১৬৭. দ্রুপদের পুত্রেষ্টিযজ্ঞের ইচ্ছা, যজ্ঞার্থ দ্রুপদের পুরোহিত অন্বেষণ মহর্ষি যাজের পৌরোহিত্য স্বীকার, দ্রুপদের যজ্ঞারম্ভ, যজ্ঞাগ্নি হইতে ধৃষ্টদ্যুম্নের উদ্ভব, অগ্নি হইতে দ্রৌপদীর উদ্ভব
সপ্তষষ্ট্যধিকশততম অধ্যায়।
ব্রাহ্মণ কহিলেন, তখন দ্রুপদরাজ রোষাবিষ্ট হইয়া যাজনকর্মদক্ষ ব্রাহ্মণগণের অন্বেষণে আশ্রমে আশ্রমে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। সন্তান নাই কলিয়া তিনি অতিশয় বিলাপ ও পরিতাপ করিতেন এবং একটি উপযুক্ত পুত্রের মুখচন্দ্রমা সন্দর্শনার্থে চিন্তায় একান্ত নিমগ্ন হইলেন। দ্রোণের অপকার করিবার নিমিত্ত তিনি বারম্বার দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতেন, কিন্তু তদীয় অলৌকিক প্রভাব, বিনয়, শিক্ষা, কিচিত্ৰচরিত্র ও ক্ষাত্রবল আলোচনা করি কিরূপে প্রতীকার করিব, ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।
অনন্তর দ্রুপদ ভাগীরথীতীরে কল্মাষীর উভয় পার্শ্বে ভ্রমণ করিতে করিতে একদা এক আশ্রমে উপনীত হইলেন। তথায় অস্নাতক ও অব্ৰতী কেহই ছিলেন না। তন্মধ্যে দেখিলেন, সংশিতব্রত যাজ ও উপযাজ নামক দুই ব্রহ্মর্ষি রহিয়াছেন; তাহারা শান্তগুণাবলম্বী, সংহিতাপাঠে অভিনিবিষ্ট,কাশ্যপগোত্রসম্ভূত ও যুক্তরূপশালী। দ্রুপদ বিলম্ব না করিয়া বিনীতভাবে তাঁহাদিগের নথেতি সম্বর্ধনা করিলেন, উভয়ের বলদ্ধি বিবেচনা করিয়া নির্জনে কনিষ্ঠ উপাজের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং প্রিয়বাদী সৰ্বকামদাতা হইয়া সর্বপ্রণত্নে তদীয় অনুবৃত্তি ও চরণসেবাদ্বারা মহর্ষিকে তুষ্ট করিয়া যথোচিত সৎকারপূর্বক কহিতে লাগিলেন, হে ব্ৰহ্মন্! দ্রোণের বিনাশের নিমিত্ত যদি কোনরূপ দৈবকাৰ্যানুষ্ঠানদ্বারা আমার পুত্রোৎপাদন করিতে পারেন, তাহা হইলে আপনাকে এক অৰ্ব দ গো দান করিব অঙ্গীকার করিতেছি; অথবা আপনকার যাহা অভিলাস হয় তাহাই সফল করিব, সন্দেহ নাই। মহর্ষি দ্রুপদের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন,–রাজন্! আমি তোমার বাক্য স্বীকার করিতে পারি না। দ্রুপদ এইরূপ প্রত্যাখ্যাত হইলেও পুনর্বার উঁহার আরাধনা ও নানাপ্রকারে চিত্তানুবৃত্তি করিতে লাগিলেন।
অনন্তর সম্বৎসরকাল অতিক্রান্ত হইলে একদ। উপাজ দ্রুপদকে মধুর। বাক্যে সম্বোধন করিয়া কহিলেন,–মহারাজ! একদা মদীয় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এক নিবিড় অরণ্যানীমধ্যে সঞ্চরণ করিতে করিতে ভূতলে পতিত একটি ফল দেখিতে পাইলেন। যে স্থানে ঐ ফল পতিত হইয়াছিল, তাহার শৌচের বিষয় কিছুই পরিজ্ঞাত ছিলেন না। আমি তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতেছিলাম। দেখিলাম, তিনি ফল গ্রহণে কিছুমাত্র বিবেচনা করিলেন না এবং ফলেরও পাপাপুবন্ধক দোষের প্রতি কিছুমাত্র দৃষ্টি রাখিলেন না। অতএব যিনি এক স্থলে শৌচাশৌচ-পরিজ্ঞানে নিরপেক্ষ হইলেন, তিনি অন্যত্র তাহার বিচার করিবেন না। আরও যখন গুরুগৃহে বাস ও সংহিতা অধ্যয়ন করিয়া অন্যের উৎকৃষ্ট অন্ন ভোজন করেন এবং নির্ঘণ হইয়া বারম্বার উৎসৃষ্ট অন্নের গুণ কীর্তন করিয়া থাকেন, তখন তিনি কিছুতেই শৌচাশৌচের বিচার রাখিবেন না। এক্ষণে মামি বিচার করিয়া দেখিতেছি, তিনিই ফলকাঙক্ষী, অতএব তুমি তাঁহার নিকট গমন কর, তিনি তোমার পুলেষ্টিযজ্ঞে দীক্ষিত হইবেন।
মহারাজ দ্রুপদ এইরূপে প্রত্যাখ্যাত হইয়া অতিশয় চিন্তিত হইলেন এবং তদীয় নিদেশানুসারে মহর্ষি যাজের আশ্রমে প্রবেশপূর্বক তাঁহাকে যথোচিত সৎকার করিয়া কহিলেন,—বিভো! আমি আপনাকে অষ্ট অযুত গো দান করিব। আপনি আমার পুত্রেষ্টিযজ্ঞে দীক্ষিত হউন। দ্রোণের নিকট পরাভূত হইয়া আমি নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়াছি, এক্ষণে আত্মবিনোদনের নিমিত্ত আপনার শরণাপন্ন হইলাম। দ্বিজোত্তম দ্রোণ ব্রহ্মাস্ত্রে অদ্বিতীয়, অধিক কি, এই ধরাধামে ক্ষত্রিয় মধ্যেও দ্রোণের সম ধনুর্ধর আর কেহই নাই, এ কারণ আমি তাহার নিকট সখিযুদ্ধে পরাভূত হইয়াছি। তদীয় শরজাল প্রাণপহারক, কদাচ ব্যর্থ হইবার নহে। রণস্থলে ষড়রত্নি শরাসন তাহার হস্তে পরিদৃশ্যমান হয়। তিনি ব্রাহ্মণের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন বটে, কিন্তু নিঃসন্দেহ ক্ষত্রিয়তেজঃ প্রতিহত করিতে পারেন। সেই মহেম্বাস মহাবল দ্রোণ দ্বিতীয় পরশুরামের ন্যায় ক্ষত্রিয়দিগের উচ্ছেদের নিমিত্ত এই জীবলোকে অবতীর্ণ হইয়াছেন। তাঁহার অস্ত্রবল মহাঘোর ও ভয়ঙ্কর, নরলোকে কেহই তাহ সহ করিতে পারে না। তিনি লাহুতি প্রদীপ্ত হুতাশনের ন্যায় ব্রাহ্মতেজঃ ধারণ করেন এবং ক্ষত্রিয় ধর্মানুসারে রণক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া লক্ষ লোককে ভস্মসাৎ করিতে সমর্থ হয়েন। হে ঋজ! ব্রহ্ম ও ক্ষাত্ৰতেজ এই উভয়ের মধ্যে ব্রাহ্মতেজই উৎকৃষ্ট, অতএব আমি ক্ষত্রিয়বলে নিরপেক্ষ হইয়া ব্রাহ্মতেজের আশ্রয় লইতে মানস করিয়াছি এবং আপনকার অনুকম্পায় আমার প্রবলপরাক্রান্ত দ্রোণান্তক সন্তান জন্মিবে,এই আশয়ে আপনাকে অষ্ট অদ গো দান করিতে প্রস্তুত আছি। আপনি যথাবিধানে আমার এই পুত্রেষ্টিযজ্ঞ সমাধান করুন। তখন মাত্র ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাঁহার বাক্য অঙ্গীকারপূর্বক যক্ষ্মীয়দ্রব্যসম্ভার আহরণ করিতে আদেশ দিলেন। যদিও উপবাঙ্গ বিষয়বাসনাশূন্য ও নিতান্ত নিস্পৃহ, তথা মহৎ কর্ম সম্পাদন করিতে হইবে বলিয়া তিনি তাহাকে তদ্বিষয়ে ব্রতী করিলেন এবং যাজ গঢ়িতর অধ্যবসায় সহকারে দ্রোণবধে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইলেন।
অনন্তর মহাতপাঃ মহর্ষি উপযাজ মহীপাল দ্রুপদের পুত্রফলকামনায় যু অরম্ভ করিয়া কহিলেন,-মহারাজ! তোমার যাদৃশ অভিলাষ তদনুসারে মহাবীর্য্য মহাবল দ্রোণান্তক পুত্র উৎপন্ন হইবে। তাহার এইরূপ উত্তেজনাক্যে উৎসাহিত হইয়া দ্রুপদরাজ দ্ৰোণবিনাশের অভিসন্ধিতে যজ্ঞীয়দ্রব্যসম্ভার আহরণ করিতে লাগিলেন। তৎপরে উপযাজ জ্বলন্ত হুতাশবে পূৰ্ণাহুতি প্রদানকালে রাজমহিষীকে আহ্বানপূর্বক কহিলেন, ভদ্রে। তুমি পুত্র কন্যা উভয়ই প্রাপ্ত হইবে, আইস। মহিষী বিনয়বাক্যে কহিলেন, হে ব্রহ্ম! আমার মুখ অবলিপ্ত, গাত্রে দিব্য গন্ধ ধারণ করিতেছি; আমি সম্ভাব নিমিত্ত এরূপভাবে আপনার সন্নিধানে উপস্থিত হইতে পারি না; আপনি আমার প্রিয়হেতু ক্ষণকাল অপেক্ষা করুন।
যাজ কহিলেন,–হে রাজপত্নী! তুমি যাও বা থাক, যাজদত্ত ও উপযাজের মন্ত্রপূত সংস্কৃত হব্য কদাচ নিষ্ফল হইবে না, অবশ্য অভীষ্ট সম্পাদন করিবে; এই বলিয়া তিনি সৎকৃত ও প্রজ্বলিত অনলে আহুতি প্রদান করিলেন। আহতি প্রদান করিবামাত্র সহসা হুতাশনমধ্য হইতে দেবকুমারতুল্য সুকুমার এক কুমার উত্থিত হইলেন। প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার ন্যায় তাঁহার বর্ণ উজ্জ্বল, সুন্দর কিরীটদ্বারা তদীয় মস্তক অলঙ্কৃত, আকার অতি ভয়ঙ্কর, ধনুর্বাণ, বর্ম ও খড়গচর্ম ধারণ করিয়া বারংবার সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্বক দিব্যরথায়োহগে বহ্নিমধ্য হইতে নির্গত হইলেন। এই অদ্ভুত ব্যাপার অবলোকন করিয়া পাঞ্চালদেশীয় ইতর সাধারণ সকলেই প্রফুল্লমনে সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের হর্ষবেগ ও সিংহনাদ ভগবতী ধরিত্রীর ও স্বসহ হইল। তৎকালে এইরূপ আকাশবাণী হইল যে, “যশস্বী রাজকুমার দ্রোণবধের নিমিত্ত উদ্ভূত হইয়াছেন। ইহার বল অতি অদ্ভুত, ইনি পাঞ্চালদিগের ভয় দূর করিবেন।” ইত্যবসরে সর্বাঙ্গসুন্দরী এক কুমারী যজ্ঞবেদি মধ্য হইতে উত্থিত হইলেন, ত্রিভুবনে তদীয় রূপলাবণ্যের তুলনা ছিল না। তাহার বর্ণ শ্যামল, লোচনযুগল পদ্মপলাশের ন্যায় সুশোতন ও অতি বিস্তীর্ণ, কেশজাল নীল ও আকুঞ্চিত, পয়োধর পীন ও উন্নত, দ্বয় দেখিতে সুচারু, কন্যার গাত্র হইতে নীলোৎপলসদৃশ গন্ধ একক্রোশ পৰ্য্যন্ত ধাবিত হইতেছে। তাহাকে দেখিলে বোধ হয়, যেন মানুষীমূতি পরিগ্রহ করিয়া কোন দেবী পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়াছেন। ঐ দেবরূপিণী রমণী দেখিতে এমন চমৎকারিণী যে, দেখিলে দেব, দানব, গন্ধর্বের ও মন মোহিত হয়। এই কন্যা কালক্রমে ক্ষত্রিয়কুলক্ষয় করিয়া বিস্তর সুরকার্য সাধন করিবেন, ইহার নিমিত্ত কুরুবংশীয়দিগের অন্তঃকরণে সর্বদা আশঙ্কা থাকিবে”, সহস৷ এইরূপ আকাশবাণী উত্থিত হইল। ইহা শ্রবণ করিয়া পাঞ্চালের। সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন, তাহাদিগের ঐরূপ বেগ ভগবতী বসুন্ধরা সহ করিতে অসমর্থ হইলেন। তৎকালে রাজসহধর্শিণী, পুত্রার্থিনী হইয়া যাসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন এবং কন্যা পুত্রকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, হে যাজ! ইহারা আম। ভিন্ন অন্য কাহাকেও যেন জননী বলিয়া না জানে। যাজ রাজার প্রিয়ানুষ্ঠান মানসে “তথাস্তু” বলিয়া তাঁহার বাক্যে অঙ্গীকার করিলেন। পূর্ণমনোরথ ব্রাহ্মণেরা, বালক অতি প্রগম্ভ ও দ্যুম্নসম্ভূত বলিয়া তাহার নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন রাখিলেন এবং কন্যাটী কৃষ্ণবর্ণা প্রযুক্ত তাহাকে কৃষ্ণ নাম প্রদান করিলেন। এইরূপে দ্রুপদের মহাযজ্ঞে পুত্র, ও কন্যা উভয় উৎপন্ন হইল। প্রবল প্রতাপান্বিত দ্রোণ পাঞ্চালদেশ হইতে ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিজ নিলয়ে অনয়নপূর্বক অস্ত্রশিক্ষা করাইতে লাগিলেন এবং দৈব অনতিক্ৰমণীয় কদাচ অন্যথা হইবার নহে ভাবিয়া মহীয়সী আত্মকীর্তি স্থাপনার্থে ধৃষ্টদ্যুম্নের অস্ত্রশিক্ষা বিষয়ে একান্ত যত্ন করিতে লাগিলেন।