১৬০তম অধ্যায়
উলূকবাক্যে পাণ্ডবগণের ক্ৰোধ
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! পাণ্ডবগণ দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক কপটদ্যূতে পরাভূত হইয়া পূর্ব্বাবধিই জাতক্ৰোধ হইয়া আছেন; এক্ষণে আবার উলূক ভুজঙ্গসদৃশ অর্জ্জুনকে বাক্যশালাকাদ্বারা আহত করিলে তাঁহারা সাতিশয় রোষপরবশ হইয়া উঠিলেন। পরে তাঁহারা সহসা আসন হইতে সমুত্থিত হইয়া বাহুবিক্ষেপসহকারে ক্রোধাভরে পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ভীমসেন অধোমুখে অতি ভীষণ আশীবিষের ন্যায় দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া রোষকষায়িতলোচনে [ক্রোধে আরক্তনেত্র] কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। তখন মহামতি বাসুদেব ভীমসেনকে নিতান্ত নিপীড়িত [মৰ্মবেদনাযুক্ত] ও একান্ত ক্রুদ্ধ বিবেচনা করিয়া সহাস্যমুখে উলূককে কহিলেন, “হে উলূক! তুমি শীঘ্ৰ গমন করিয়া দুৰ্য্যোধনকে কহিবে,-পাণ্ডবেরা তোমার বাক্য শ্রবণ ও তাহার যথার্থ অৰ্থ গ্ৰহণ করিয়াছেন; এক্ষণে তোমার যেরূপ অভিপ্ৰায়, তাহাই হইবে।” কৃষ্ণ এই বলিয়া ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি পুনরায় দৃষ্টিপাত করিলেন।
“অনন্তর উলূক সর্ব্বসমক্ষে কৃষ্ণ ও পাণ্ডবপ্রমুখ সকলকে পুনর্ব্বার সেই সমস্ত কথা কহিল। মহাবীর অর্জ্জুন উলূকের নিদারুণ বাক্যশ্রবণে নিতান্ত রোষাবিষ্ট হইয়া ললাট মার্জ্জন করিতে লাগিলেন। সভাস্থ সমস্ত নৃপতি অর্জ্জুনকে তদাবস্থ অবলোকন করিয়া ক্ৰোধ সংবরণ করিতে সমর্থ হইলেন না; প্রত্যুত বাসুদেবও অর্জ্জুনের প্রতি দুৰ্য্যোধনপ্রযুক্ত তিরস্কারবাক্য শ্রবণ করিয়া ক্ৰোধ প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিলেন। তখন ধৃষ্ট্যদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, সাত্যকি, কৈকেয়রা পঞ্চভ্রাতা, রাক্ষস ঘটোৎকচ, দ্রুপদপুত্র, অভিমন্যু, ধৃষ্টকেতু ও যমজ নকুলসহদেব-ইঁহারা আরক্তলোচনে পরস্পরের কেয়ূর[বালা]বিভূষিত চন্দনচর্চিত রুচির [মনোজ্ঞ] কর গ্রহণ করিয়া দশনে দশনে [দাঁতে দাঁত] নিষ্পেষণ ও সূক্কণী [অধর ও ওষ্ঠ] লেহন[জিহ্বা দিয়া চাটা]পূর্ব্বক সহসা আসন হইতে সমুত্থিত হইলেন।
দুৰ্য্যোধনের উদ্দেশে উলূকপ্রমুখাৎ ভীমবাক্য
“অনন্তর বৃকোদর তাঁহাদিগের আন্তরিক অভিপ্রায় সম্যক্ অবগত ও ক্ৰোধে প্ৰজ্বলিত হইয়া মহাবেগে উত্থিত হইলেন এবং নেত্রদ্বয় উন্নত করিয়া দন্তের কটকটা শব্দ ও হস্তে হস্ত নিষ্পেষণ [করে করে মর্দন]। করিয়া উলূককে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, —“হে উলূক! দুৰ্য্যোধন আমাদিগকে অশক্ত বোধ করিয়া যেসমস্ত উত্তেজনাবাক্য প্রয়োগ করিয়াছে, তাহা শ্রবণ করিলাম। এক্ষণে আমি যাহা প্রত্যুত্তর প্রদান করিতেছি, তুমি তাহা সূতপুত্ৰ কৰ্ণ, দুরাত্মা শকুনি ও অন্যান্য ক্ষত্ৰিয়গণসমক্ষে দুৰ্য্যোধনকে শ্রবণ করাইবে;—রে দুরাচার! আমরা জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের প্রীতিসাধনোদ্দেশে [প্রীতি-বিধানের জন্য] তোমাকে ক্ষমা করিয়াছি কিন্তু তুমি তাহা আপনাকে সৌভাগ্য বলিয়া বিবেচনা করিতেছ না। ধর্ম্মরাজ পাণ্ডুনন্দন জ্ঞাতিকুলের মঙ্গলাভিলাষে বাসুদেবকে সন্ধিস্থাপনার্থ কৌরবগণের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন। এক্ষণে তুমি কালপ্রেরিত বা কালগ্ৰাসে নিপতিত হইতে অভিলাষী হইয়া আমাদিগের সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও; কল্য নিশ্চয়ই যুদ্ধ আরম্ভ হইবে। আমি তোমার ও তোমার ভ্রাতৃগণের বধসাধনাৰ্থ প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম; তাহা অবশ্যই সফল হইবে, তদ্বিষয়ে বিচার করিবার আর অবশ্যকতা নাই। যদি মহাসাগর বেলাভূমি [তীর] অতিক্রম করে, পর্ব্বত যদি বিদীর্ণ হয়, তথাপি আমার বাক্য মিথ্যা হইবে না। হে দুর্বুদ্ধে! যদি যম, কুবের বা রুদ্র তোমার সহায় হয়েন, তথাচ পাণ্ডবেরা প্রতিজ্ঞা প্রতিপালনে কখনই পরাঙ্মুখ হইবেন না। আমি যখন স্বেচ্ছানুসারে দুঃশাসনের রুধির পান করিব, তৎকালে যদি কোন ক্ষত্রিয় ভীষ্মকেও পুরষ্কৃত [অগ্রবর্ত্তী] করিয়া আমার নিকট আগমন করেন, আমি তাহাকে যমসদনে [যমালয়ে] প্রেরণ করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি আত্মাকে [শরীর] স্পর্শ করিয়া শপথ [দিব্য কর্ত্তব্যের অবধারণ] করিতেছি, ক্ষত্ৰিয়সমক্ষে যাহা কহিয়াছিলাম, নিশ্চয়ই তাহার অনুষ্ঠান করিব।”
দুৰ্য্যোধনের উদ্দেশ্যে সহদেবের প্রত্যুক্তি
“সহদেব ভীমসেনের বাক্য শ্রবণানন্তর উলূকের সমক্ষে দুর্য্যোধনকে লক্ষ্য করিয়া ক্রোধাভরে লোহিতনয়নে সেনাগণসমক্ষে বীরপুরুষোচিত কথা কহিতে লাগিলেন,—“রে পাপ! তুমি আমার বাক্য শ্রবণ করিয়া তোমার পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে কহিবে, যদি তোমার সহিত ধৃতরাষ্ট্রের কোন সম্পর্ক না থাকিত, তাহা হইলে কৌরবগণের সহিত আমাদিগের কখনই ভেদ [অনৈক্য] হইত। না। তুমি অতি পাপিষ্ঠ; তুমি ধৃতরাষ্ট্রকুলের উন্মূলন ও লোকবিনাশের নিমিত্ত উৎপন্ন হইয়াছ। তোমার পাপাত্মা পিতা জন্মাবধি আমাদিগের সহিত প্রতিনিয়ত নৃশংসাচরণ [নির্দয় ব্যবহার] করিয়া থাকেন, সেই নৃশংসাচারমূলক চিরাগত বৈর [শক্ৰতা] আজি তোমা হইতেই নির্ম্মূল হইবে। আমি শকুনিসমক্ষে অগ্ৰে তোমাকে সংহার করিয়া পরে সকল ধনুর্দ্ধারীদিগের সমক্ষে দুষ্ট শকুনিকে বিনষ্ট করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই।” মহাবল অর্জ্জুন ভীম ও সহদেব উভয়ের বাক্য শ্রবণ করিয়া সহাস্যমুখে ভীমসেনকে কহিলেন, “হে বৃকোদর! যাহাদের সহিত আপনার শক্রভাব সঞ্জাত হইয়াছে, তাহারা এস্থানে নাই; এক্ষণে মৃত্যুর [আসন্ন মরণের] বশীভূত হইয়া সুখস্বচ্ছন্দে গৃহে অবস্থান করিতেছে। যথোক্তভাষী [অপরের সংবাদবাহী] দূতের অপরাধ কি? অতএব আপনি উলূকের প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ করিবেন না।” অর্জ্জুন ভীমপরাক্রম ভীমকে এইরূপ কহিয়া মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নপ্রমুখ সুহৃদ্বৰ্গকে কহিলেন, “হে বান্ধবগণ! সেই পাপপরায়ণ দুৰ্য্যোধন আমার ও বাসুদেবের বিশেষরূপে নিন্দা করিয়াছে; আপনারা তাহাই শ্রবণ করিয়া আমাদিগের হিতানুষ্ঠানের নিমিত্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়াছেন। আমি বাসুদেবের প্রভাবে ও আপনাদিগের যত্নে ক্ষত্ৰিয়গণ ও ভূপালদিগকে গণনা [গণ্য-গ্রাহ্য] করি না। দুৰ্য্যোধন কহিয়াছে, কল্যই যুদ্ধ উপস্থিত হইবে; আমি সেনামুখে [সমরে] গাণ্ডীবদ্বারা ইহার প্রকৃত প্রত্যুত্তর প্রদান করিব, বাক্য প্রয়োজন নাই। ক্লাবেরাই বাগাড়ম্বর [বৃথা বাক্যবিস্তার] করিয়া থাকে।” তখন ভূপালগণ অর্জ্জুনের বচনভঙ্গীতে [বলার কায়দায়] বিস্মিত হইয়া তাঁহার ভূয়সী [অত্যন্ত] প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
যুধিষ্ঠিরের প্রত্যুক্তি
“তখন ভারতসত্তম ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির উলূকমুখে দুৰ্য্যোধনবাক্য শ্রবণানন্তর ভূপালগণকে বয়ঃক্রমানুসারে যথাযোগ্য অনুনয় করিয়া কহিলেন, “হে উলূক! আমি তোমাকে অবমাননা করি না; অতএব দুৰ্য্যোধনের বাক্যের উত্তর প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর।” এই বলিয়া তিনি ভীষণ ভুজঙ্গের ন্যায় ঘনঘন দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ ও উলূকের বিপুল ভুজযুগল গ্রহণ করিয়া জনাৰ্দন ও ভ্রাতৃগণের প্রতি দৃষ্টিপাত এবং রোষাভরে সৃক্কণী লেহন করিয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে সান্ত্ববাদ প্রয়োগপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে উলূক! তুমি গমন করিয়া সেই কৃতঘ্ন কূলপাংশুল দুৰ্মতি দুৰ্য্যোধনকে কহিবে,-রে পাপা! তুমি প্রতিনিয়ত পাণ্ডবগণের প্রতি কপটাচার করিবার নিমিত্ত প্ৰবৃত্ত হইতেছ। যে ব্যক্তি স্ববীর্য্যপ্ৰভাবে পরাক্রম প্ৰকাশ করিয়া শত্রুগণকে পরাজিত করে, যে ব্যক্তি নিৰ্ভয়ে প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করিতে সমর্থ হয়, সেই ক্ষত্ৰিয়। তুমি ক্ষত্রিয় হইয়া আমাদিগকে সমরে আহ্বানপূর্ব্বক মান্য ও অমান্য ব্যক্তিগণকে পুরস্কৃত করিয়া যুদ্ধ করিও না। তুমি আপনার ও সৈন্যগণের বলবীৰ্য্য আশ্রয় করিয়া পাণ্ডবগণকে সমরে আহ্বানপূর্ব্বক ক্ষত্ৰিয় বলিয়া পরিচিত হও। যে ব্যক্তি স্বয়ং অসমর্থ হইয়া অন্যের আশ্রয়লাভ করিয়া যুদ্ধে শত্ৰুগণকে আহ্বান করে, সেই নপুংসক; তুমি অন্যের বলে আপনাকে বলশালী বিবেচনা করিয়া থাক; অতএব তুমি কি বলিয়া আমাদের প্রতি তর্জ্জনগর্জ্জন করিতেছ?”
উলূকের প্রতি কৃষ্ণের উক্তি
“অনন্তর কৃষ্ণ কহিলেন, “হে উলূক! তুমি আমার বাক্যানুসারে পুনরায় দুৰ্য্যোধনকে কহিবে,—হে দুৰ্মতে! তুমি পুরুষকার প্রদর্শন করিয়া কল্যই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবে। আমি অর্জ্জুনের সারথ্য স্বীকার করিয়াছি বলিয়া যুদ্ধ করিব না, ইহা মনে মনে স্থির করিয়া ভীত হইতেছ না, কিন্তু যেমন হুতাশন তৃণসকল ভস্মসাৎ করে, তদ্রূপ আমিও চরমকালে [শেষ সময়ে] ক্ৰোধাভরে সমস্ত পার্থিবগণকে দগ্ধ করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিয়োগানুসারে সমরে মহাত্মা অর্জ্জুনের সারথ্য স্বীকার করিব। তুমি ত্ৰিলোকে [ভূলোকে, অন্তরীক্ষলোকে ও স্বৰ্গলোকে] গমন কর অথবা ভূতলে প্রবিষ্ট হও, সর্ব্বত্রই প্রভাত-সময়ে অর্জ্জুনের রথ নয়নগোচর করিবে। তুমি ভীমের বাক্য নিস্ফল বিবেচনা করিতেছ; কিন্তু আজি দুঃশাসনের শোণিত পীত হইয়াছে, এইরূপ অবধারণ করবে। তুমি প্রতিকূল বাক্য প্রয়োগ করিলেও কি ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠির, কি ভীমসেন, কি যমজ নকুলসহদেব ইহারা কেহই তোমার প্রতি দৃষ্টিপাত করিবেন না।”