১৬৬. দ্রোণ-জন্মরহস্য
ষটষষ্ট্যাধিকশততম অধ্যায়।
ব্রাহ্মণ কহিলেন, গঙ্গাদ্বারে মহাপ্রাজ্ঞ মহাতপাঃ মহর্ষি ভরদ্বাজ অবস্থিতি করিতেন। একদা তিনি স্নানার্থ গঙ্গাতীরে গমন করিয়া দেখিলেন, ঘৃতাচী নাম্নী এক অপ্সরা তাঁহার আসিবার পূর্বে তথায় উপনীত হইয়া জাহ্নবীজলে অবগাহন ও স্নান করিয়া তীরে দণ্ডায়মান আছে। এই অবসরে সমীরণ তদীয় পরিধেয় বসন আকর্ষণ ও অপহরণ করিল। মহর্ষি সহসা অঙ্গরাকে বিবসনা দেখিয়া তাহার সহিত বিহার বাসনায় নিতান্ত কাতর হইয়া উঠিলেন। বলবতী অপ্সরাসম্ভোগস্পৃহায় একান্ত অধীর হইয়া কৌমার ব্রহ্মচারী মহর্ষির চিরসঞ্চিত রেতঃ তৎক্ষণাৎ স্থলিত হইল। রেতঃ স্খলিত হইবামাত্র মহর্ষি উহা দ্রোণমধ্যে স্থাপন করিলেন; তাহা হইতে ধীমান্ ভরদ্বাজের সুকুমার দ্রোণ নামে কুমার উৎপন্ন হইলেন। দ্ৰোণ বয়োবৃদ্ধি সহকারে সমুদায় বেদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করিলেন।
পৃষত নামক এক মহীপাল মহর্ষি ভরদ্বাজের পরম বন্ধু ছিলেন। তৎকালে তাঁহারও দ্রুপদনামে এক পুত্র উৎপন্ন হয়। দ্রুপদ প্রতিদিন আশ্রম প্রদেশে প্রবেশ করিয়া দ্রোণের সহিত ক্রীড়া ও অধ্যয়ন করিতেন। পৃষতরাজ কলেবর পরিত্যাগ করিলে দ্রুপদ পৈতৃক সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হইলেন। কিয়দিবস অতীত হইলে একদা দ্ৰোণ লোকমুখে শুনিলেন, পরশুরাম অর্থীদিগকে প্রার্থনাধিক অর্থ প্রদান করিয়া তপোনুষ্ঠানের নিমিত্ত অরণ্যে প্রবেশ করিয়াছেন। ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণ তথায় উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, হে দ্বিজোত্তম! আমি ভরদ্বাজের পুত্র দ্রোণ, কিঞ্চিৎ অর্থ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। পরশুরাম কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন্! আমি যাবতীয় অর্থ সমুদায় পাত্ৰসাৎ করিয়াছি, এক্ষণে অস্ত্র ও শরীরমাত্র অবশিষ্ট আছে। ইহার অন্যতর কি প্রদান করি, বল। দ্রোণ কহিলেন, ভগব! যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তাহা হইলে প্রয়োগ ও সংহারের সহিত সমুদায় অস্ত্র আমাকে প্রদান করুন। ভৃগুনন্দন রাম ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাঁহার বাক্য স্বীকারপূর্বক সমুদায় অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করিলেন। দ্রোণ অস্ত্রলাভ করিয়া চরিতার্থ হইলেন এবং অভীষ্ট ব্রহ্মাস্ত্রলাভে হৃষ্ট ও সন্তুষ্ট হইয়া আপনাকে সর্বোৎকৃষ্ট বোধ করিলেন।
অনন্তর প্রতাপশালী ভরদ্বাজ দ্রোণ দ্রুপদ সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া কহিলেন, মহারাজ! তোমার সখা দ্রোণ উপস্থিত হইয়াছে। তাহা শুনিয়া দ্রুপদ কহিলেন, ষাদৃশ অশ্রোত্রিয় শ্ৰেত্রিয়ের ও অরথী রথীর মিত্র হইতে পারে না, সেইরূপ যিনি রাজা নহেন, তিনি কি প্রকারে রাজার সখা হইতে পারেন। এই কথা শ্রবণ করিয়া দ্রোণ ভগ্নমনে হস্তিনা নগরীতে গমন করিলেন। ভীষ্ম অভ্যাগত দ্রোণ সন্নিধানে ধনুৰ্বেদ শিক্ষার্থে প্রভুত অর্থের সহিত স্বীয় পৌত্রদিগকে প্রেরণ করিলেন। দ্রোণ দ্রুপদের গর্ব খর্ব করিবার মানসে শিষ্যগণকে সম্মুখে আহ্বান করিয়া কহিলেন, হে শিষ্যগণ! যেরূপ গুরুদক্ষিণা আমার মনোনীত হয়, অস্ত্রশস্ত্র সম্যক শিক্ষা করিয়া তোমাদিগকে তাহা দিতে হইবে। এক্ষণে ইহা অঙ্গীকার কর! তখন অর্জুন প্রভৃতি শিষ্যসমবায় ‘তথাস্তু’ বলিয়া গুরুবাক্য স্বীকার করিলেন। তৎপরে পাণ্ডবদিগকে ধনুর্বেদে কৃতবিদ্য দেখিয়া দ্রোণ দক্ষিণা গ্ৰহণার্থ পুনর্বার কহিলেন, হে শিষ্যগণ! ছত্রবতী নগরীর অধিপতি পৃষতপুত্র দ্রুপদকে পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত করিয়া অচিরাৎ সেই রাজ্য আমাকে দক্ষিণাস্বরূপ প্রদান কর। পাণ্ডবেরা দ্রুপদকে যুদ্ধে পরাজয় করিয়া মন্ত্রীসমভিব্যাহারে তদীয় করচরণ বন্ধনপূর্বক দ্রোণ সন্নিধানে আনয়ন করিলেন। দ্রোণ দ্রুপদকে নেত্রগোচর করিয়া কহিলেন, হে যজ্ঞসেন! তোমার সহিত পুনরায় মৈত্রী স্থাপন করিবার প্রার্থনা করি। তুমি পূর্বে কহিয়াছিলে যে, যিনি রাজা। নহেন, তিনি রাজার সখা হইতে পারেন না, এই কারণে আমি রাজ্যগ্রহণে যত্ন করিয়াছি। এক্ষণে তুমি ভাগীরথীর দক্ষিণ কূলের রাজা হইলে, আর আমি উহার উত্তরাংশ শাসন করিব।
পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ ভরদ্বাজতনয় দ্রোণের বচনবিন্যাস শ্রবণ করিয়া কহিলেন, হে মহাভাগ! আপনি যাহা কহিতেছেন আমি তদ্বিষয়ে সম্মত আছি। আপনি কুশলে থাকুন, আপনার অভিমত মিত্ৰতাব পুনর্বার বদ্ধমূল হইল। পরস্পর পরস্পরকে এইরূপ কহিয়া তাহারা পূর্বসখ্য স্থাপনপূর্বক স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। কিন্তু এইরূপ অযোগ্য উপচার দ্রুপদের হৃদয়ে সর্বদা জাগরূ ক ছিল। তিনি দিনে দিনে নিতান্ত দুর্বল ও একান্ত বিমনাঃ হইতে লাগিলেন।