১৬৫তম অধ্যায়
শকুনিপ্রভৃতির যুদ্ধে যোগদানের গৌরববর্ণন
“ ‘হে রাজন! তোমার মাতুল একরথ শকুনি পাণ্ডবগণের সহিত বৈর উৎপাদন করিয়া ঘোরতর সংগ্ৰাম করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাঁহার সেনাসকল বেগে বায়ুর তুল্য, নিতান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ, বিবিধায়ুধধারী ও সমরে অপরাঙ্মুখ। দ্রোণাত্মজ অশ্বত্থামা ধনুৰ্দ্ধারপ্রধান চিত্ৰযোধী দৃঢ়াস্ত্ৰ; মহাবীর অর্জ্জুনের ন্যায় তাঁহার শরজাল শরাসন হইতে নির্মুক্ত হইয়া অবিচ্ছিন্নরূপে গমন করিয়া থাকে। তাঁহার বলবীৰ্য্যের সীমানির্দ্দেশ করা আমার সাধ্য নহে; তিনি ইচ্ছা করিলে ত্ৰিলোক দগ্ধ করিতে সমর্থ হয়েন। তিনি তপোবলে ক্রোধ ও তেজ জয় করিয়াছেন এবং আশ্রমবাসী দ্রোণের অনুগ্রহে দিব্য-অন্ত্রে সুশিক্ষিত হইয়াছেন; কিন্তু তাঁহার একটি বিশেষ দোষ এই যে, তিনি অত্যন্ত জীবনপ্ৰিয় [নিজের প্রাণের প্রতি প্ৰবল মমতা সমন্বিত] আমি এই নিমিত্তই তাঁহাকে রথী বা অতিরথ বলিয়া নির্দ্দেশ করিতে পারি না। উভয়পক্ষের সেনাগণমধ্যে তাঁহার তুল্য পরাক্রমশালী আর কেহই নাই। তিনি একমাত্র রথে আরোহণ করিয়া সমুদয় দেবসেনা সংহার ও তলধ্বনি[করতল শব্দ]দ্বারা পর্ব্বত বিদীর্ণ করিতে সমর্থ হয়েন। তাঁহার গুণগ্রাম গণনা করা নিতান্ত দুষ্কর; তিনি রণস্থলে সাক্ষাৎ কালান্তক যমের ন্যায় সঞ্চরণ করবেন। তিনি ক্রোধাবিষ্ট হইলে প্ৰলয়কালীন অনলের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে থাকেন। তিনিই এই কুরুপাণ্ডবযুদ্ধের পর্য্যবসান [পরিসমাপ্ত-শেষ] করিবেন। তাঁহার পিতা দ্রোণ বৃদ্ধ হইলেও যুবা অপেক্ষা সমধিক সামর্থ্যশালী; নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, তিনি রণস্থলে সুমহৎ কাৰ্য্যসকল সংশোধন করিবেন। সৈন্যস্বরূপ ইন্ধনসমুত্থিত [কাষ্ঠ হইতে সমুত্থিত] হুতাশন অস্ত্ৰবেগরূপ প্রবল বায়ুদ্বারা সন্ধুক্ষিত [উদ্দীপিত] হইয়া পাণ্ডবদিগের সৈন্যগণকে ভস্মসাৎ করিবে। আচাৰ্য্য দ্রোণ অতিরথ; তিনি রণস্থলে তোমার হিতজনক ভয়ানক কর্ম্মসমুদয় সম্পাদন করিবেন। তিনি ভূপালগণের আচাৰ্য্য; তিনি সৃঞ্জয়গণকে বিনষ্ট করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। ধনঞ্জয় তাঁহার প্রিয় শিষ্য; সুতরাং তিনি অক্লিষ্টকর্ম্ম অর্জ্জুনের গুণসমূহ স্মরণ করিয়া কদাচ তাঁহাকে বিনাশ করিবেন না; তিনি তাঁহার গুণগ্রামের শ্লাঘা করিয়া থাকেন এবং স্বপুত্ৰ অশ্বত্থামা অপেক্ষাও তাঁহাকে সমধিক গুণসম্পন্ন বিবেচনা করেন। তিনি একমাত্র রথে আরোহণ করিয়া দিব্যাস্ত্ৰপ্ৰভাবে একত্র সমবেত [মিলিত] দেব, গন্ধর্ব্ব ও মানবগণকে বিনাশ করিতে পারেন।
“ ‘রথী পৌরব স্বীয় সৈন্যদ্বারা বিপক্ষ সৈন্যগণকে সন্তপ্ত করিয়া অনলের তৃণরাশি দহনের ন্যায় পাঞ্চালদিগকে দগ্ধ করিবেন। মহাবলপরাক্রান্ত একরথ সত্যশ্রাবা তোমার শত্রুগণকে বিনষ্ট করিয়া রণস্থলে সঞ্চরণ করিবেন এবং তাঁহার যোদ্ধাগণ বিচিত্র কবচ ও আয়ুধধারণপূর্ব্বক তোমার শত্রুদিগকে বিনাশ করিয়া রণক্ষেত্রে বিচরণ করিবে; মহারথ কর্ণাত্মজ বৃষসেন তোমার বিপক্ষবল দগ্ধ করিবেন। প্রধান রথী মহাতেজাঃ জলসন্ধ জীবিত-নিরপেক্ষ [প্ৰাণের প্রতি মমতাহীন] হইয়া যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইবেন। মহাভুজ রণবিশারদ মাধব রথে আরোহণ করিয়া তোমার শত্রুসৈন্যদিগকে যুদ্ধে ক্ষয় করিবেন। ইনি তোমার কাৰ্য্যসংসাধনাৰ্থ সৈন্যগণের সহিত স্বয়ং প্ৰাণপরিত্যাগ করিতেও পরাঙ্মুখ নহেন। ইনি মহাবলপরাক্রান্ত ও চিত্ৰযোদ্ধা [নানা কৌশলে সমরকারী], এক্ষণে নিৰ্ভয়ে তোমার শত্ৰুগণের সহিত যুদ্ধ করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। অতিরথ বাহ্লীক রণস্থলে অবতীর্ণ হইয়া কখনো পরাঙ্মুখ হয়েন না, বরং করাল কৃতাস্তের ন্যায় নিতান্ত ভীষণ হইয়া উঠেন। ইনি সমীরণের ন্যায় নিরন্তর রণস্থলে সঞ্চরণ করিয়া তোমার শত্রুসৈন্য সংহার করিবেন। তোমার সেনাপতি মহারথ সত্যবান রণস্থলে অতি অদ্ভুত কাৰ্য্য সংসাধন করিয়া থাকেন। তাহার যুদ্ধ দর্শন করিলে মনোমধ্যে কোনো পীড়া জন্মে না, তিনি অবলীলাক্রমে সম্মুখীন শত্ৰুগণকে উৎসাদিত করিয়া প্ৰত্যাগত হইতে সমর্থ হয়েন। তিনি তোমার নিমিত্ত শত্ৰুগণমধ্যে সৎপুরুষোচিত কাৰ্য্যসমুদয় অনুষ্ঠান করিবেন। ক্রূরকর্ম্মা মহারথ রাক্ষসেন্দ্ৰ অলম্বুষ পূর্ব্বকৃতবৈর স্মরণ করিয়া শক্রসংহারে প্রবৃত্ত হইবেন। ইনি সমস্ত রাক্ষসসৈন্যের প্রধান রথী, মায়াবী ও দৃঢ়যোধী [অক্লান্ত যোদ্ধা]। মহাবলপরাক্রান্ত প্রতাপশালী প্ৰাগজ্যোতিষেশ্বর ভগদত্ত ও অর্জ্জুন ইঁহারা জিগীষা[জয়াশা]পরবশ হইয়া বহুদিবস ঘোরতর যুদ্ধ করিয়াছিলেন। অনন্তর ভগদত্ত নিজসখা পাকশাসনের [ইন্দ্রের] সম্মানরক্ষার্থ অর্জ্জুনের সহিত মিত্ৰতা করিয়া সন্ধিসংস্থাপন করেন। এক্ষণে তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন।’ ”