১৬৫তম অধ্যায়
সঙ্কুল যুদ্ধ যুধিষ্ঠিরপলায়ন
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! এইরূপে সেই সর্ব্বভূতবিনাশন ভীষণ রাত্রিযুদ্ধ উপস্থিত হইলে ধর্ম্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যের বিনাশের নিমিত্ত পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও সোমকগণকে সম্মুখাভিবৰ্ত্তিত [সম্মুখাগত] ভারদ্বাজের বিনাশে আদেশ করিলেন। পাঞ্চাল ও সোমকগণ যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণ করিয়া ভয়ঙ্কর রব করিতে করিতে দ্রোণাভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন অস্মৎপক্ষীয় বীরগণও রোষাবিষ্ট হইয়া গৰ্জন করিতে করিতে শক্তি, উৎসাহ ও পরাক্রমানুসারে তাহাদিগের অভিমুখে গমন করিলেন। মহাবীর কৃতবর্ম্মা যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবমান হইলেন। সংগ্রামনিপুণ কুরুকুলোদ্ভব ভূরি সাত্যকিকে মত্তদ্বিপের ন্যায় দ্রোণাভিমুখে গমন ও চতুর্দ্দিকে শরবর্ষণ করিতে দেখিয়া তাঁহার অভিমুখে আগমন করিতে লাগিলেন। মহাবল কর্ণ সহদেবকে দ্রোণাচার্য্যের গ্রহণে যত্নবান্ দেখিয়া তাঁহাকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন। রাজা দুর্য্যোধন জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া ব্যাদিত্যস্য শমনের ন্যায় সমাগত প্রতিপক্ষ ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইলেন। শকুনি সর্ব্বযুদ্ধবিশারদ যোধগণাগ্রগণ্য নকুলকে, কৃপাচার্য্য মহারথ শিখণ্ডীকে, দুঃশাসন ময়ূরসবর্ণ অশ্বসংযুক্ত রথে সমারূঢ় প্রতিবিন্ধ্যকে, পিতৃতুল্য প্রভাবশালী অশ্বত্থামা মায়াবিশারদ সম্মুখাগত ভীমসেনতনয় ঘটোৎকচকে, বৃষসেন অসংখ্য সৈন্য ও পদানুগগণে পরিবৃত দ্রোণ-গ্ৰহণার্থী দ্রুপদকে, ক্রুদ্ধচিত্ত মদ্ররাজ দ্রোণনিধনার্থ সমাগত বিরাটকে, নিশাচরপ্রধান অলম্বুষ যোধগণাগ্রগণ্য মহারথ অর্জ্জুনকে এবং আপনার পক্ষীয় অন্যান্য বীরগণ পাণ্ডবপক্ষীয় অন্যান্য বীরগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর চিত্রসেন নকুলতনয় শতীনীককে মহাবেগে আগমন করিতে দেখিয়া শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহাকে রুদ্ধ করিলেন। তখন পাঞ্চালদেশীয় ধৃষ্টদ্যুম্ন অরাতিমর্দ্দন ধনুর্দ্ধর দ্রোণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় গজারোহী যোধগণ বিপক্ষীয় গজারোহিগণের সহিত ভীষণ সমরে প্রবৃত্ত হইয়া পরস্পরকে মর্দ্দন করিতে আরম্ভ করিল। তুরঙ্গগণ পক্ষবান্ পর্ব্বতের ন্যায় মহাবেগে পরস্পরের অভিমুখে ধাবমান হইল। অশ্বারোহিগণ প্রাস, শক্তি ও ঋষ্টি গ্রহণপূর্ব্বক সিংহনাদ করিতে করিতে অশ্বারোহিগণের সহিত যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিল। বীরগণ গদা, মুষল প্রভৃতি নানাস্ত্ৰদ্বারা সমরে পরস্পরকে নিহত করিতে লাগিল।
“হে মহারাজ! তীরভূমি যেমন উদ্ধত অর্ণবকে নিবারণ করে, তদ্রূপ কৃতবর্ম্মা ক্রুদ্ধ হইয়া ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির হার্দ্দিক্যকে প্রথমতঃ পাঁচ ও তৎপরে বিংশতিশরে বিদ্ধ করিয়া ‘তিষ্ঠ তিষ্ঠ’ বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন। মহাবীর কৃতবর্ম্মা ধর্ম্মরাজের আস্ফালনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ভল্লাস্ত্রে তাহার কার্মুক ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাকে সাতশরে বিদ্ধ করিলেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির সত্বর অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া দশশরে হার্দ্দিক্যের বাহু ও বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। হার্দ্দিক্য ধর্ম্মনন্দনের শরে গাঢ়তর বিদ্ধ ও নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কম্পিতকলেবরে তাঁহাকে সাতশরে নিপীড়িত করিলে, ধর্ম্মরাজ তাঁহার কার্মুক ও শরমুষ্টি ছেদনপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি পাঁচ শাণিত ভল্ল প্রয়োগপূর্ব্বক সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। সেই সমস্ত যুধিষ্ঠিরনিক্ষিপ্ত ভল্ল কৃতবর্ম্মার মহামূল্য হেমপৃষ্ঠ কবচ ভেদ করিয়া বল্মীকমধ্যে প্রবিষ্ট ভীষণ ভুজগের ন্যায় ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইল। তখন মহাবীর হার্দ্দিক্য নিমেষমধ্যে অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরকে প্রথমতঃ যষ্টি ও তৎপরে দশশরে বিদ্ধ করিলেন।
“অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কার্মুক পরিত্যাগপূর্ব্বক কৃতবর্ম্মার প্রতি এক ভুজগসদৃশ ভীষণ শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। সেই পাণ্ডবপ্রেরিত হেমচিত্রিত শক্তি হার্দ্দিক্যের দক্ষিণ ভুজদণ্ড ভেদ করিয়া ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইল। ইত্যবসরে রাজা যুধিষ্ঠির পুনরায় কার্মুক গ্রহণপূর্ব্বক শরনিকরে হার্দ্দিক্যকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। বৃষ্ণিপ্রবর মহাবীর হার্দ্দিক্য তদ্দর্শনে ক্রোধভরে নিমেষাৰ্দ্ধমধ্যে যুধিষ্ঠিরের অশ্ব, সারথি ও রথ বিনষ্ট করিয়া ফেলিলেন। তখন পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির খড়্গ ও চর্ম্ম গ্রহণ করিলেন; হার্দ্দিক্যও এক নিশিত ভল্ল ধারণপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির এক সুবর্ণদণ্ড তোমর গ্রহণপূর্ব্বক সত্বর কৃতবর্ম্মার প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর হার্দ্দিক্য যুধিষ্ঠিরপরিত্যক্ত তোমর সমাগত দেখিয়া হাস্যমুখে দুই খণ্ডে ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং তৎপরে ক্রোধাবিষ্টচিত্তে শরনিকরে ধর্ম্মনন্দনকে সমাচ্ছন্ন করিয়া তাঁহার বর্মের উপর অনবরত শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। যুধিষ্ঠিরের সুবর্ণালঙ্কৃত বর্ম্ম হার্দ্দিক্যশরে সমাচ্ছন্ন হইয়া অম্বরতলপরিভ্রষ্ট তারকাস্তবকের ন্যায় ধরাতলে স্থলিত হইয়া পড়িল। হে মহারাজ! এইরূপে রাজা যুধিষ্ঠিরও কৃতবর্ম্মার শরে ছিন্নবর্ম্মা, রথশূন্য ও নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া অবিলম্বে রণস্থল হইতে অপসৃত হইলেন। মহাবীর হার্দ্দিক্য ধর্ম্মপুত্রকে পরাজিত করিয়া পুনরায় দ্রোণাচার্য্যের সৈন্যসমুদয় রক্ষা করিতে লাগিলেন।”