর্থ হয় না। তেজঃপ্রভাবে তাঁহাকে সামান্য মনুষ্য বলিয়া বোধ হয় না। মাদ্রীতনয় নকুল ও সহদেব উভয়েই রথী; তাহারা তেজ ও সৌন্দর্ঘ্যে অশ্বিনীকুমারের তুল্য। তাঁহারা সেনামুখে উপস্থিত হইয়া ক্লেশপরম্পরা সংস্মরণপূর্ব্বক রুদ্রের ন্যায় সঞ্চরণ করিবেন, ইহাতে কিছুমাত্ৰ সংশয় নাই। তাঁহারা সকলেই শালতরুর ন্যায় উন্নত এবং অন্যান্য পুরুষ অপেক্ষা প্রদেশ[বিস্তারিত অঙ্গুষ্ঠ অঙ্গুলীর অগ্রভাগ হইতে বিস্তারিত তর্জ্জনীর অগ্রভাগ পর্য্যন্ত]প্রমাণ উচ্চ। তাঁহারা সকলেই ব্ৰহ্মচৰ্য্য ও তপানুষ্ঠান করিয়াছেন এবং সকলেই বলসম্পন্ন; তাঁহারা দিগ্বিজয়কালে সমস্ত ভূপালগণকে পরাজিত করিয়াছিলেন এবং বেগ, প্রহার ও যুদ্ধ বিষয়ে অলৌকিকতা [লোকাতীত ক্ষমতা] লাভ করিয়াছেন। কেহই তাঁহাদিগের শরাসনে জ্যারোপণ বা আয়ুধ, গদা ও শরজাল সহ্য করিতে সমর্থ হয় না। তাঁহারা বালক হইয়াও গরীয়সী [গুর্বী-গুরুভারযুক্তা] গদা উত্তোলন, শরনিক্ষেপ, লক্ষ্যভেদ, মর্ম্মপীড়ন, মুষ্টিযুদ্ধ ও বেগে তোমাদের অপেক্ষা সমধিক উৎকর্ষ লাভ করিয়াছেন; তাঁহারা তোমাদের এই সকল সৈন্য সংহার করিবেন; অতএব তোমরা কদাচ তাঁহাদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইও না। রাজসূয় যজ্ঞে যেরূপ ঘটনা হইয়াছিল, এক্ষণেও তদ্রূপ তাঁহারা তোমার সমক্ষেই সমরে সমস্ত ভূপালগণকে একে একে বিনাশ করবেন। তাঁহারা দ্রৌপদীর ক্লেশ ও দ্যূতক্ৰীড়াকালীন অতি কঠোর বাক্যসমুদয় স্মরণ করিয়া রুদ্রের ন্যায় রণস্থলে সঞ্চারণ করিবেন।
অর্জ্জুনের বলবীৰ্য্য
“ ‘উভয় পক্ষের সৈন্যগণমধ্যে লোহিতলোচন [রক্তনেত্র] অর্জ্জুনের তুল্য বীর ও রথী। আর নাই। অধিক কি, পূর্ব্বে দেবতা, উরগ, রাক্ষস
এবং য
ক্ষগণমধ্যেও তাঁহার তুল্য রথী আর দৃষ্টিগোচর হয় নাই, পরেও হইবে না; নরলোকে ত’ কোন কথাই নাই। অর্জ্জুনের রথ সুসজ্জিত, বাসুদেব সারথি, অর্জ্জুন স্বয়ং রথী, গাণ্ডীব শরাসন, অশ্বসকল বায়ুবেগগামী, কবচ অভেদ্য, তুণীরদ্বয় অক্ষয়, গদাসকল অতি ভীষণ, মহেন্দ্ৰ [ইন্দ্ৰ], পাশুপত [পশুপতি], রৌদ্র [রুদ্র], কৌবের [কুবেরা], যাম্য [যম] ও বারুণ [বরুণপ্রদত্ত] অস্ত্ৰ তাঁহার অধিকৃত এবং বাজপ্রভৃতি নানাপ্রকার উৎকৃষ্ট অস্ত্রশস্ত্ৰসকল তাঁহার আয়ত্ত রহিয়াছে। তিনি একমাত্র রথে আরোহণ করিয়া হিরণ্যপুরবাসী সহস্ৰ সহস্ৰ দানবকে বিনষ্ট করেন; তাঁহার তুল্য রাখী আর দৃষ্টিগোচর হয় না। তিনি স্বীয় সৈন্যগণকে নির্ব্বিঘ্নে রাখিয়া তোমার সৈন্যদিগকে বিনষ্ট করিবেন। হয় আমি, না হয় আচাৰ্য্য তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ উভয় সৈন্যমধ্যে তাঁহার শরবর্ষণ সহ্য করে, এমন কেহই নাই। যেমন সমীরণ গ্ৰীষ্মাবসানে জলধরের সাহায্য করে, তদ্রূপ বাসুদেব অর্জ্জুনের সাহায্য করিয়া থাকেন। অর্জ্জুন যুবা, আমরা উভয়েই বৃদ্ধ।”
“তখন সভাস্থ সমস্ত নৃপতি মহাবীর ভীষ্মের মুখে এই সমস্ত কথা শ্রবণপূর্ব্বক পাণ্ডবদিগের পূর্ব্বতন সামর্থ্য স্মরণ করিয়া নিতান্ত ক্ষুব্ধ হইলেন। তাঁহাদিগের স্থূল অঙ্গদযুক্ত চন্দনবিভূষিত ভুজন্দ্বয় একান্ত বিস্রস্ত [শিথিল] হইয়া পড়িল, দেখিলে বোধ হয়, যেন তাহারা পাণ্ডবগণের পরাক্রম প্রত্যক্ষ করিতেছেন।”