১৬০তম অধ্যায়
পাণ্ডবাধ্যুষিত স্থানে গরুড়ের আগমন
জনমেজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, হে মুনিসত্তম! আমার পূর্ব্বপিতামহ মহাত্মা পাণ্ডুতনয়েরা গন্ধমাদনপর্ব্বতস্থ ভগবান আর্ষ্টিষেণের আশ্রমে কতকাল বাস করিয়াছিলেন? তথায় সেই মহাবলপরাক্রান্ত বীরপুরুষেরা কি কি কর্ম্ম করিয়াছিলেন এবং কোন কোন দ্রব্য আহার করিতেন, তৎসমুদয় সংকীর্ত্তন করুন। মহাবীৰ্য্য ভীমসেন হিমাচলে যে যে অদ্ভূত কাৰ্য্য করিয়াছিলেন, তাহা সবিস্তারে বর্ণন করুন। হে দ্বিজোত্তম! তাঁহার সহিত যক্ষদিগের কি পুনর্ব্বার যুদ্ধ হয় নাই? তাঁহারা কি বৈশ্রিবণের সহিত মিলিত হইয়াছিলেন? আর্ষ্টিষেণ কহিয়াছেন, তথায় কুবের আগমন করিয়া থাকেন। হে তপোধন! আমি এই সমস্ত বৃত্তান্ত সবিস্তর শ্রবণ করিতে বাসনা করি, তাহাদিগের অলৌকিক কাৰ্য্যসকল যতবার শ্রবণ করি, ততই শুশ্রূষার [শ্রবণেচ্ছায়] বৃদ্ধি হইয়া থাকে, কোনক্রমেই তৃপ্তিলাভ হয় না; অতএব আপনি অনুগ্রহ করিয়া সেই সকল বর্ণন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে ভারতীৰ্ষভ! পাণ্ডবেরা মহর্ষি আর্ষ্টিষেণের উপদেশ আপনাদিগের পরম হিতকর জানিয়া সর্ব্বদা তদনুসারে কাৰ্য্য করিতেন। তাঁহারা মুনিভোজ্য সুরস, ফল-মূল এবং বিশুদ্ধ শরনিহত মৃগমাংসভোজন ও হিমাচলসম্ভূত বিবিধ পবিত্ৰ মধুপান করিয়া পরিতৃপ্ত হইতেন। এইরূপে তথায় লোমশোক্ত বিবিধ বাক্য-শ্রবণপূর্ব্বক পঞ্চম বৎসর অতীত হইল। ইতিপূর্ব্বে ঘটোৎকচ যে স্থানে ‘কাৰ্য্যকালে আমি উপস্থিত হইব’ এই কথা বলিয়া রাক্ষসগণের সহিত প্ৰস্থান করিয়াছিলেন, মহর্ষি আর্ষ্টিষেণের সেই আশ্রমে পাণ্ডবগণের অনেক মাস বিগত হইল। তাঁহারা তথায় কত শত অদ্ভুত বস্তু অবলোকনপূর্ব্বক পরমসুখে সময়াতিপাত করিতে লাগিলেন।
অনন্তর বিশুদ্ধস্বভাব সংযতব্ৰত মুনি ও চারণগণ পাণ্ডবদিগের প্রতি প্রীত হইয়া সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত তাঁহাদিগের নিকট আগমন করিলেন। পাণ্ডবেরাও সমাগত তপোধনদিগের সহিত নানাপ্রকার কথাবার্ত্তা আরম্ভ করিলেন। এইরূপে কতিপয় দিবস অতীত হইলে একদা পক্ষিপ্রধান গরুড় মহাহ্রদনিবাসী এক মহানাগকে গ্ৰাস করিয়া সহসা সেই স্থানে সমুপস্থিত হইল। তাহার পদভরে ভূধর কম্পিত ও মহীরুহসকল আন্দোলিত হইতে লাগিল। তত্ৰত্য প্রাণীবৰ্গ ও পাণ্ডবগণ সেই অত্যদ্ভূত বৃত্তান্ত নয়নগোচর করিয়া বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। পরে সমীরণদ্বারা শৈলাগ্র হইতে শুভজনক সৌগন্ধশালী এক মাল্য পাণ্ডবদিগের সম্মুখে সহসা পতিত হইল। পাণ্ডবগণ, তাঁহাদিগের সুহৃদবর্গ এবং যশস্বিনী দ্রৌপদী সকলেই সেই মাল্যদামগ্রথিত পঞ্চবর্ণ দিব্যকুসুম-সমূহ সন্দর্শন করিয়া চমৎকৃত হইলেন।
মন্দরশিখর হইতে পাণ্ডবসমীপে দিব্যমালা পতন
অনন্তর দ্ৰৌপদী উপযুক্ত সময়ে পর্ব্বতের নিভৃতপ্রদেশোপবিষ্ট ভমিসেনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে ভরতর্ষভ! গরুড়ের পক্ষবাতবেগে ভূধরশিখর হইতে পঞ্চবর্ণ পুষ্পরাশি নিপতিত হইতেছে; বোধ হয়, ঐ স্থান অতি বিস্ময়কর ও পরমরমণীয়; উহা অবলোকন করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ জন্মিয়াছে। দেখ, পূর্ব্বে ত্বদীয় ভ্রাতা অর্জ্জুন অশ্বরথা, নদীতীরে খাণ্ডবদাহসময়ে
সর্ব্বভূত-সমক্ষে দেবরাজকে পরাভূত, গন্ধর্ব্ব, উরগ ও রাক্ষসসকলকে নিবারিত এবং উগ্ৰস্বভাব মায়াবিগণকে নিহত করিয়া অলৌকিক গাণ্ডীব-শরাসন উপার্জ্জন করিয়াছিলেন। এক্ষণে তোমার অপ্রতিহত প্রভাব এবং অসামান্য ভুজবল সকলেরই দুর্ব্বিষহ ও বিষম ভয়াবহ। তোমার ভুজবলে নিশাচরদল ভীত ও মহীধর হইতে দূরীকৃত হইয়া দিগদিগন্তে পলায়ন করিলে সুহৃদ্বর্গ অশঙ্কিতচিত্তে মনের উল্লাসে সর্ব্বশুভাস্পদ পরমরমণীয় অদ্রিশিখরে আরোহণপূর্ব্বক কত শত অদ্ভুত বস্তু অবলোকন করিতে সমর্থ হইবেন এবং আমিও সতৃষ্ণ-নয়নে তৃপ্তি লাভ করিব।”
মালার উৎপত্তিস্থানের অন্বেষণে ভীমের প্রস্থান
মহাবলপরাক্রান্ত মত্তমাতঙ্গবিক্রম বৃকোদর দ্রৌপদীর বাক্যে উত্তেজিত হইয়া শর-শরাসন ধারণ ও তূণীর গ্রহণপূর্ব্বক অকুতোভয়ে মৃগেন্দ্রের ন্যায় দ্রুতপদসঞ্চারে পর্ব্বতাভিমুখে গমন করিলেন। তত্রত্য জীবজন্তুসকল তাঁহাকে মদোৎকট-বারণেন্দ্ৰ— সদৃশ বোধ করিয়া সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইল। লোহিত্যক্ষ, শালশিশুসম উন্নত ভীমসেন ভয়-মোহ পরিত্যাগপূর্ব্বক গদা গ্ৰহণ করিয়া শৈলরাজে উপনীত হইলে দ্রৌপদীর আহ্লাদের আর সীমা রহিল না। কারণ, ভীম সর্ব্বতোভাবে গ্রানিশূন্য ও অবিচলিত উৎসাহসম্পন্ন ছিলেন; নৈসৰ্গিক মৎসরতাপ্রভাবে অন্যের উৎকর্ষ নিতান্ত দুর্ব্বিষহ বোধ করিতেন; কাতরতা কদাপি তাঁহাকে আশ্রয় করিতে সমর্থ হয় নাই।
ভীমসেন অত্যল্পমাত্র পরিসর এক বন্ধুর-পথদ্বারা অত্যুন্নত গিরিশিখরে আরোহণপূর্ব্বক বৈশ্রবণের আবাসস্থান দর্শন করিলেন। সেই বাসভূমি কাঞ্চন ও স্ফটিকময় গৃহসমূহে সুশোভিত, তাহার চতুর্দ্দিক্ সুবর্ণনির্ম্মিত প্রাচীরে পরিবেষ্টিত, কোন কোন প্রদেশ মনোহর উদ্যানে পরমরমণীয়; পর্ব্বতশিখর অপেক্ষাও উন্নত, তাহার প্রাসাদশিখর সকল আশ্চৰ্য্য শোভাসম্পাদনা করিতেছে, দ্বার ও তোরণ সমীরণসঞ্চালিত পতাকায় বিভূষিত হইতেছে; বিলাসিনীগণ ইতস্ততঃ নৃত্য করিতেছে; গন্ধমাদনসস্তুত গন্ধবহ মন্দ মন্দ সঞ্চরণ করিতেছে; নানাবিধ পাদপসকল মুঞ্জরিত [কিশলয়িত—নূতন পত্ৰদলে সুশোভিত] হইয়া অচিন্ত্যনীয় শোভা ধারণ করিতেছে। ভীমসেন তখন বক্ৰীভূত বাহু দ্বারা ধনুষ্কোটি অবলম্বন করিয়া ধনাধিপতির পুরশোভা-সন্দর্শনে স্বীয় পূর্ব্বসম্পত্তি স্মরণপূর্ব্বক নিতান্ত দুঃখিত হইলেন।
অনন্তর মহাবাহু ভমিসেন রত্নজাল-সমাবৃত বিচিত্র মাল্যবিভূষিত রাক্ষসাধিপতির আবাসস্থান অবলোকন করিয়া গদা, খড়গ ও শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক পর্ব্বতের ন্যায় চল ও নিশ্চেষ্ট হইয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। পরে লোমহর্ষণ শঙ্খধ্বনি, জ্যাঘোষ ও তলশব্দ [তরবারির শব্দ] দ্বারা প্ৰাণীসকলকে মোহিত করিলেন। যক্ষ, রাক্ষস ও গন্ধর্ব্বগণ পুলকিত-কলেবরে অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক সেই শব্দ লক্ষ্য করিয়া পাণ্ডবসমীপে সমুপস্থিত হইল। তাহাদিগের হস্তস্থিত গদা, পরিঘ, শূল, শক্তি এবং পরশু প্রভৃতি অস্ত্ৰ-সকল প্ৰদীপ্ত হইতে লাগিল ।
কুবেরানুচরসহ ভীমের যুদ্ধ
অনন্তর যক্ষরাক্ষসগণের সহিত ভীমসেনের যুদ্ধ আরম্ভ হইলে তিনি তখন শক্রপ্রযুক্ত শূল, শক্তি ও পরশু প্রভৃতি অস্ত্ৰসকল মহাবেগে ভল্লাস্ত্ৰদ্বারা ছিন্নভিন্ন করিতে লাগিলেন এবং শরদ্বারা অন্তরীক্ষগত ও ভূতলস্থ গর্জ্জনকারী সমস্ত রাক্ষসের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সকল ক্ষত-বিক্ষত করিলেন। তাহাদিগের শরীর হইতে অনবরত প্রবলবেগে শোণিতধারা বিগলিত হইতে লাগিল এবং ভীমভুজোৎসৃষ্ট আয়ুধদ্বারা রাক্ষসশরীর ও মস্তক-সকল ছিন্ন হইয়া ইতস্ততঃ নিপতিত হইতে লাগিল। রাক্ষসেরা প্রিয়দর্শন পাণ্ডবকে পরিবেষ্টন করিলে বোধ হইল যেন সূৰ্য্যবিম্ব নিবিড় জলদজালে আচ্ছন্ন হইয়াছে। দিনকর যেমন তিগ্মরশ্মি দ্বারা ঘটনাবলীর নির্য্যাকরণ করেন, তদ্রূপ ভীমসেন শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক নিশাচরদলকে দূরীকৃত করিলেন। রাক্ষসেরা তখন ঘোরতর নিনাদে নানাপ্রকার তর্জ্জ-গর্জ্জন করিতে লাগিল; কিন্তু তাহাতে প্রিয়সাহস পাণ্ডবের অণুমাত্ৰও চিত্তচাপল্য সমুপস্থিত হইল না।
অনন্তর বিকৃতকলেবর যক্ষ-সকল ভীমভয়ে ভীত হইয়া সাতিশয় আর্ত্তনাদ করিয়া গদা, শূল, অসি, শক্তি ও পরশু প্রভৃতি আয়ুধ-সকল পরিত্যাগপূর্ব্বক দক্ষিণাভিমুখে প্রস্থান করিল। তথায় বৈশ্রাবণের সখা মণিমাননামে এক মহাবীর গৃহীতস্ত্র রাক্ষস ছিল; সে অন্যান্য সকলকে পরাবৃত্ত নিরীক্ষণ করিয়া স্বীয় আধিপত্য ও পৌরুষ প্রদর্শনপূর্ব্বক তাহাদিগকে সহাস্য-আস্যে কহিল, “তোমরা একজন মনুষ্যের নিকট যুদ্ধে পরাজিত হইয়া প্রস্থান করিতেছ; এক্ষণে বৈশ্ৰবণের আবাসে আসিয়া তাঁহাকে কি কহিবে?” রাক্ষস এই কথা বলিয়া রোষাবেশে অস্ত্ৰ-শস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক ভীমের প্রতি ধাবমান হইল। তখন ভীমসেন মদস্রাবী মাতঙ্গের ন্যায় তাহাকে বেগে আসিতে দেখিয়া তিনটি বৎসদন্ত অস্ত্র দ্বারা তাহার পার্শ্বদেশে আঘাত করিলেন; মহাবল মণিমানও মহতী গদা গ্রহণপূর্ব্বক ভীমসেনকে প্রহার করিল। বৃকোদার তখন বিদ্যুতের ন্যায় প্রভাবসম্পন্ন অতি ভীষণা সেই গদা নিবারণার্থ আকাশপথে বহুসংখ্যক শাণিতশর [তীক্ষ্নকর—উষ্ণরশ্মি] নিক্ষেপ করিলেন; কিন্তু বিক্ষিপ্ত সায়কসকল গদায় সংলগ্ন হইবামাত্র তাহার বেগ ধারণ করিতে অসমর্থ হইয়া প্রবলবেগে প্রতিহত হইল দেখিয়া গদাযুদ্ধের রীতি অনুসারে যুদ্ধ করিয়া রাক্ষসকৃত প্রহার বিফল করিলেন।
অনন্তর রাক্ষস ক্রোধভরে রুক্মদণ্ড লোহময় শক্তি প্রহার করিল। অগ্নির ন্যায় জাজ্বল্যমান মহারৌদ্র শক্তি ভমিরবে ভীমের দক্ষিণাঙ্গ বিদারণ করিয়া সহসা ভূতলে পতিত হইল। অমিতবিক্রম বৃকোদার শক্তিদ্বারা অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া রোষকষায়িতলোচনে সুগভীর-গর্জ্জনে অরাতিভয়বর্দ্ধিনী শত্ৰুঘাতিনী গদা গ্রহণপূর্ব্বক মণিমানের প্রতি বেগে ধাবমান হইলেন; মণিমানও দেদীপ্যমান শূলদ্বারা ভীমকে প্রহার করিল। তখন গদাযুদ্ধবিশারদ পাণ্ডব গদাগ্রদ্বারা সেই শূল ভগ্ন করিলেন। গরুড় যেরূপ ভুজঙ্গের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ রাক্ষসের প্রাণসংহার করিবার মানসে সত্বরে তদাভিমুখে গমন করিলেন ও অন্তরীক্ষে লম্ফ প্রদানপূর্ব্বক গদা ঘূর্ণিত করিয়া রণক্ষেত্রে নিক্ষেপ করিলেন। ইন্দ্রবিসৃষ্ট অশনির ন্যায় অতিবেগবতী গদা রাক্ষসের প্রাণসংহার করিয়া ভূতলে নিপতিত হইল। সিংহ যেমন গজপতিকে নিহত করে, সেই প্রকার ভীম রক্ষসকে নিপাতিত করিলেন। হতাবশিষ্ট নিশাচরেরা তাহাকে নিহত ও সমরশায়ী নিরীক্ষণ করিয়া ভয়ঙ্কর আর্ত্তস্বর পরিত্যাগপূর্ব্বক পূর্ব্বদিকভাগে প্রস্থান করিল।