১৫৮তম অধ্যায়
যক্ষ যুদ্ধপর্ব্বাধ্যায়
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! এইরূপে সেই রাক্ষস নিহত হইলে পর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই বদরিকাশ্রমে আগমনপূর্ব্বক পুনরায় বাস করিতে লাগিলেন। তিনি একদা আপনার ভ্রাতৃগণ ও দ্ৰৌপদীর সমীপে আগমনপূর্ব্বক অর্জ্জুনকে স্মরণ করিয়া তাঁহাদিগকে কহিতে লাগিলেন, “আমরা বনে বনে ভ্ৰমণ করিয়া নির্ব্বিঘ্নে চারি বৎসর অতিবাহিত করিলাম। মহাবীর ধনঞ্জয় পঞ্চম বৎসরে আমাদের নিকটে আসিবেন বলিয়া অঙ্গীকার করিয়া গিয়াছেন। আমরা এক্ষণে পুম্পিতদ্রুম সমুদয়সুশোভিত; মত্ত কোকিল, ষট্পদ, চাতকগণে পরিবৃত; ব্যাঘ্র, বরাহ, মহিষ, গবয় ও হরিণাকুলসঙ্কুল; বিবিধ হিংস্ৰ শ্বাপদ ও রুরু-সমূহে ব্যাপ্ত; প্রফুল্ল সহস্রদল ও শতদল পদ্ম, নীলোৎপল এবং অন্যান্য বিবিধ উৎপলে সুশোভিত; পরমপবিত্র, সুরাসুরগণনিষেবিত, নিত্যোৎসব পরিপূর্ণ, গিরিবরাগ্রগণ্য এই কৈলাস-পর্ব্বতে সেই অর্জ্জুনের দর্শনাভিলাষে ও উদ্দেশে আগমন করিয়াছি। অমিততেজা ধনঞ্জয় আমার নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়া গিয়াছেন যে, তিনি বিদ্যাশিক্ষার্থ পঞ্চবৎসর সূরলোকে বাস করিবেন, এখন আমরা এই স্থানে অবস্থিতি করিয়া সংগৃহীতাস্ত্র, অরতিনিপাতন, গাণ্ডীবধন্বা ধনঞ্জয়কে দেবলোক হইতে মর্ত্যলোকে পুনরায় আগমন করিতে দেখিব।”
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির প্রণয়িনী-সমবেত স্বীয় ভ্রাতৃগণকে এইরূপ কহিয়া তপোধন ব্রাহ্মণগণকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক তাঁহাদিগের সমীপেও আপনাকে সেই পর্ব্বতে সমাগমের কারণ নিবেদন করিলেন। তখন পাণ্ডুনন্দনগণ পরমপ্রীত উগ্ৰতপাঃ তপোধনগণকে প্ৰদক্ষিণ করিলে তাঁহারা যুধিষ্ঠিরের বাক্যে অনুমোদন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে রাজন! তোমার এই ক্লেশ চিরস্থায়ী নহে; তুমি পরিণামে পরম সুখ-সম্ভোগ করিবে, তুমি ক্ষাত্ৰ-ধর্ম্ম-প্রভাবে অচিরাৎ এই দুঃখসাগর হইতে উত্তীর্ণ হইয়া পৃথিবী পরিপালন করিবে।”
পাণ্ডবগণের বৃষপৰ্বাশ্রমে গমন
এইরূপে ধর্ম্মাত্মা ধর্ম্মানন্দন, তপোধনগণের সেই সমুদয় বাক্য শ্রবণানন্তর সেই সকল ব্রাহ্মণ ও স্বীয় ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে মহর্ষি লোমশকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া গমন করিলেন। রাক্ষসগণ তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। ভ্রাতৃগণ-সমবেত মহারাজ যুধিষ্ঠির কোন কোন স্থানে পদব্রজে, কোথাও বা রাক্ষসগণকর্ত্তৃক উহ্যমান হইয়া গমন করিতে লাগিলেন। তিনি বহুবিধ ক্লেশ চিন্তা করিয়া সিংহ, ব্যাঘ্র ও গজ-সমুদয়ে সমাকীর্ণ উত্তরদিকে গমন করিলেন। তিনি তৎকালে কৈলাস-গিরি, মৈনাক-পর্ব্বত, গন্ধমাদনের প্রত্যন্ত-পর্ব্বত, হিমাচল ও অন্যান্য শৈল-সমুদয়ের উপরিস্থ নদীসকল অবলোকন করিয়া পরম পরিতোষপ্রাপ্ত হইলেন। এইরূপে পাণ্ডবগণ ক্ৰমাগত উত্তরমুখে গমন করিয়া সপ্তদশ-দিবসে পরমপবিত্র হিমাচলের পৃষ্ঠদেশে সমুপস্থিত হইলেন। তথায় গন্ধমাদনের সমীপস্থ বিবিধ পুম্পিত দ্রুম ও সলিলাবর্ত্তসমুদয়ে সমাবৃত পরমপবিত্র রাজষি বৃষপর্ব্বার আশ্রম অবলোকন করিলেন। তখন অরতিনিপাতন পাণ্ডবগণ সেই ধর্ম্মাত্মা রাজর্ষির সমীপে গমনপূর্ব্বক আত্মপরিচয় প্রদান করিলেন এবং তৎকর্ত্তৃক পুত্ৰবৎ অভিনন্দিত ও সৎকৃত হইয়া তথায় সপ্ত রাত্রি বাস করিলেন। অষ্টম দিবস সমুপস্থিত হইলে তাঁহারা লোকবিশ্রুত রাজর্ষি বৃষপর্ব্বকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক তথা হইতে প্রস্থান করিবার অভিলাষ প্রকাশ করিলেন। তাঁহারা সেই পারিবর্হ ও এক এক করিয়া সমুদয় বিপ্রগণকে বৃষপর্ব্বার নিকটে ন্যস্ত করিয়া তাঁহার আশ্রমে যজ্ঞাপত্র, রত্ন ও আভরণ সকল রাখিলেন। অনন্তর ত্রিকালজ্ঞ সর্ব্বধর্ম্মবিৎ ধর্ম্মাত্মা বৃষপর্ব্ব তাঁহাদিগকে গমনের অনুমতি করিলেন।
তখন মহাত্মা পাণ্ডবগণ উত্তরদিকে গমন করিলে মহামতি বৃষপর্ব্ব তাঁহাদের অনুগমন করিতে লাগিলেন। তিনি কিয়ৎক্ষণ পরে বিপ্ৰগণের সন্নিধানে পাণ্ডবগণকে ন্যাস্ত করিয়া তাঁহাদিগকে আশীৰ্বাদ ও পথোপদেশ প্রদানপূর্ব্বক প্রতিনিবৃত্ত হইলেন।
অনন্তর সত্যবিক্রম যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে পাদচারে গমন করিতে লাগিলেন। এইরূপে তথা হইতে প্ৰস্থান করিয়া নানাক্ৰমযুক্ত শৈলশৃঙ্গে বাস করিয়া চতুর্থ দিবসে কৈলাসপর্ব্বতে প্রবেশ করিলেন। ঐ পর্ব্বতের আকার ঘনঘটার ন্যায়; উহাতে নানাস্থানে জলাশয় এবং বহুবিধ মণি, কাঞ্চন ও রৌপ্যের স্তুপসকল শোভমান হইতেছে।
পাণ্ডবগণ বৃষপর্বোপদিষ্ট পথে সমুপস্থিত হইয়া বিবিধ পর্ব্বত অবলোকনপূর্ব্বক আপনাদের গন্তব্য প্রদেশাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। মহর্ষি ধৌম্য, লোমশ, দ্রৌপদী ও পাণ্ডুতনয়গণ একত্ৰ মিলিত হইয়া ক্রমে উপর্য্যুপরিস্থ গিরিগুহা-সমুদয় ও অন্যান্য সুদুৰ্গম প্রদেশসকল পরমসুখে অতিক্রম করিয়া গমন করিলেন। উহাদের মধ্যে কেহই সেই সুদুৰ্গম প্রদেশতিক্রমণে অবসন্ন হইলেন না। অবশেষে নানাবিধ মৃগ, পক্ষী, বৃক্ষ, লতা, শাখামৃগ [বানর], বিবিধ পদ্মযুক্ত সরোবর ও পল্বলে সঙ্কীর্ণ সুমনোহর মাল্যবানপর্ব্বতে সমুপস্থিত হইলেন।
পাণ্ডবগণের গন্ধমাদন-শোভাদর্শন
পরে গন্ধমাদন-পর্ব্বত তাঁহাদের নয়নগোচর হইল। ঐ পর্ব্বত কিম্পুরুষ, সিদ্ধ ও চারণগণের আবাসস্থান; বিদ্যাধর ও কিন্নরীগণ উহাতে সতত বিচরণ করিতেছে; সিংহ, ব্যাঘ্র ও গজসকল নিরন্তর পরিভ্রমণ করিতেছে; শরভগণ ঘোরতর নিনাদ করিতেছে ও নানাবিধ মৃগগণ ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতেছে। দ্ৰৌপদীসমবেত পাণ্ডুতনয়গণ পরমপরিতুষ্টচিত্তে বিপ্ৰগণসমভিব্যাহারে সেই মনোহর হৃদয়নন্দন নন্দনবনতুল্য গন্ধমাদনে ক্ৰমে ক্রমে প্রবেশ করিলেন; তথায় বিহগামুখ-সমীরিত [কূজিত] শ্রোত্ররম মনোহর সুমধুর ধ্বনি শ্রবণ করিতে লাগিলেন এবং বহুবিধ সমধুর ফলভারাবনত আম্র, আম্রাতক, কর্ম্মরঙ্গ, নারিকেল, তিন্দুক, মুঞ্জাতক, আঞ্জার, দাড়িম্ব, বীজপূরক, পনস, লাকুচ, কদলী, খর্জ্জুর, অনম্ন, বেতস, পারাবত, চম্পক, নীপ, বিন্ধ, কাপখ, জম্বু, কুঙ্কুম, বদরী, প্লক্ষ, উড়ুম্বর, বট, অশ্বথ, ক্ষীরিক, ভল্লাতক, আমলকী, হরীতক, বিভীতক, ইঙ্গুদ, করমর্দ্দ এবং প্রভূত পুষ্পশোভিত চম্পক, অশোক, কেতক, বকুল, পুন্নাগ, সন্তপর্ণ, কণিকার, পাটল, কুটজ, মান্দার, ইন্দীবর, পারিজাত, কোবিদার, দেবদারু, শাল, তাল, তমাল, পিপ্পল, হিঙ্গুক, শাল্মলী, কিংশুক, শিংশপা, সরল ও অন্যান্য বৃক্ষ-সমুদয়ে উহার সানুপ্রদেশে শোভিত দেখিলেন। ঐ সমুদয় বৃক্ষে চকোর, শতপত্র, ভৃঙ্গ, শুক, কোকিল, কলবিঙ্ক, হারীত, জীবঞ্জীবক, প্রিয়ক, চাতক প্রভৃতি নানাবিধ পক্ষিগণ সুমধুর-স্বরে গান করিতেছে; স্থানে স্থানে
ও পুণ্ডরীক প্রভৃতি বিবিধ জলজপুষ্প শোভিত হইতেছে; তাহাতে কাদম্ব, কুরর, কারণ্ডব, চক্ৰবাক, জলকুক্কুট, প্লব, হংস, বক, মদণ্ড প্রভৃতি জলচর পক্ষিগণ ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছে। পদ্মষণ্ডমণ্ডিত কমলাকর-সমূহে তামরস-রসপানে উন্মত্ত, পদ্মোদরাচ্যুত, কিঞ্জঙ্ক রাগে রঞ্জিত মধুকরগণ মধুরস্বরে গুনগুন ধ্বনি করিতেছে। অদূরে পর্ব্বতসানুস্থ লতামণ্ডল সবিলাস মদাকুল ময়ূরকুর মেঘনির্ঘোষ-শ্রবণে মদোন্মত্ত হইয়া প্রিয়া-সমভিব্যাহারে বিচিত্ৰকলাপ-সমুদয় বিস্তারপূর্ব্বক নৃত্য করিতেছে। কোন কোন ময়ূর প্রণয়িনী-সমভিব্যাহারে ভ্রমণ করিতেছে; কতকগুলি লতাশঙ্কীর্ণ কুটজ-বৃক্ষের শাখায় উদ্ধতের ন্যায় উপবিষ্ট হইয়া কলাপনিচিত মুকুটের ন্যায় শোভা পাইতেছে এবং কতকগুলি তরুকোটরে বাস করিতেছে। গিরিশৃঙ্গে সুবর্ণবৰ্ণ-কুসুম-সম্পন্ন সিন্ধুবার-সমুদয় শোভা পাইতেছে। দেখিলে বোধ হয় যেন, মন্মথের তোমার-সকল সন্নিবেশিত রহিয়াছে। স্থানে স্থানে অত্যুৎকৃষ্ট কর্ণপুর-সমুদয়ের ন্যায় বিকশিত কণিকার ও কন্দৰ্পশরসমূদয়ের ন্যায় কামিজনগণের ঔৎসুক্যজনক প্ৰফুল্ল কুরুবক-সকল পর্ব্বতের শোভা সম্পাদন করিতেছে। কোথাও তিলকের ন্যায় তিলককুসুম শোভা পাইতেছে। কোথাও মনোহর সহকারমঞ্জরীসকল অনঙ্গশরের ন্যায় শোভিত হইতেছে ও ভ্ৰমরকুল ঐ সমুদয়ের উপর উপবেশন করিয়া গুনগুন-স্বরে ধ্বনি করিতেছে। কোথাও তরুসমুদয় লোহিত, কৃষ্ণ, পীত প্রভৃতি নানাবর্ণ পুষ্পে সাতিশয় শোভমান হইতেছে। শাল, তমাল, পটল, বকুল প্রভৃতি বৃক্ষসমুদয় মালার ন্যায় শৈলশিখরে সংসাক্ত রহিয়াছে। সানুতে বিমল স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ, কলহংস প্রভৃতি পাণ্ডুরচ্ছদ পক্ষিসমুদয়সঙ্কুল, সারসগণনিনাদিত, পদ্ম ও উৎপল প্রভৃতি জলজপুষ্পে সুশোভিত, সুশীতল-জলসম্পন্ন সরোবরসকল শোভা পাইতেছে।
এইরূপে মহাবীর পাণ্ডুনন্দনগণ চতুর্দ্দিকে সুগন্ধি মাল্য, সুস্বাদু ফল, মনোহর সরোবর ও রমণীয় তরুরাজি দৰ্শনপূর্ব্বক বিস্ময়বিকশিতলোচনে গন্ধমাদনবনে প্রবেশ করিলেন। কমল, কাহ্লার, উৎপল ও পুণ্ডরীকের সুবাসে সুবাসিত ও সুখস্পর্শ সমীরণ তাঁহাদের অঙ্গ স্পর্শ করিতে লাগিল।
তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির ভীমসেনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে ভীম! এই গন্ধমাদন-কাননের কি অপূর্ব্ব শোভা! এই মনোহর বনে ফলপুষ্পশোভিত বিবিধ কাননজাত দিব্যদ্রুম ও লতা-সমুদয়ের উপরিভাগে পুংস্কোকিলাকুল সুমধুর ধ্বনি করিতেছে, এই গন্ধমাদনসানুতে কোন বৃক্ষই কণ্টকিত বা অপুষ্পিত নাই, সমুদয় বৃক্ষেরই ফল ও পত্র স্নিগ্ধ। প্রফুল্প পঙ্কজোপরি ভ্রমরকুল গুনগুন-স্বরে ধ্বনি করিতেছে, করিকুল করেণুগণ-সমভিব্যাহারে নলিনীদল বিলোড়ন করিতেছে। এই গন্ধমাদনে নানা কুসুমগন্ধযুক্ত বনরাজিতে অলিকুল উপবিষ্ট হইয়া মনোহর-স্বরে গান করিতেছে। ঐ দেখ, দেবগণের ক্রীড়াভূমি বিরাজমান রহিয়াছে। অহো! আমরা মানবজাতির অগম্য স্থানে আসিয়াছি; আমরা সিদ্ধ হইয়াছি। হে বৃকোদর! ঐ দেখ, গন্ধমাদনসানুতে পুষ্পিতাগ্র লতা-সমুদয় কুসুমভারাবনত বৃক্ষে সংসক্ত রহিয়াছে। ঐ ময়ূর-সকল ময়ূরীগণ-সমভিব্যাহারে কেকারব করিতেছে। চকোর, শতপত্র, মত্ত কোকিল ও সারিকা প্রভৃতি পক্ষিগণ এই সমুদয় সুপুষ্পিত বৃক্ষের প্রতি ধাবমান হইতেছে। রক্ত, পীত প্রভৃতি নানা বর্ণে সুশোভিত বহুবিধ বিহঙ্গ মগণ ও চকোরকুল পাদপের অগ্রভাগে অবস্থিতি করিয়া পরস্পর অবলোকন করিতেছে। ঐ হরিতারুণ বৰ্ণ শাদ্বলের [শ্যামলতৃণাচ্ছন্ন প্রান্তর] সমীপবর্ত্তী শৈলপ্রস্রবণে সারসগণ বিচরণ করিতেছে। ভৃগরাজ, চক্ৰবাক ও কঙ্ক-পক্ষিগণ সর্ব্বভূত-মনোরম সুমধুর ধ্বনি করিতেছে। করেণুসমবেত চতুর্দ্দন্ত কুঞ্জরকুল বৈদূৰ্য্যবৰ্ণ মহাসরোবর ক্ষোভিত করিতেছে। শৈলশিখরস্থিত নানাবিধ প্রস্রবণ হইতে তালতরুসদৃশ বারিধারা নিপতিত হইতেছে; ভাস্কর-করনিকরের ন্যায় শারদ পয়োধরপুঞ্জসদৃশ রজতাদি নানা ধাতু এই মহাশৈলকে শোভিত করিতেছে। কোথাও অঞ্জনবর্ণ, কোথাও কাঞ্চনসন্নিভ, কোথাও হরিতলসদৃশ, কোথাও বা হিঙ্গুলবৰ্ণ ধাতুসকল শোভমান হইতেছে। রজতাদি নানা ধাতু পরিপূর্ণ, সন্ধ্যাভ্রসদৃশ মনঃশিলা ও গুহাসমুদয় এই মহাপর্ব্বতের শোভা সম্পাদন করিতেছে; শ্বেত ও লোহিতবৰ্ণ গৈরিক ধাতু এবং সিত, অসিত ও বালসূৰ্য্যসদৃশ অন্যান্য বহুবিধ ধাতুসকল এই পর্ব্বতের সুষমা বিস্তার করিতেছে। ঐ দেখ, গন্ধৰ্ব্ব-সকল স্ব স্ব প্ৰণয়িণী ও কিন্নরগণসমভিব্যাহারে বিহার করিতেছে; তানলয়—বিশুদ্ধ সর্ব্বভূতমনোহর সঙ্গীত ও সামগীতি শ্রুত হইতেছে। ঐ দেখ, কলহংসগণসঙ্কীর্ণ ঋষিকিন্নরসেবিত পরমপবিত্র দেবনদী মহাগঙ্গা বিরাজিত হইতেছেন। হে ভীমসেন! বিবিধ ধাতু, সরিৎ, কিন্নর, মৃগ, পক্ষী, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরা, মনোহর কানন ও বিবিধাকার শতশীর্ষ সৰ্পকুলে আকীর্ণ এই শৈলীরাজ গন্ধমাদন অবলোকন কর।”
অনন্তর প্রীতিপ্রফুল্লচিত্ত, অরাতিনিপাতন, মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডুতনয়গণ বারংবার সেই গন্ধমাদনপর্ব্বত অবলোকন করিয়াও পরিতৃপ্ত হইলেন না। তৎপরে তাঁহারা বিবিধ ফলশালী মহীরুহ ও মাল্যসমূহে পরিশোভিত উগ্ৰতপাঃ তপঃকৃশ, ধমনী [শিরা] ব্যাপ্তকলেবর, সর্ব্বধর্ম্মপারগ, রাজর্ষি আষ্টিষেণের বিবিধ ফলশালী মহীরুহ ও মাল্যসমূহে পরিশোভিত আশ্রম অবলোকন করিয়া তাঁহার সমীপে গমন করিলেন।