১৬৩তম অধ্যায়
ধৌম্যকর্ত্তৃক ধর্ম্মরাজকে দিকপালাদি প্রদর্শন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! অনন্তর দিনকর উদিত হইলে মহর্ষি ধৌম্য দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ সমাপনপূর্ব্বক আর্ষ্টিষেণের সহিত পাণ্ডবগণের নিকট উপনীত হইলেন। তাঁহারা ভক্তিসহকারে সমাগত মহর্ষিযুগলের চরণ অভিবাদন ও কৃতাঞ্জলিপুটে অন্যান্য ব্রাহ্মণদিগের সমুচিত সৎকার করিলেন, পরে মহর্ষি ধৌম্য ধর্ম্মরাজের দক্ষিণ কর গ্রহণপূর্ব্বক পূর্ব্বদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! ঐ দেখুন পরমরমণীয় মন্দর-ভূধর সাগরাম্বরা বসুন্ধরাকে আবৃত করিয়া রহিয়াছে। দেবরাজ ইন্দ্র ও বৈশ্রাবণ গিরিরাজিবিরাজিত বনবনান্তপরিশোভিত এই দিক রক্ষা করিতেছেন। মনীষী ঋষিগণ এই গিরিরাজকে সুররাজের ও বৈশ্রবণের আলয় বলিয়া থাকে। ব্ৰাহ্মণ, ঋষি, সিদ্ধ, সাধ্য ও দেবতা সকলেই উদয়াচলচুড়োপবিষ্ট সূৰ্য্যদেবের উপাসনা করিয়া থাকেন।
“প্রাণীগণের প্রভু করাল কৃতান্ত মৃতজীবের আশ্রয় এই দক্ষিণ দিক অধিকার করিয়া রহিয়াছেন। প্ৰেতরাজের নানা সমৃদ্ধিসম্পন্ন, অতি অদ্ভুতদৰ্শন, পবিত্র ঐ সংযমনাখ্য বাসভবন নয়নগোচর হইতেছে। ভুবনপ্রকাশক ভগবান মরীচিমালী যে পর্ব্বতে নিয়মিতরূপে প্রত্যহ অবস্থিতি করেন, সেই এই অস্তাচল দৃষ্টিগোচর হইতেছে। বরুণদেব এই পশ্চিমাচল এবং মহোদধিতে অধিষ্ঠানপূর্ব্বক সর্ব্বভূতের রক্ষণাবেক্ষণ করিতেছেন। ব্ৰহ্মবাদীর অদ্বিতীয় গতি পরমমঙ্গলালয় এই মহামেরু উত্তর দিক উদ্দীপিত করিয়া রহিয়াছে, যে স্থানে চরাচরস্রষ্টা ভূতাত্মা প্রজাপতি অবস্থিতি করিতেছেন এবং দক্ষ প্রভৃতি ব্ৰহ্মার মানসপুত্রেরাও নিরুপদ্রবে বাস করিয়া থাকেন। বশিষ্ঠপুত্ৰ সপ্ত দেবর্ষি এই স্থানেই প্রতিষ্ঠিত আছেন ও পুনর্ব্বার এই স্থানে উদিত হইতেছেন। দেখুন, সুমেরুর রজোরহিত শিখরদেশ কি উত্তম স্থান, ঐ স্থলে দেবগণ ও পিতামহগণ সতত বাস করিয়া থাকেন। যিনি সর্ব্বপ্রাণীর পঞ্চভূতাত্মিক প্রকৃতির উপাদান, অনাদি অনন্ত ও সকলের ঈশ্বর, মেরুর পূর্ব্বভাগে সেই নারায়ণের বাসস্থান ব্ৰহ্মাসদন অপেক্ষাও অধিকতর শোভা পাইতেছে; দেবতারাও যে ভবন সন্দর্শন করিতে অসমর্থ হয়েন, যাহা অনল ও আদিত্য অপেক্ষাও প্ৰদীপ্ত, যাহা স্বীয় প্রভায় দেব-দানবদলের দুনিরীক্ষ্য তথায় ভূতেশ্বর জগৎকর্ত্তা আত্মভূ চরাচর-সকল উদ্ভাসিত করিয়া সাতিশয় শোভা পাইতেছেন। হে কুরুসত্তম! ঐ স্থানে ব্ৰহ্মর্ষিদিগেরও গমনাধিকার নাই; অতএব মহর্ষিগণ কিরূপে যতিলভ্য পরমগতিলাভ করিবেন? ঐ স্থানে কোন প্রকার জ্যোতিঃপদার্থেরই প্রতিভা থাকে না, কেবল সেই ভগবান অচিন্তাত্মাই উজ্জ্বলতররূপে দেদীপ্যমান রহিয়াছেন। যে-সকল তপোবলসম্পন্ন বিশুদ্ধকর্ম্মা যতিগণ অবিচলিত ভক্তিসহকারে নারায়ণদর্শনে ঐ স্থানে গমন করেন, তাঁহাদিগকে আর নরলোকে প্রত্যাগত হইতে হয় না। উহা অতিপবিত্র, ঈশ্বরাধিকৃত, সনাতন ও অক্ষয় স্থান, আপনি উহাকে প্ৰণাম করুন।
কালচক্র-নিয়ন্ত্রিত দেবগণের দর্শনলাভ
“হে কুরুনন্দন! চন্দ্ৰসূৰ্য্য মেরুকে অহরহঃ প্ৰদক্ষিণ করিতেছেন, জ্যোতিষ্কমণ্ডল-সকল ভগবান দিবাকরের আকর্ষণে তাঁহার চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণ করিতেছে। দিননাথ অস্তগত হইয়া সন্ধ্যা অতিক্রম করিয়া উত্তরদিকে গমন করিতে থাকেন; পরে উত্তরাশার [উত্তরদিকের] শেষসীমা পৰ্য্যন্ত গমন করিয়া পুনরায় প্রাঙ্মুখে প্রত্যাবৃত্ত হয়েন। এইরূপে সর্ব্বভূতহিতৈষী ভগবান সহস্ররশ্মি সুমেরুকে প্ৰদক্ষিণ করিয়া পর্ব্বসন্ধি ও কালক্রমে মাস বিভক্ত করিতেছেন এবং সমস্ত জগতে সতত আলোক-বিস্তার করিয়া পুনরায় মন্দরভূধরে গমন করেন। ভূতভাবন ভগবান চন্দ্ৰমাও এইরূপে নক্ষত্রমণ্ডল-সমভিব্যাহারে সুমেরুকে প্ৰদক্ষিণ করিতেছেন। তিমিরারি ভগবান আদিত্য জগতে কিরণজাল বিস্তার করিয়া এই অসংবাদ [বাধাশূন্য] পথে নিরন্তর পর্য্যটন করেন এবং ভূতল শীতল করিবার মানসে দক্ষিণাশা ভজনা করিলে শিশিরকাল সমুপস্থিত হয়।
“অনস্তর বিভাবসু দক্ষিণদিক হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া স্বীয় তেজঃপ্ৰভাবে স্থাবরজঙ্গম প্রভৃতি সকলেরই তেজোভাগ গ্রহণ করিতে আরম্ভ করেন। তৎকালে প্ৰাণীসকল নিতান্ত ক্লান্ত, গ্লানিযুক্ত, ঘর্ম্মাক্তকলেবর ও সাতিশয় তন্দ্ৰাপরতন্ত্র হইয়া উঠে এবং সর্ব্বদাই স্বপ্নাভিভূত হইয়া থাকে। ভগবান আদিত্য এইরূপে অন্তরীক্ষে পরিভ্রমণ করিয়া প্ৰজাদিগের সুখসমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিবার নিমিত্ত পুনরায় বর্ষার সৃষ্টি করেন। অনন্তর তিনি সুধাময় বৃষ্টিধারী, মন্দ মন্দ সমীরণ ও সুখসেব্য সন্তাপদ্বারা স্থাবরজঙ্গম সকল পরিবর্দ্ধিত করিয়া প্রতিনিবৃত্ত হয়েন। হে পাৰ্থ! সবিতা অতীন্দ্রিত হইয়া নিরন্তর এইরূপে কালচক্ৰে ভ্ৰমণ করিতেছেন, তাঁহার গতি অবিচ্ছিন্ন, তিনি জলপদার্থের ন্যায় কখনই এক স্থানে অবস্থিতি করেন না, তিনি সর্ব্বভূতের তেজোভাগ গ্রহণ করিয়া পুনর্ব্বার তাহা প্রদান করেন, তিনি সর্ব্বভূতের পরমায়ু ও ভিন্ন ভিন্ন কাৰ্য্যের বিভাগ করিতেছেন এবং দিবা, রাত্ৰি, কলা ও কাষ্ঠা নির্দ্দিষ্ট করিতেছেন।”