১৫৮তম অধ্যায়
উলূকদূতগমনপর্ব্বাধ্যায়
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাত্মা পাণ্ডবগণ কুরুক্ষেত্রে হিরগ্ধতীনদীর নিকট অবস্থান করিলে পর কৌরবেরাও তথায় প্রবেশ করিলেন। রাজা দুৰ্য্যোধন অভ্যাগত ভূপালগণকে সম্মান ও সেই স্থানে সেনানিবেশ সংস্থাপন করিয়া রক্ষণীয় দ্রব্যাদিসকল স্থাপিত করিয়া কৰ্ণ, দুঃশাসন, শকুনি ও অন্যান্য পার্থিবগণকে আনয়নপূর্ব্বক মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন। অনন্তর শকুনির পরামর্শানুসারে উলূকদূতকে আহ্বান করিয়া নির্জ্জনে কহিলেন, ‘হে উলূক’! তুমি সোমক ও পাণ্ডবগণের নিকট গমন করিয়া আমার বাক্যানুসারে বাসুদেবসমক্ষে তাঁহাদিগকে কহিবে, এক্ষণে বহুবর্ষচিন্তিত মহাভয়ঙ্কর কৌরব ও পাণ্ডবগণের যুদ্ধ সমুপস্থিত হইয়াছে। সঞ্জয় যে কৌরবদিগের মধ্যে কৃষ্ণের, আপনার ও আপনার ভ্রাতৃগণের আত্মশ্লাঘা প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহার কাল সমুপস্থিত হইয়াছে। এক্ষণে আপনারা যেরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, তাহার অনুষ্ঠান করুন। অনন্তর পাণ্ডবপ্রধান যুধিষ্ঠিরকে কহিবে যে, আপনি ধাৰ্মিক হইয়া ভ্রাতৃগণের সহিত কিরূপে অধর্মে মনোনিবেশ করিলেন? আমি বোধ করিতাম, আপনি সকলকেই অভয়প্ৰদান করিয়া থাকেন; কিন্তু এক্ষণে কিরূপে নৃশংসের ন্যায় সমস্ত জগৎ বিনাশ করিতে উদ্যত হইয়াছেন? যখন দেবগণ প্রহ্লাদের রাজ্য অপহরণ করিয়াছিলেন, তখন প্ৰহ্লাদ তাঁহাদিগকে সম্বোধন করিয়া এই কথা কীর্ত্তন করেন, হে দেবগণ! যে ব্ৰতের দর্ভপাণিত্ব [কুশলহস্ততা-করে কুশধারণ] প্রভৃতি ধর্ম্মচিহ্ন লোকমধ্যে বিখ্যাত হয় এবং পাপসমুদয় প্রচ্ছন্ন [গুপ্ত] থাকে, তাহা বৈড়ালব্রত [ভণ্ডতপস্যা— বিড়ালের আমিষত্যাগতুল্য মিথ্যা ভাণ] বলিয়া অভিহিত হয়। এই বিষয়ে দেবর্ষি নারদ আমার পিতার নিকট যে উপাখ্যান কীর্ত্তন করিয়াছিলেন, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ করুন।
বিড়ালতপস্বীর উপাখ্যান
“ ‘কোনো সময়ে এক দুরাত্মা মার্জার সকল কর্মে নিরপেক্ষ ও উৰ্দ্ধবাহু হইয়া ভাগীরথীতীরে অবস্থান করিতে লাগিল এবং সকলের প্রত্যয়ের নিমিত্ত অহিংসাপরায়ণের ভাণ করিয়া “আমি ধর্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছি”, এই কথা সকলের নিকট প্রচার করিতে আরম্ভ করিল। এইরূপে বহুকাল গত হইলে ঐ মার্জার পক্ষিগণের বিশ্বাসভাজন [প্রত্যয়ের পাত্র] হইয়া উঠিল। তখন পক্ষীরা সমবেত হইয়া তাহার প্রশংসা করিতে লাগিল। মার্জার পক্ষিসকলের আদরভাজন হইয়া মনে করিল, এতদিনে আমার ব্ৰতচৰ্য্যার [অভিসন্ধির] ফললাভ ও স্বীকাৰ্য্য সংসাধিত হইল।
“ “কিয়ৎকাল অতীত হইলে মূষিকেরা [ইন্দুরেরা] তথায় সমুপস্থিত হইয়া ধর্ম্মপরায়ণ ব্ৰতচারী, সাতিশয় দাম্ভিক [নিজগুণকীর্ত্তনকারী] মার্জারকে অবলোকন করিয়া মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিল, আমাদের অনেক শত্ৰু, অতএব ইনি আমাদিগের মাতুল হইয়া আবালবৃদ্ধ সকলকেই রক্ষা করুন। অনন্তর তাহারা বিড়ালসন্নিধানে গমন করিয়া কহিল, “হে মার্জার শ্রেষ্ঠ! আমরা আপনার শরণাপন্ন হইলাম, এক্ষণে আমরা আপনার অনুগ্রহে স্বেচ্ছাক্রমে সঞ্চরণ করিতে ইচ্ছা করি, আপনি আমাদিগের একমাত্ৰ গতি ও পরম সুহৃৎ। আপনি নিরন্তর ধর্ম্মকর্মে দীক্ষিত হইয়া আছেন; অতএব যেমন ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্র দেবগণকে রক্ষা করিয়া থাকেন, তদ্রূপ আমাদিগকে রক্ষা করুন।” তখন মুষিকান্তক [ইন্দরভক্ষক] মার্জ্জর কহিল, “হে মূষিকগণ! তপানুষ্ঠান ও রক্ষাবিধান—এই দুইটি বিষয়ের এককালীন অনুষ্ঠান নয়নগোচর হয় না; যাহা হউক, তোমাদের হিতানুষ্ঠান করা আমার কর্ত্তব্য হইতেছে; কিন্তু আমি যাহা বলিব, প্রতিদিন তোমাদিগকে তাহা প্রতিপালন করিতে হইবে। আমি যখন নিয়মাবলম্বী হইয়া তপস্যায় নিতান্ত ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হইব, যখন আমার চলৎশক্তি রহিত হইবে, তখন তোমরা আমাকে এই স্থান হইতে ভাগীরথীতীরে লইয়া যাইবে।” মুষিকেরা আবালবৃদ্ধসকলেই মার্জারের বাক্যে স্বীকার করিয়া তাহার হস্তে আপনাদিগকে সমপৰ্ণ [আত্মসমর্পণ] করিল।
ডিণ্ডকমূষিক-কথা
“ ‘অনন্তর পাপাত্মা মার্জার মূষিকদিগকে ক্ৰমে ক্ৰমে ভক্ষণ করিয়া পীবর [স্থূল], দৃঢ়কায় [কঠিনদেহ] ও লাবণ্যসম্পন্ন [শ্ৰীযুক্ত] হইয়া উঠিল; কিন্তু মূষিকসকল পূর্ব্বাপেক্ষা অল্প হইতে লাগিল। তখন মুষিকসকল একত্র সমবেত হইয়া কহিল, “দেখ, আমাদিগের মাতুল মার্জার প্রতিনিয়ত পরিবর্দ্ধিত হইতেছেন; আমরা সংখ্যায় অল্প হইতেছি।” এই অবসরে প্রাজ্ঞতম [অতি জ্ঞানী] ডিণ্ডিকনামক এক মুষিক সকলকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “হে মূষিকগণ! যখন তোমরা একত্র হইয়া নদীতীরে গমন করিবে, তৎকালে আমি একাকী মাতুলের সহিত তোমাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিব।” এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র মুষিকগণ তাহাকে সাধুবাদ প্রদান ও যথোচিত সৎকার করিয়া তাহার বাক্যানুসারে গঙ্গাতীরে গমন করিল। ডিণ্ডিকও মাজারের সহিত তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। তখন মার্জার সবিশেষ পরিজ্ঞাত না হইয়া ডিণ্ডিককে ভক্ষণ করিল। অনন্তর মুষিকেরা পরস্পর মন্ত্রণা করিবার নিমিত্ত সমবেত হইলে বৃদ্ধতম কোকিলনামে এক মূষিক কহিল, “হে মূষিকগণ! আমাদের মাতুল ধর্ম্মার্থী [ধাৰ্মিক সন্ন্যাসী] নহেন, ইনি কপট [ভণ্ড] শিখা ধারণ করিয়াছেন। ইঁহার বিষ্ঠা লোমযুক্ত দেখিতেছি, কিন্তু ফলমূলভোজীর পুরীষ কদাচ লোমশ [লোমযুক্ত] হয় না।” আর ইঁহার সংখ্যা ক্ৰমশ হ্রাস হইয়া আসিতেছে; বিশেষতঃ আজি সাত-আট দিন হইল, আমরা ডিণ্ডিককে আর দেখিতে পাই না।” এই কথা শ্ৰবণ করিবামাত্র মুষিকেরা তথা হইতে ধাবমান [পলায়িত] হইল; দুষ্ট বিড়ালও স্বস্থানে প্রস্থান করিল।
যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশ্যে উলূকের প্রমুখাৎ দুরুক্তি
“ ‘হে পাণ্ডব! তদ্রূপ আপনিও বিড়ালব্রত [ভণ্ডতপস্বিব্রত] অবলম্বন করিয়াছেন এবং মার্জার যেরূপ মুষিকদিগের প্রতি ব্যবহার করিয়াছিল, সেইরূপ আপনিও জ্ঞাতিবর্গের সহিত তদ্রূপ ব্যবহার করিতেছেন। আপনার কথা একরূপ, কিন্তু কাৰ্য্য তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত। আপনি কেবল লোকদিগকে প্রদর্শন করিবার নিমিত্তই বেদধ্যয়ন ও শান্তি অবলম্বন করিয়াছেন; এক্ষণে কপটাচার পরিহার ও ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম আশ্রয় করিয়া কাৰ্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হউন। আপনি লোকের নিকট ধাৰ্মিক বলিয়া পরিচিত আছেন, অতএব নিজ বাহুবলে পৃথিবী লাভ করিয়া ব্রাহ্মণগণকে ধনদান ও পিতৃলোকের শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়াকলাপ নির্ব্বাহ করুন। রণে জয়লাভ করিয়া চিরদুঃখিনী জননীর অশ্রুজলমার্জ্জন ও সর্ব্বত্র সম্মানলাভ করুন। আপনারা আগ্রহাতিশয় সহকারে পঞ্চগ্রাম প্রার্থনা করিয়াছিলেন, কিন্তু আমরা তাহা প্রত্যাৰ্পণ করি নাই। ইহা ব্যতীত আপনাদিগের যুদ্ধোদ্যোগ ও ক্ৰোধোদ্রেকের কোন কারণ সন্দর্শন করি না। আমি আপনার নিমিত্তই দুষ্টস্বভাব বিদুরকে পরিত্যাগ করিয়াছি। এক্ষণে আপনি জতুগৃহদাহবৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া পুরুষকার প্রদর্শন করুন। যখন কৃষ্ণ কৌরবসভায় আগমন করেন, তৎকালে আপনি আমাদিগের কর্ণগোচর করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে কহিয়াছিলেন যে, আমি শান্তি অবলম্বন ও যুদ্ধোদ্যোগ উভয় বিষয়েই প্রস্তুত আছি; এক্ষণে সেই যুদ্ধকাল উপস্থিত হইয়াছে। যুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্ৰিয়দিগের পরমলাভ আর কিছুই নাই; এই বলিয়া আমি সংগ্রামিক দ্রব্য আহরণ করিয়াছি।
“ ‘আপনি ক্ষত্ৰিয়কুলে জন্মগ্রহণ, পৃথিবীতে খ্যাতিলাভ এবং কৃপ ও দ্রাণাচাৰ্য্য হইতে অস্ত্ৰশিক্ষা করিয়া এক্ষণে তুল্যবল ও তুল্যবংশসমুৎপন্ন [নিজকুলজাত] ব্যক্তি থাকিতে কি নিমিত্ত বাসুদেবকে আশ্রয় করিলেন?
কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে কটুক্তি
“ “হে উলূক! তুমি পাণ্ডবগণসমক্ষে বাসুদেবকে কহিবে, তুমি আপনার ও পাণ্ডবগণের নিমিত্ত যত্নবান হইয়া আমার সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও। সভামধ্যে মায়াপ্রভাবে যেরূপ শরীর পরিগ্রহ করিয়াছিলে, এক্ষণে সেই রূপ ধারণ করিয়া অর্জ্জুনের সহিত আমার প্রতি ধাবমান হও। ইন্দ্ৰজাল [যাদুবিদ্যা], মায়া বা অতি ভীষণ কুহক [ভ্ৰান্তিজনক মায়িক কাৰ্য্য]—এই সকল যুদ্ধে গৃহীতাস্ত্র [অস্ত্ৰধারী] বীরপুরুষকে কদাচ বিভীষিকা৷ প্রদর্শন করিতে সমর্থ হয় না। আমরাও মায়াবলে নভোমণ্ডলে পর্য্যটন, রসাতলে প্রবেশ, ইন্দ্রনগরী আমরাবতীতে গমন করিতে পারি এবং সশরীরে বিবিধ রূপ প্ৰদৰ্শন করিতে পারি, কিন্তু ভয়প্রদর্শনাদিদ্বারা আপনার সিদ্ধিলাভ হওয়া নিতান্ত সুকঠিন। ঈশ্বরই মানুষকে বশীভূত করিতে সমর্থ হয়েন। কিন্তু এইরূপ বিভীষিকা কখনই তাঁহাদিগকে ভয়প্রদর্শন করিতে পারে না। হে কৃষ্ণ! তুমি কহিয়া থাক, আমি ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে সমরে সংহার করিয়া পাণ্ডবগণকে রাজ্যপ্ৰদান করিব; আমি যাহার সাহায্য করিয়া থাকি, সেই অর্জ্জুনের সহিত ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের শত্রুভাব জন্মিয়াছে; সুতরাং আর তাহাদের নিস্তার নাই; সঞ্জয় আমাকে এসকল কহিয়াছে; অতএব তুমি এক্ষণে স্থিরপ্রতিজ্ঞ [বাক্যরক্ষায় দৃঢ়—সত্যবাদী] ও পাণ্ডবগণের কাৰ্য্যসাধনাৰ্থ যত্নবান হইয়া পৌরুষপূর্ব্বক সংগ্রামে প্ৰবৃত্ত হও। যে ব্যক্তি পৌরুষবলে বিপক্ষগণের শোকবৰ্দ্ধন করিয়া থাকেন, তাঁহারই জন্ম সার্থক। হঠাৎ তোমার যশোরাশি লোকমধ্যে বিস্তীর্ণ হওয়াতে আজি জানিলাম, অনেক পুংচিহ্ন[পুরুষলক্ষণ]ধারী নপুংসক আছে। তুমি মহারাজ কংসের ভৃত্য; তোমার সহিত যুদ্ধ করা আমার সমকক্ষ ভূপালগণের কদাচ উচিত হয় না।
ভীম-নকুলাদি প্রতি উক্তি
“ ‘হে উলূক’! তুমি সেই বহুভোজী, তুবর [একশৃঙ্গ-গো], মূর্খ, বালক ভীমসেনকে বারংবার কহিবে, হে ভীম! তুমি পূর্ব্বে বিরাটনগরে বল্লভনামে বিখ্যাত হইয়া যে সূপকার[পাচক]বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছিলে তাহা আমারই পুরুষকার। পূর্ব্বে তুমি সভামধ্যে যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে, তাহা যেন মিথ্যা না হয়। এক্ষণে যদি তুমি সমর্থ হও, দুঃশাসনের শোণিত পান কর। তুমি কহিয়া থাক, আমি ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগকে সমরে বলপূর্ব্বক সংহার করিব। এক্ষণে তাহার কাল উপস্থিত হইয়াছে। তুমি পানভোজনে পুরুষকার লাভ করিতে পার; কিন্তু ভোজনই বা কোথায় ও যুদ্ধই বা কোথায়? যদি তুমি পুরুষকার প্রদর্শন করিয়া যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও, তাহা হইলে নিশ্চয়ই গদা আলিঙ্গনপূর্ব্বক ধরাশয্যায় শয়ন করিবে। হে বৃকোদর! এক্ষণে বোধ হইতেছে, তুমি তৎকালে সভামধ্যে বৃথা আস্ফালন করিয়াছিলে। হে উলূক! তুমি আমার বাক্যানুসারে নকুলকে কহিবে, হে নকুল! তুমি সুস্থির হইয়া যুদ্ধ করিলে আমরা তোমার পৌরুষ দর্শন করিব। তুমি এক্ষণে যুধিষ্ঠিরের প্রতি অনুরাগ, আমার প্রতি দ্বেষ ও দ্রৌপদীর ক্লেশপরম্পরা স্মরণ কর। হে দূত! ভূপালগণমধ্যে সহদেবকে কহিবে, হে সহদেব! তুমি সমুদয় ক্লেশ স্মরণ করিয়া যুদ্ধে যত্নবান হও। পরে বিরাট ও দ্রুপদকে কহিবে, হে বীরগণ! আমি তোমাদের গুণবান স্বামী, তথাপি তোমরা আমার প্রতি সন্তুষ্ট হইলে না; অতএব তোমরা অতি মূঢ়। আর রাজা যুধিষ্ঠির যখন তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছেন, তখন তিনিও মূঢ়। অতএব তোমরা একত্র সমবেত হইয়া আমাকেও বধ করিতে পার। এক্ষণে পাণ্ডবগণের উদ্দেশ্য সিদ্ধির নিমিত্ত সমবেত হইয়া আমার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। হে উলূক! তুমি পাঞ্চালতনয় ধৃষ্টদ্যুম্নকে কহিবে, হে ধৃষ্টদ্যুম্ন! এক্ষণে সমরে দ্রোণাচাৰ্য্যকে প্রাপ্ত হইয়া আপনার হিতকর বিষয় সমস্ত জ্ঞাত হইবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। অতএব পাণ্ডবগণের সহিত মিলিত হইয়া নিতান্ত দুষ্কর গুরুবধরূপ স্বীয় কাৰ্য্যসংসাধনের নিমিত্ত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও।
রাজা দুৰ্য্যোধন তোমাকে স্ত্রীলোকের ন্যায় নিতান্ত হীনবীৰ্য্য মনে করিয়া বিনাশ করিবেন না। নির্ভীক মহাধনুৰ্দ্ধর ভীষ্মদেবই যুদ্ধ করিবেন; অতএব তুমি যত্নবান হইয়া যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও; আমরা তোমার পৌরুষ প্ৰদৰ্শন করিব।”
পুনঃ অর্জ্জুনের প্রতি উক্তি
“এই বলিয়া রাজা দুৰ্য্যোধন সহাস্যমুখে উলূককে কহিলেন, ‘হে দূত! তুমি বাসুদেবসমক্ষে পুনরায় অর্জ্জুনকে কহিবে, হে অর্জ্জুন! আমাদিগকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া তোমাকে এই পৃথিবী শাসন বা আমাদিগের শরজালে বিনষ্ট হইয়া রণস্থলে শয়ন করিতে হইবে। এক্ষণে নির্ব্বাসনক্লেশ, বনবাসদুঃখ ও দ্রৌপদীর পরাভববৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া পুরুষকার প্রদর্শন কর। যে নিমিত্ত ক্ষত্রিয়রমণীরা সন্তান প্রসব করিয়া থাকেন, তাহার কাল উপস্থিত হইয়াছে। এক্ষণে তুমি বল, বীৰ্য্য, শৌৰ্য্য, অস্ত্ৰ-লাঘব ও পৌরুষ প্রদর্শন করিয়া কোপ অপনীত [নিরসন—দূর] করা। বহুবিধ ক্লেশে ক্লিষ্ট, নিতান্ত দীন, দীর্ঘকাল প্রোষিত [প্রবাসিত—প্রবাসে স্থিত] ও ঐশ্বৰ্য্যপরিভ্রষ্ট [বিষয়চ্যুত] হইলে কোন ব্যক্তির হৃদয় বিদীর্ণ না হয়? পুরুষপরম্পরাগত [পুর্ব্বপুরুষ হইতে ধারাবাহিকরূপে আগত] রাজ্য আক্রমণ করিলে কোন সৎকুলজাত মহাবীর পরস্বপহরণ-পরাঙ্মুখ [পরধনহরণে বিমুখ] ব্যক্তির ক্ৰোধের উদ্রেক না হয়? যে ব্যক্তি অকৰ্মণ্য হইয়া কেবল বাক্যদ্বারা আত্মশ্লাঘা করিয়া থাকে। সে কাপুরুষ। অতএব তুমি পূর্ব্বে যেসকল কথা কহিয়াছিলে, কাৰ্য্যে তাহা প্রদর্শন কর। বিপক্ষগণের হস্তগত স্থান ও রাজ্য পুনরায় উদ্ধার কর; যুদ্ধার্থী ব্যক্তির এই দুইটিই প্রয়োজন। এক্ষণে পৌরুষ প্রদর্শন করা তোমার কর্ত্তব্য হইতেছে। তুমি দ্যূতে পরাজিত হইয়াছ এবং তোমাদের প্রণয়িনী দ্রুপদনন্দিনী সভায় আনীত হইয়াছিল; সুতরাং ইহাতে পুরুষাভিমানী ব্যক্তির অবশ্যই ক্ৰোধোদ্রেক [ক্রোধের উদয়] হইতে পারে। তুমি দ্বাদশ বৎসর বনে নির্ব্বাসিত হইয়াছিলে এবং এক বৎসর বিরাটের দাসত্ব স্বীকার করিয়া তাঁহার ভবনে অজ্ঞাতবাস করিয়াছিলে। এক্ষণে তুমি নির্ব্বাসনদুঃখ ও দ্রুপদনন্দিনীর ক্লেশ স্মরণ করিয়া পৌরুষ প্রদর্শন কর। যাহারা বারংবার তোমার প্রতি শক্রসমুচিত কথা প্রয়োগ করিয়াছিল, তুমি তাহাদিগের উপর রোষ প্রকাশ কর, রোষই পুরুষকার। তুমি পুরুষকারসহকারে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও; লোকে রণস্থলে তোমার ক্ৰোধ, বল, বীৰ্য্য, জ্ঞানযোগ ও লঘুহস্ততা দর্শন করুক। তোমার অস্ত্রশস্ত্রের নীরাজনবিধি [অর্চ্চন ও আরতিদ্বারা সংস্কৃত] সমাহিত, কুরুক্ষেত্র কর্দমশূন্য, অশ্বসকল হৃষ্টপুষ্ট ও যোদ্ধৃগণ সুসজ্জিত হইয়াছে; অতএব কল্যই কেশবকে সহায় করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। তুমি রণস্থলে ভীষ্মের সহিত সমাগত না হইয়া বৃথা আত্মশ্লাঘা করিতেছ। যেমন মন্দগামী ব্যক্তি গন্ধমাদনপর্ব্বতে আরোহণ করিবার নিমিত্ত আত্মশ্লাঘা করিয়া থাকে, তদ্রূপ তুমিও আত্মশ্লাঘা করিতেছ; এক্ষণে অহঙ্কার পরিহার করিয়া পুরুষকার প্রদর্শন কর। তুমি নিতান্ত দুৰ্দ্ধর্ষ সূতপুত্র, মহাবলপরাক্রান্ত শল্য ও দেবরাজতুল্য দ্রোণাচাৰ্য্যকে পরাজিত না করিয়া কিরূপে রাজ্যাভিলাষ করিতেছ? যিনি ব্রহ্মবিদ্যা ও ধনুর্ব্বিদ্যার আচাৰ্য্য, যিনি বেদ ও শাস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী, যিনি যুদ্ধে সকলের ধুরন্ধর এবং নিতান্ত অক্ষুব্ধ, সেই সেনানায়ক বিজয়ী দ্রোণাচাৰ্য্যকে পরাজিত করিতে বৃথা ইচ্ছা করিয়াছ। বায়ুভরে সুমেরুগিরি উন্মুলিত হইয়াছে, এ কথা আমরা কখনই শ্রবণ করি নাই। তুমি যাহা কহিয়াছ, তাহা যদি যথার্থ হয়, তাহা হইলে অনিল সুমেরু বহন করিবে, নভোমণ্ডল ভূতলে নিপতিত হইবে এবং যুগ পরিবর্ত্তিত হইবে।
“ ‘কোন ব্যক্তি ভীষ্ম বা দ্রোণের শরে আহত হইয়া জীবনাভিলাষী হইয়া থাকে? অর্জ্জুন হউক বা অন্য ব্যক্তিই হউক, দ্রোণ ও ভীষ্মের শরাঘাতপ্রাপ্ত হইলে কেহই নির্ব্বিঘ্নে গৃহে প্ৰতিগমন করিতে সমর্থ হয় না। তাহারা যাহাকে বিনাশ করিতে অভিলাষ করেন, সে নিদারুণ শরজালে ভিন্নকলেবর [ছিন্নদেহ] হইয়া জীবিকাবস্থায় তাঁহাদের হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া কদাচ গমন করিতে পারে না। রে মূঢ়মতে! তুমি কূপমণ্ডুকের [সর্ব্ববিষয়ে অবিদিত-ব্যাঙ কূপে থাকে, সে মনে করে—কুপ ভিন্ন সংসারে আর কোন স্থান নাই] ন্যায় নৃপতিরক্ষিত দেবসেনাসদৃশ নিতান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ সেনাসমুদয় সমবেত হইয়াছে, ইহা কি অবগত হইতেছে না? আমি যখন হস্তিসৈন্যমধ্যে অবস্থিত হইব, তৎকালে কি তুমি আমার ও দুর্নিবার বেগবতী ভাগীরথীপ্রবাহের ন্যায় অনিবার্য্য পূর্ব্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তরদেশীয় ভূপাল, কাম্বোজ, শক, খগ, শাল্ব, মৎস্য, কুরুমধ্যদেশীয় স্লেচ্ছ, পুলিন্দ, দ্রাবিড় ও অন্ধকসংস্কুল জনসমূহের সহিত সংগ্রাম করিতে অভিলাষ করিতেছ? আমরা রণস্থলে তোমার অক্ষয় তূণীর, অগ্নিদত্ত রথ ও দিব্যকেতুর প্রভাব অবগত হইব। তুমি অহঙ্কারপরতন্ত্র না হইয়া যুদ্ধে অগ্রসর হও, আত্মশ্লাঘা করিলে কি হইবে? রণস্থলে নানাপ্রকার অস্ত্রকৌশল প্ৰদৰ্শন করিলেই শ্লাঘা সফল হইয়া থাকে; কিন্তু কেবল বাক্যে কদাচ উহা সপ্রমাণ হইতে পারে না। শ্লাঘা প্ৰকাশ করিতে কেহই অশক্ত নহে; যদি কেবল শ্লাঘা প্রকাশ করিলে কার্য্য সিদ্ধ হইত, তাহা হইলে সকলেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিত। আমি তোমার তালপ্রমাণ গাণ্ডীব ও প্রধান সহায় বাসুদেবকে জ্ঞাত হইয়াছি; তোমার সদৃশ যোদ্ধা আর নাই, তাহাও সবিশেষ অবগত আছি; তথাপি তোমার সমস্ত রাজ্যসম্পত্তি অপহরণ করিয়া ভোগ করিতেছি।
“ ‘মানবগণ কখন সঙ্কল্পদ্বারা সিদ্ধিলাভ করিতে সমর্থ হয় না, বিধাতাই সঙ্কল্পদ্বারা অনুকূল কাৰ্য্যসকল সংসাধন করিয়া থাকেন। দেখ, আমি তোমাকে দুঃখসাগরে নিমগ্ন করিয়া ত্ৰয়োদশ বৎসর রাজ্যভোগ করিয়াছি; এক্ষণে আবার বান্ধবগণের সহিত তোমাকে সংহার করিয়া সেই রাজ্য শাসন করিব। যখন তুমি দাসত্বপণে পরাজিত হইয়াছিলে, তখন তোমার গাণ্ডীব এবং ভীমসেনের বলবীৰ্য্য ও গদা কোথায় ছিল? দ্রৌপদী ব্যতিরেকে তোমাদিগের মুক্তিলাভের আর প্রত্যাশা ছিল না। সেই দ্রৌপদীই তোমাদিগকে দাসত্বশৃঙ্খল হইতে বিমোচন করিয়াছে। তোমরা বিরাটনগরে মনুষ্যত্বশূন্য হইয়া দাসকৰ্মে নিযুক্ত ছিলে; সুতরাং আমি যে তৎকালে তোমাদিগকে ষণ্ডতিল [শাঁসশূন্য তিল—তিলের খোসা] কহিয়াছিলাম তাহা নিতান্ত অমূলক নহে। আমারই পৌরুষপ্রভাবে ভীম বিরাটরাজের মহানসে [রন্ধনশালায়] সূপকারবৃত্তি অবলম্বন করিয়া একান্ত ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হইয়াছিল; তুমি ষণ্ডবেশ [নপুংসকবেশ—ক্লীবভাব] পরিগ্রহ ও বেণী ধারণ করিয়া বিরাটরাজদুহিতা উত্তরাকে নৃত্যশিক্ষা করাইয়াছিলে। দেখ, ক্ষত্ৰিয়েরা ক্ষত্ৰিয়দিগের প্রতি এইরূপই দণ্ডবিধান করিয়া থাকেন। স্ত্রীবেশধারী পুরুষ স্ত্রী অপেক্ষা অধম; কারণ, কামিনীরা স্মরযুদ্ধ [কামযুদ্ধ] উপস্থিত হইলে পরাঙ্মুখ হয় না, কিন্তু স্ত্রীবেশধারী পুরুষ পলায়ন করে; অতএব আমি তোমার ও বাসুদেবের ভয়ে ভীত হইয়া কদাচ রাজ্যপ্ৰদান করিব না, তুমি এক্ষণে কেশবসমভিব্যাহারে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। মায়া, ইন্দ্ৰজাল বা অতিভীষণ কুহকসকল সমরে অস্ত্ৰধারা বীরপুরুষকে কখনই বিভীষিকা প্রদর্শন করিতে সমর্থ হয় না। সহস্র বাসুদেব বা শত শত অর্জ্জুন সমরে আমার সম্মুখীন হইলেও অবশ্যই তাঁহাদিগকে দিগদিগন্তে পলায়ন করিতে হইবে। তুমি সংযুগে [যুদ্ধে] ভীষ্মের সহিত সমাগত হও বা মস্তকদ্বারা গিরি বিদীর্ণকর অথবা বাহুদ্বারা অগাধ [অসীম] ও সৈন্যসাগর [সৈন্যরূপ সমুদ্ৰ—গভীর জল বলিয়া সাগরের যেমন তল নিরূপিত হয় না, সৈন্যও অগণিত বলিয়া তাহার সংখ্যা করা যায় না] উত্তীর্ণ হও, আমার সম্মুখীন হইলে দিগ্দিগন্তে [সর্ব্বদিকে] পলায়ন করিতে হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। ঐ মহাসাগরে শারদ্বত মীন, বিবিংশতি উরগ, ভীষ্ম প্রবলবেগ, দ্ৰোণ দুরাসদ [দুৰ্দ্ধৰ্ষ মকর] গ্রাহ , কৰ্ণ আবর্ত্ত, কাম্বোজ বাড়বানল, সোমদত্তি তিমিঙ্গিল, বৃহদ্বল মহাতরঙ্গ, শ্রুতায়ু, হাদ্দির্ক্য ও যুযুৎসু সলিল, ভগদত্ত প্ৰবল মারুত, দুঃশাসন মহাপ্রবাহ, জয়দ্ৰথ অভ্যন্তরগিরি [জলমধ্যস্থ পর্ব্বত], শকুনি কুল [তীর] সুগণ মাতঙ্গ [জলহস্তী], চিত্রায়ুধ নক্র [কুম্ভীর] এবং পুরুমিত্র গাম্ভীৰ্য্য। তুমি যখন মহাসমুদ্রে অবগাহন করিয়া হতবান্ধব ও পরিশ্রমে একান্ত ক্লান্তচিত্ত হইবে, তখন তোমার পরিতাপের আর পরিসীমা থাকবে না। যেমন অশুচি ব্যক্তির মন স্বৰ্গ হইতে প্রতিনিবৃত্ত হয়, তদ্রূপ তোমার মন পৃথিবীর শাসন হইতে বিনিবর্ত্তিত [নিবৃত্ত] হইবে। যেমন তপানুষ্ঠান পরাঙ্মুখ ব্যক্তি স্বৰ্গ প্রাপ্ত হইতে অভিলাষ করে, তদ্রূপ তুমিও নিতান্ত দুর্লভ রাজ্যলাভ করিতে ইচ্ছা করিতেছ।’ ”