১৬১. পুত্রদানে কুন্তীর ব্রাহ্মণরক্ষা
একষষ্ট্যধিকশততম অধ্যায়।
কুন্তী কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন্! আপনি সেই রাক্ষসের ভয়ে আর বিষাদ করিবেন না; যাহাতে সেই দুরাত্মার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইতে পারেন, এমন এক উপায় স্থির করিয়াছি। আপনার এক সন্তান, সেও অতি শিশু; কন্যাও একটির অধিক নাই, সেও অতি সুশীলা, অতএব উহাদের অন্যতরের কিম্বা আপনার বা আপনার সহধর্মিণীর তথায় গমন করা বিধেয় নহে। আমার পাঁচ পুত্র; তাহাদের মধ্যে একজন আপনার হিতার্থে বলি লইয়া রাক্ষসসমীপে গমন করিবে।
ব্রাহ্মণ কহিলেন, হে শুভে! একে আপনারা ব্রাহ্মণ, তাহাতে আবার অতিথি; অতি অভদ্র অধার্মিক লোকেরাও স্বীয় প্রাণরক্ষার্থে অতিথি ব্রাহ্ম(ণর প্রাণ নাশ করে না। হে তপোধনে! ব্রাহ্মণের নিমিত্ত আপনার প্রাণ বা তদপেক্ষা শ্রেষ্ঠ স্বীয় আত্মজ পরিত্যাগ করা কর্তব্য। আমি কি করিয়া তাহার বিপরীত কাৰ্যের অনুষ্ঠান করিব? ব্রাহ্মণ বধ ও আত্মত্যাগ এই উভয়ের মধ্যে আমার মতে আত্মত্যাগই শ্রেয়ঃ; কারণ, অজ্ঞানতঃ ব্রহ্মহত্যা করিলে ও উহার পতিক হইতে নিষ্কৃতি নাই। হে ভদ্রে! যদি আমি স্বয়ং রাক্ষস সমীপে গমন করিয়া তৎকর্তৃক বিনষ্ট হই, তাহা হইলে আমার আত্মহত্যার পাপ হইবে না; যেহেতু আমি অগত্যা এই বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতেছি। আর যদি তাহা না করিয়া তোমার পুত্রকে সে স্থানে পাঠাই, তাহা হইলে আমি অভিসন্ধিকৃত ব্রাহ্মণবধ জন্য দারুণ পাক হইতে কখনই পরিত্রাণ পাইতে পারিব না। হে শুভে! পণ্ডিতগণ গৃহগিত, শরণগত ও ভিক্ষার্থী ব্যক্তির বধ নিতান্ত নৃশংস বলিয়া নিন্দা করিয়া থাকেন। অপদ্ধৰ্ম্মবিৎ প্রাচীন মহাত্মারা কহিয়াছেন, নৃশংস বা নিন্দিত কর্ম কদাচ করিবে না; অতএব অদ্য আমি প্রণয়িণীসমভিব্যাহারে রাক্ষসহস্তে প্রাণত্যাগ করিব; ব্রাহ্মণবধে কদাপি সম্মত হইব না।
কুন্তী কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন্! আপনি যাহ। কহিলেন, উহা আমারও অভিমত, ব্রাহ্মণ অবশ্য রক্ষণীয়। বিশেষতঃ শত পুল থাকিলেও পুত্রের প্রতি মাতাপিতার বিরক্তি জন্মে না, তবে যে আমি স্বীয় পুত্রকে রাক্ষস সমীপে প্রেরণ করিতে সমুদ্যত হইতেছি, তাহার কারণ আমি বিশেষরূপে। জানি। রাক্ষস কখনই আমার সেই পুত্রকে বিনাশ করিতে পারিবে না। আমার পুত্র সাতিশয় বলবান, তেজস্বী ও মন্ত্রসিদ্ধ। সে রাক্ষসসমাপে তাহার ভোজ্য দ্রব্য সমুদায় লই যাইবে এবং তাহার হস্ত হইতে অনায়াসে আত্মরক্ষা করিয়া প্রত্যাবর্তন করিবে, সন্দেহ নাই; আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি, ইতিপূৰ্বে অনেক মহাবল পরাক্রান্ত মহাকায় রাক্ষস আমার সেই পুত্রের সহিত সংগ্রাম করিয়া সমরশায়ী হইয়াছে। হে ব্ৰহ্মন্! আপনি এ কথা আর কাহাকেও বলিবেন না; কি জানি, তাহা হইলে পাছে বিদ্যার্থিগণ এই বার্তা শ্রবণে কুতূহলাক্রান্ত হইয়া আমাদের পুত্রগণকে বিরক্ত করে।
ব্রাহ্মণ কুন্তীর এই অমৃতোপম বাক্য শ্রবণে যৎপরোনাস্তি আচ্ছাদিত হইয়া ভার্যা সমভিব্যাহারে তাঁহাকে পূজা করিতে লাগিলেন। তখন কুন্তা, ও ব্রাহ্মণ উভয়ে ভীমসেনের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাহাকে রাক্ষসবধার্থ গমন করিতে অনুরোধ করিলেন; ভীম ‘যে অজ্ঞা’ বলিয়া তাহাদের অভিলষিত সম্পাদনে স্বীকার করিলেন।