১৫৬তম অধ্যায়
সোমদত্তের সাত্যকিসংহার প্রতিজ্ঞা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এ দিকে মহারথ সোমদত্ত মহাবীর সাত্যকির হস্তে প্রায়োপবিষ্ট স্বীয় পুত্র ভূরিবার নিধন দর্শনে সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া শৈনেয়কে কহিতে লাগিলেন, হে যুযুধান! তুমি দেবনির্দ্দিষ্ট ক্ষত্রিয়ধর্মের অনুষ্ঠানে রত ও বিজ্ঞ বলিয়া প্রসিদ্ধ; তবে তুমি কিরূপে সেই ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম পরিত্যাগ পূর্ব্বক দস্যুবৃত্তি অবলম্বন করিয়া রণপরাঙ্মুখ, অস্ত্রশস্ত্রত্যাগী, অতি দীন ভূরিশ্রবাকে প্রহার করিলে? বৃষ্ণিবংশে মহাবীর প্রদ্যুম্ন ও তুমি, তোমরা এই দুইজন মহারথ ও মহাতেজস্বী বলিয়া বিখ্যাত আছ; কিন্তু তুমি কিরূপে সেই অর্জ্জুনশরে ছিন্নবাহু, প্রায়োপবিষ্ট ভূরিশ্রবার প্রতি নিষ্ঠুরতাচরণে প্রবৃত্ত হইলে? যাহা হউক, এক্ষণে অবশ্যই তোমাকে সেই নিষ্ঠুরতাচরণের ফলভোগ করিতে হইবে। আজই শরদ্বারা তোমার মস্তকচ্ছেদন করিব। হে দুরাত্ম বৃষ্ণিকুলাঙ্গার! আমি আমার পুত্রদ্বয়, যজ্ঞ ও সুকৃতদ্বারা শপথ করিয়া কহিতেছি যে, যদি অর্জ্জুন তোমাকে রক্ষা না করেন, তাহা হইলে এই রাত্ৰিমধ্যেই তোমাকে এবং তোমার পুত্র ও অনুজগণকে বিনাশ করিব। যদি আমার এই প্রতিজ্ঞা বিফল হয়, তাহা হইলে যেন আমি ঘোরতর নরকে নিপতিত হই। মহাবলপরাক্রান্ত সোমদত্ত এই কথা বলিয়া ক্রোধভরে শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ করিতে লাগিলেন।
সাত্যকির সোমদত্তবধ-প্রতিজ্ঞা
“তখন মহাবলপরাক্রান্ত রক্তনেত্র সাত্যকি ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সোমদত্তকে কহিলেন, ‘হে কৌরবেয়! তোমার বা অন্য কাহারও সহিত যুদ্ধ করিতে আমার অন্তঃকরণে কিছুমাত্র ভয়সঞ্চার হয় না। তুমি সমস্ত সৈন্যপরিরক্ষিত হইয়া যুদ্ধ করিলেও আমি কিছুমাত্র ব্যথিত হইব না। আমি ক্ষত্রিয়ধর্ম্মাবলম্বী; তুমি সমরকালে অনর্থক বাক্যপ্রয়োগ করিয়া আমাকে বিভীষিকা প্রদর্শন করিতে সমর্থ হইবে না। যদি আমার সহিত তোমার যুদ্ধ করিতে বাসনা হইয়া থাকে, তবে আইস, উভয়েই নির্দ্দয়ভাবে নিশিতপ্রহারে প্রবৃত্ত হই। আমি তোমার মহাবলপুত্র ভূরিশ্রবাকে নিধন এবং শল ও বৃষসেনকে পরাভূত করিয়াছি; তুমিও একজন মহাবলশালী, অতএব ক্ষণকাল রণস্থলে অবস্থান কর; আজ পুত্র ও বান্ধবগণসমভিব্যাহারে তোমাকে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিব। তুমি দান, দম, শৌচ, অহিংসা, স্ত্রী, ধৃতি ও ক্ষমা প্রভৃতি অবিনশ্বর গুণসমূহে ভূষিত মৃদঙ্গকেতু রাজা যুধিষ্ঠিরের তেজঃপ্রভাবে নিহত প্রায় হইয়াছ। এক্ষণে কর্ণ ও সৌবলসমভিব্যাহারে তোমাকে অবশ্যই শমনসদনে গমন করিতে হইবে। যদি তুমি রণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন কর, তাহা হইলে মুক্ত হইতে পারিবে; নতুবা আমি কৃষ্ণের চরণ ও ইষ্টাপূৰ্ত্তদ্বারা শপথ করিয়া কহিতেছি যে, আজ তোমাকে পুত্রের সহিত বিনষ্ট করিব।’ হে মহারাজ! সেই পুরুষপ্রধান বীরদ্বয় পরস্পর এইরূপ বাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক শরসম্পাতে প্রবৃত্ত হইলেন।
পাণ্ডবসহায় সাত্যকি-কৌরবসহায় সোমদত্তযুদ্ধ
“ঐ সময় মহারাজ দুৰ্য্যোধন অযুত হস্তী ও অশ্ব এবং সহস্র রথ লইয়া সোমদত্তকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক অবস্থান করিতে লাগিলেন। আপনার শ্যালক যুবা শকুনি ও ইন্দ্ৰসমবিক্রম ভ্রাতৃগণ ও পুত্র পৌত্রগণও একলক্ষ অশ্বে পরিবৃত হইয়া মহাধনুর্দ্ধর সোমদত্তের চতুর্দ্দিকে অবস্থানপূর্ব্বক তাঁহার রক্ষায় প্রবৃত্ত হইলেন। মহাবল সোমদত্ত এইরূপে সেই বীরগণকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া সাত্যকিকে সন্নতপর্ব্বশরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন রোষপরবশ হইয়া অসংখ্য সৈন্যসমভিব্যাহারে তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইলেন। ঐ সময়ে পরস্পর প্রহরণশীল সৈন্যগণমধ্যে বাতাহত সমুদ্রনিঃস্বনসদৃশ মহাশব্দ সমুত্থিত হইল। মহাবীর সোমদত্ত সাত্যকির প্রতি নয়বাণ নিক্ষেপ করিলে মহাবলপরাক্রান্ত মহাধনুর্দ্ধর সাত্যকিও তাঁহাকে নয়শরে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর সোমদত্ত সাত্যকির শরাঘাতে অতিমাত্র বিদ্ধ ও বিগতসংজ্ঞ হইয়া রথোপরি মোহপ্রাপ্ত হইলেন। সারথি তাঁহাকে বিহুল অবলোকন করিয়া সত্বর রথ লইয়া পলায়ন করিল। তখন মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য সোমদত্তকে সাতকির শরাঘাতে অচৈতন্য অবলোকন করিয়া তাঁহার বিনাশবাসনায় তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পাণ্ডবগণ ভারদ্বাজকে আগমন করিতে দেখিয়া সাত্যকির রক্ষাৰ্থ তাহাকে পরিবেষ্টন করিলেন।
“মহারাজ! পূর্ব্বে সুরগণের সহিত ত্রৈলোক্যবিজয়াভিলাষী বলিরাজের যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, ঐ সময় পাণ্ডবগণের সহিত আচার্য্যের সেইরূপ সংগ্রাম হইতে লাগিল। তেজঃপুঞ্জকলেবর দ্রোণাচাৰ্য্য শরজালে পাণ্ডবসৈন্য সমাচ্ছন্ন ও যুধিষ্ঠিরকে বিদ্ধ করিলেন এবং সাত্যকিকে দশ, ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিংশতি, ভীমসেনকে নয়, নকুলকে পাঁচ, সহদেবকে আট, শিখণ্ডীকে শত, মৎস্যরাজ বিরাটকে আট, দ্রুপদকে দশ, দ্রৌপদীতনয়দিগকে পাঁচ পাঁচ, যুধামন্যুকে তিন, উত্তমৌজাকে ছয় এবং অন্যান্য সেনাপতিগণকে অসংখ্যশরে বিদ্ধ করিয়া যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবমান হইলেন। পাণ্ডবসৈন্যগণ এইরূপে দ্রোণশরে বিদ্ধ হইয়া আর্ত্তনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক ভয়ে চারিদিকে পলায়ন করিতে লাগিল।
“তখন মহাবীর অর্জ্জুন স্বীয় সৈন্যগণকে দ্রোণশরে ছিন্নভিন্ন অবলোকন করিয়া ঈষৎ কোপান্বিতচিত্তে আচার্য্যের প্রতি ধাবমান হইলেন। তদ্দর্শনে পাণ্ডবসৈন্যগণ পুনরায় প্রতিনিবৃত্ত হইল। অনন্তর পুনর্ব্বার পাণ্ডবগণের সহিত দ্রোণের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। হুতাশন যেমন তুলারশি দগ্ধ করিয়া থাকেন, তদ্রূপ মহা মহাবীর দ্রোণ আপনার পুত্রগণে পরিবেষ্টিত হইয়া শরানলে পাণ্ডবসৈন্যগণকে দগ্ধ করিতে লাগিলেন। তৎকালে সেই প্রচণ্ড মাৰ্ত্তণ্ডুতুল্য প্রজ্বলিত পাবকসদৃশ মহাবীর দ্রোণকে কার্মুক মণ্ডলীকৃত করিয়া প্রদীপ্ত শরনিকরে বিপক্ষসৈন্যগণকে নিরন্তর নিপীড়িত করিতে দেখিয়া কেহই নিবারণ করিতে সমর্থ হইল না। ঐ সময় যে যে ব্যক্তি দ্রোণের সম্মুখে নিপতিত হইল, তন্নিক্ষিপ্ত শরনিকর তৎক্ষণাৎ তাঁহাদিগের শিরচ্ছেদনপূর্ব্বক ভূতলে নিপাতিত করিল। এইরূপে সেই পাণ্ডবসেনা দ্রোণের শরে সমাহত ও নিতান্ত ভীত হইয়া ধনঞ্জয়ের সমক্ষেই পুনরায় পলায়ন করিতে লাগিল। তদ্দর্শনে মহাবীর অর্জ্জুন বাসুদেবকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে গোবিন্দ। তুমি এক্ষণে আচার্য্যের রথাভিমুখে অশ্বচালন কর।’ বাসুদেব অর্জ্জুনের বাক্যানুসারে রজত, গোক্ষীর, কুন্দ ও চন্দ্রের সদৃশ ধবলকায় অশ্বগণকে দ্রোণের রথাভিমুখে সঞ্চালিত করিতে লাগিলেন। তখন ভীমসেন অর্জ্জুনকে আচার্য্যের প্রতি ধাবমান দেখিয়া সারথি বিশোককে কহিলেন, ‘হে বিশোক! তুমি এক্ষণে আমাকে দ্রোণসৈন্যমধ্যে লইয়া যাও।’ বিশোক তাঁহার আদেশ শ্রবণমাত্র অর্জ্জুনের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অশ্বগণকে সঞ্চালন করিতে আরম্ভ করিল। তখন পাঞ্চাল, সৃঞ্জয়, মৎস্য, চেদি, কারূষ, কোশল ও কেকয়গণ সেই ভ্রাতৃদ্বয়কে পরমযত্নসহকারে দ্রোণসৈন্যাভিমুখে ধাবমান দেখিয়া তাঁহাদিগের অনুগমন করিতে লাগিলেন।
“হে মহারাজ! ঐ সময় লোমহর্ষণ ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। মহাবীর, অর্জ্জুন দক্ষিণপার্শ্ব ও ভীমসেন উত্তরপার্শ্ব অবলম্বনপূর্ব্বক রথীগণের সহিত আপনার সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন। তদ্দর্শনে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকি যুদ্ধার্থ আপনার সৈন্যাভিমুখে ধাবমান হইলেন। প্রচণ্ড বায়ুর অভিঘাতে মহাসাগরের যেমন ঘোরতর শব্দ হইয়া থাকে, তদ্রূপ সেই পরস্পর প্রহারে প্রবৃত্ত সৈন্যগণের ভীষণ কোলাহল হইতে লাগিল। ঐ সময় মহাবীর অশ্বত্থামা সাত্যকিকে নিরীক্ষণপূর্ব্বক ভূরিশ্ররার বিনাশে জাতক্রোধ হইয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন, তদ্দর্শনে ভীমসেনতনয় মহাবীর ঘটোৎকচ লৌহনির্মিত, ঋক্ষচর্ম্মসমাচ্ছন্ন, ত্রিংশৎনল্ব [নলদ্বারা পরিমিত—চারিশত হন্তে ১ নল্ব মতান্তরে শত হস্ত। আধুনিক যুরোপ যুদ্ধে হাজার হাজার মাইলব্যাপী যুদ্ধক্ষেত্রে যে যান্ত্রিক অস্ত্রে যুদ্ধ হয় ঐরূপ যুদ্ধ মহাভারতের সময়ও হইত।] বিস্তীর্ণ, যন্ত্রসন্নাহযুত্ত [যান্ত্রিক যুদ্ধোপকরণসমন্বিত] অষ্টচক্ৰসমন্বিত মেঘগম্ভীরনিঃস্বন, অস্ত্রমালাসমলঙ্কৃত, শোণিতা ধ্বজপটপরিশোভিত, বিপুল ভয়ঙ্কর রথে আরোহণপূর্ব্বক শূল, মুগর, শেল ও পাদপধারী ভয়ঙ্কর রাক্ষসী সেনাগণসমভিব্যাহারে দ্রোণপুত্রের অভিমুখে গমন করিলেন। তাঁহার রথে অশ্ব বা মাতঙ্গগণ সংযোজিত ছিল না; করিনিকরাকার পিশাচগণ উহা আকর্ষণ করিতেছিল এবং বিকট গুরাজ পক্ষ ও চরণ বিস্তীর্ণ করিয়া চীৎকারপূর্ব্বক উহার উপরে সমুত্থিত ধ্বজদণ্ডে উপবিষ্ট রহিয়াছিল। মহীপালগণ তাঁহাকে যুগান্তকালীন দণ্ডপাণি অন্তকের ন্যায় শরাসন উদ্যত করিয়া আগমন করিতে দেখিয়া অতিশয় ব্যথিত হইলেন। আপনার সৈন্যগণ সেই গিরিশৃঙ্গসদৃশ, ভীমরূপ, ভয়াবহ, দংষ্ট্রাকরাল, বিকটমুখ, শঙ্কুকর্ণ [খোঁটার মত লম্বা কাণ], উৰ্দ্ধকেশ, সন্নতোদর [ক্ষুধিতের মত ঝোলা পেট], কিরীটালঙ্কৃতমস্তক; মহাগর্তের ন্যায় বিস্তীর্ণ গলদ্বারযুক্ত, প্রদীপ্তবক্ত্র, বিপক্ষগণের বিক্ষোভজনক, রাক্ষস ঘটোৎকচকে ব্যাদিতাস্য অন্তকের ন্যায় রোষভরে তথায় আগমন করিতে নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় ভীত ও বায়ুভরে ক্ষুভিত ভাগীরথীর ন্যায় বিচলিত হইল। মাতঙ্গগণ ঘটোৎকচের সিংহনাদশব্দে একান্ত ভীত হইয়া মূত্র পরিত্যাগ করিতে লাগিল।
‘অনন্তর রাক্ষসেরা রাত্রিকাল প্রভাবে অধিকতর বলশালী হইয়া সেই রণস্থলে চতুর্দ্দিকে শিলাবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিল। লৌহময় চক্র, ভূশুণ্ডী, তোমর, শক্তি, শূল, শতঘ্নী ও পট্টিশ প্রভৃতি অস্ত্রসকল চতুর্দ্দিকে অনবরত নিপতিত হইতে লাগিল। হে মহারাজ! সমস্ত নরপতি ও আপনার তনয়গণ এবং মহাবীর কর্ণ সেই ভীষণ সংগ্রামদর্শনে নিতান্ত কাতর হইয়া পলায়নে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ সময় কেবল অস্ত্রবলদীক্ষিত অশ্বত্থামা একাকী অনাকুলিতচিত্তে সংগ্রামস্থলে অবস্থানপূর্ব্বক সেই ঘটোৎকচবিস্তৃত মায়াজাল ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর ঘটোৎকচ তদ্দর্শনে অমর্ষপরবশ হইয়া তাঁহার উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গসমুদয় যেমন বল্মীকমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ সেই ঘটোৎকচনিক্ষিপ্ত শরসকল অশ্বত্থামার দেহ বিদারণপূর্ব্বক রুধিরলিপ্ত হইয়া ধরাতলে প্রবিষ্ট হইল। তখন প্রবল প্রতাপশালী লঘুহস্ত অশ্বত্থামা ক্রোধাবিষ্ট হইয়া দশশরে ভীমপুত্রকে বিদ্ধ করিলেন। ঘটোৎকচ অশ্বত্থামার শরে মর্ম্মনিপীড়িত হইয়া তাঁহার বিনাশবাসনায় তাঁহার উপর এক বালার্কসদৃশ, মণিহীরকবিভূষিত, এক লক্ষ অরসমাযুক্ত, ক্ষুরধার চক্র নিক্ষেপ করিলেন। সেই ঘটোৎকচনিক্ষিপ্ত চক্র মহাবেগে অশ্বত্থামার সমীপে সমাগত হইবামাত্র তিনি শরনিকরদ্বারা উহা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে সেই চক্র ভাগ্যহীনজনের বাসনার ন্যায় বিফল হইলে মহাবীর ভীমতনয়, রাহু যেমন ভাস্করকে আচ্ছন্ন করে, তদ্রূপ দ্রৌণিককে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিলেন।
অশ্বত্থামার শরে অঞ্জনপৰ্বার সংহার
“ঐ সময় ভিন্নাঞ্জনসন্নিভ [গাঢ়কজ্জলতুল্য কৃষ্ণবর্ণ] কলেবর ঘটোৎকচতনয় অঞ্জনপৰ্বা অশ্বত্থামাকে আগমন করিতে দেখিয়া সুমেরু যেমন বায়ুর গতিরোধ করে, তদ্রূপ তাঁহার গতিরোধপূর্ব্বক মেঘ যেমন সুমেরু পর্ব্বতের উপর বারিধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ তাঁহার উপর শরধারা বর্ষণ করিতে লাগিলেন। রুদ্র, উপেন্দ্র ও ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী অশ্বত্থামা তদ্দর্শনে অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া একবাণে অঞ্জনপৰ্ব্বার ধ্বজ, তিনবাণে চিত্রবেণুক, একবাণে ধনু, চারিবাণে চারি অশ্ব এবং দুইবাণে সারথিদ্বয়কে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর অঞ্জনপর্ব্বা এইরূপে রথবিহীন হইয়া অশ্বত্থামার উপর খড়্গপ্রহারে উদ্যত হইল। দ্রোণপুত্র তৎক্ষণাৎ সুতীক্ষ্ণ শরদ্বারা তাহার হস্ত হইতে সেই স্বর্ণবিন্দুখচিত অসিদণ্ড দ্বিখণ্ড করিলেন। তখন ঘটোৎকচনন্দন ক্রোধভরে গদা বিঘূর্ণনপুর্ব্বক অশ্বত্থামার প্রতি নিক্ষেপ করিল। মহাবীর দ্রোণাত্মজ তাহাও শরনিকরে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর অঞ্জনপর্ব্বা সহসা আকাশমার্গে সমুত্থিত হইয়া কালমেঘের ন্যায় গর্জ্জন করিয়া বৃক্ষবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিল। তখন দ্রোণপুত্র তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া দিবাকর যেমন স্বীয় করজালে মেঘমণ্ডল ভেদ করিয়া থাকে, তদ্রূপ শরজালে অঞ্জনপৰ্বার কলেবর ভেদ করিতে লাগিলেন। তখন ঘটোৎকচতনয় অন্তরীক্ষ হইতে অবতীর্ণ হইয়া সেই সুবর্ণখচিত রথে অবস্থানপূর্ব্বক পৃথিবীস্থিত অত্যুচ্চ অঞ্জনপর্ব্বতের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। অনন্তর মহাবীর অশ্বত্থামা ক্রুদ্ধচিত্তে মহেশ্বর যেমন অন্ধকাসুরকে বিনাশ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ সেই লৌহবর্ম্মধারী ভীমনপ্তা [ভীমপৌত্র] অঞ্জনপর্ব্বাকে শমনসদনে প্রেরণ করিলেন।
ঘটোৎকচসহ অশ্বত্থামার যুদ্ধ
“হে মহারাজ! মহাবীর ঘটোৎকচ স্বীয় পুত্রকে এইরূপে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া কোপজ্বলিতচিত্তে দবদহনপ্রবৃত্ত [বনদাহে উদ্যত] দাবানলসদৃশ পাণ্ডবসৈন্যসংহারকারী মহাবীর অশ্বত্থামার সমীপে আগমনপূর্ব্বক নির্ভীকচিত্তে কহিতে লাগিলেন, ‘হে দ্রোণনন্দন! তুমি ক্ষণকাল ঐ স্থানে অবস্থান কর। তুমি কদাচ আমার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবেনা। পার্ব্বতীনন্দন স্কন্দ যেমন ক্রৌঞ্চপর্ব্বত বিদীর্ণ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ অদ্য আমি তোমাকে বিদীর্ণ করিব।’ অশ্বত্থামা ঘটোৎকচের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাকে কহিলেন, ‘হে বৎস! তুমি এক্ষণে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া অন্যের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। পুত্রের সহিত যুদ্ধ করা পিতার কর্ত্তব্য নহে। হে হিড়িম্বানন্দন! তোমার প্রতি আমার কিছুমাত্র ক্রোধ নাই; কিন্তু মনুষ্য রোষপরবশ হইয়া আত্মনাশেও পরাঙ্মুখ হয় না। এই নিমিত্তই তোমাকে এ স্থান হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইতে কহিতেছি।’ তখন পুত্রশোকসন্তপ্ত মহাবীর ঘটোৎকচ রোষকষায়িতলোচনে অশ্বত্থামাকে কহিলেন, ‘হে দ্রোণাত্মজ! আমি নীচলোকের ন্যায় সংগ্রামকাতর নহি। তবে কেন নিরর্থক বাক্যব্যয় করিয়া আমাকে বিভীষিকা প্রদর্শন করিবার চেষ্টা করিতেছ? আমি এই সুবিস্তীর্ণ কৌরবকুলে মহাবীর ভীমের ঔরসে উৎপন্ন হইয়াছি। আমি সমরে অপরাঙ্মুখ পাণ্ডবগণের পুত্র, রাক্ষসগণের অধিরাজ ও দশাননের ন্যায় মহাবলপরাক্রান্ত। হে দ্রোণাত্মজ! তুমি ক্ষণকাল ঐ স্থানে অবস্থান কর। প্রাণসত্ত্বে তুমি কদাপি অন্যত্র গমন করিতে সমর্থ হইবে না। আজ আমি তোমার যুদ্ধাভিলাষ অপনীত করিব। মহাবীর ঘটোৎকচ এই বলিয়া কুঞ্জরাভিমুখীন কেশরীর ন্যায় ক্রোধভরে অশ্বত্থামার অভিমুখে ধাবমান হইলেন এবং জলধর যেমন জলধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ অশ্বত্থামার প্রতি রথপরিমিত আয়ত শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবল অশ্বত্থামা হিড়িম্বাতনয়বিসৃষ্ট সেই শরসমুদয় উপস্থিত না হইতে হইতেই অন্তরীক্ষে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তৎকালে বোধ হইল যেন, নভোমণ্ডলে শরজালের একটি স্বতন্ত্র যুদ্ধ হইতেছে। অস্ত্রসমুদয় সংঘর্ষণে স্ফুলিঙ্গ সকল সমুৎপন্ন হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, গগনতল খদ্যোতপুঞ্জে সুশোভিত হইয়াছে।
“এইরূপে দ্রোণপুত্ৰকর্ত্তৃক ঘটোৎকচের অস্ত্রমায়া প্রতিহত হইলে ভীমতনয় প্রচ্ছন্নভাবে পুনর্ব্বার মায়াজাল বিস্তার করিবার বাসনায় উত্তুঙ্গশৃঙ্গসম্পন্ন, পাদপকুলসমাচ্ছন্ন, শূল, প্রাস, অসি ও মুষলরূপ প্রস্রবণযুক্ত এক পর্ব্বতের আকার পরিগ্রহ করিলেন। মহাবাহু অশ্বত্থামা সেই অঞ্জনস্তূপসদৃশ মহীধর ও তাহা হইতে অনবরত নিপতিত অস্ত্রজাল নিরীক্ষণ করিয়া কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না। তখন তিনি হাস্যমুখে বজ্ৰাস্ত্র প্রয়োগ করিয়া সেই শৈলেন্দ্রকে চূর্ণ করিয়া ফেলিলেন।
“অনন্তর ঘটোৎকচ ইন্দ্রায়ুধবিভুষিত নীলনীরদরূপ ধারণ করিয়া পাষাণবর্ষণপূর্ব্বক অশ্বত্থামাকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা বায়ব্যাস্ত্র সন্ধানপূর্ব্বক সেই সমুত্থিত নীলমেঘ অপসারিত করিয়া শরনিকরে দিঙ্মণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিয়া লক্ষ রথীর প্রাণসংহার করিলেন।
“অনন্তর মহাবীর ঘটোৎকচ সিংহশাদূর্লসদৃশ মত্তদ্বিরদবিক্রম, বিকটাস্য, বিকৃতমস্তক, বিকৃতগ্রীব, নানাশস্ত্রধারী, কবচসমলঙ্কৃত, ভয়ঙ্কর, ক্রোধোদ্বৃত্তলোচন, দেবরাজসম মহাবলপরাক্রান্ত, সমরদুর্ম্মদ, রথারোহী, গজারোহী ও অশ্বারোহী রাক্ষসগণে পরিবৃত হইয়া পুনরায় অশ্বত্থামার অভিমুখে ধাবমান হইলেন। আপনার আত্মজ দুৰ্য্যোধন তদ্দর্শনে নিতান্ত বিষণ্ন হইলেন। তখন মহাবীর দ্রোণাত্মজ দুৰ্য্যোধনকে বিষণ্ন নিরীক্ষণ করিয়া সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে মহারাজ! তুমি ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক ভ্রাতৃগণ ও ইন্দ্ৰসমবিক্ৰম পার্থিবগণের সহিত এই স্থানেই অবস্থান কর। আমি সত্যপ্রতিজ্ঞা করিয়া কহিতেছি, তোমার শত্রুগণকে সংহার করিব। তুমি কখনই পরাজিত হইবে না। এক্ষণে যত্নসহকারে স্বীয় সৈন্যগণকে আশ্বাসিত কর।’ মহারাজ দুর্য্যোধন অশ্বত্থামার বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে দ্রোণনন্দন! তোমার মনের এইরূপ ঔদার্য্য ও আমাদের প্রতি এইরূপ গাঢ়তর ভক্তি হওয়া নিতান্ত অদ্ভুত নহে।’ রাজা দুর্য্যোধন অশ্বত্থামাকে এই কথা বলিয় শকুনিকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে সুবলনন্দন! অর্জ্জুন লক্ষ রথীকর্ত্তৃক পরিবৃত হইয়া সংগ্রাম করিতেছে; তুমি ষষ্টিসহস্র রথীসমভিব্যাহারে তাহার অভিমুখে গমন কর। কর্ণ, বৃষসেন, কৃপ, নীল, কৃতবর্ম্মা, দুঃশাসন, নিকুম্ভ, কুণ্ডভেদী, পুরুদ্রুম, পুরঞ্জয়, দৃঢ়রথ, পতাকী, হেমপুঞ্জক, শল্য, আরুণি, ইন্দ্রসেন, সঞ্জয়, বিজয়, জয়, কমলাক্ষ, পরক্ৰাথী, জয়ধর্ম্মা ও সুদর্শন এবং পুরুমিত্রের পুত্ৰসমুদয়, উদীচ্যগণ ও ছয় অযুত পদাতি তোমার অনুগমন করিবেন। হে মাতুল! দেবরাজ যেমন অসুরগণকে সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমি ভীম, নকুল, সহদেব ও যুধিষ্ঠিরকে বিনাশ কর। আমি এক্ষণে তোমার উপর জয়লাভ নির্ভর করিয়াছি। অতএব কার্ত্তিকেয় যেমন দানবদল দলন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তুমি অশ্বত্থামার শরনিকরে ক্ষতবিক্ষতকলেবর পাণ্ডবগণকে বিনাশ কর। হে মহারাজ! শকুনি দুর্য্যোধনের বাক্যশ্রবণানন্তর আপনার পুত্রগণের সন্তোষ ও পাণ্ডবদিগের বিনাশসম্পাদনার্থ দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিলেন।
ঘটোৎকচ-অশ্বত্থামার ভীষণ যুদ্ধ
“ঐ সময় ইন্দ্র ও প্রহ্লাদের ন্যায় অশ্বত্থামা ও ঘটোৎকচের তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইল। ঘটোৎকচ কুপিত হইয়া বিষাগ্নিসদৃশ সুদৃঢ় দশবাণ পরিত্যাগ করিয়া দ্রোণপুত্রের বক্ষঃস্থল আহত করিলেন। অশ্বত্থামা ভীমসুতের শরপ্রহারে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া পবনোদ্ধৃত পাদপের ন্যায় রথমধ্যে বিচলিত হইলেন। তখন ভীমতনয় পুনর্ব্বার অবিলম্বে অঞ্জলিকবাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক অশ্বত্থামার করস্থিত সুপ্রভাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। দ্রোণনন্দন তৎক্ষণাৎ সুদৃঢ় অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া, জলধর যেমন বারিধারা বর্ষণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ রাক্ষসের প্রতি সুবৰ্ণপুঙ্খ অরাতিনিপাতন শরজাল নিক্ষেপ করিলেন; বিশালবক্ষঃ রাক্ষসগণ দ্রোণপুত্রের বাণে নিপীড়িত হইয়া সিংহার্দ্দিত মত্তমাতঙ্গযূথের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। প্রলয়কালে ভগবান হুতাশন যেমন জীবগণকে দগ্ধ করিয়া থাকেন, তদ্রূপ মহাবীর অশ্বত্থামা হস্তী, অশ্ব, সারথি ও রথের সহিত রাক্ষসগণকে শরজালে দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। পূর্ব্বকালে দেবাদিদেব মহাদেব আকাশপথে ত্রিপুরাসুরকে দগ্ধ করিয়া যেরূপ দীপ্তি পাইয়াছিলেন, মহাবীর দ্রোণতনয় সেই অক্ষৌহিণী রাক্ষসসেনা ধ্বংস করিয়া সেইরূপ বিরাজিত হইতে লাগিলেন।
“তখন মহাবীর ঘটোৎকচ কোপাবিষ্ট হইয়া দ্রোণপুত্রকে বিনাশ করিতে আজ্ঞা প্রদানপূর্ব্বক অসংখ্য রাক্ষসসৈন্যকে প্রেরণ করিলেন। দশনোদ্দীপ্তবদন, নানাস্ত্রধারী, ঘোরতর নিশাচরগণ ঘটোৎকচের আজ্ঞাপ্রাপ্তিমাত্র মুখব্যাদানপূর্ব্বক সিংহনাদে বসুন্ধরা প্রতিধ্বনিত করিয়া দ্রোণপুত্রের সংহারার্থ ধাবমান হইয়া তাঁহার মস্তকে সহস্র সহস্র শাণিত শক্তি, শতঘ্নী, পরিঘ, অশনি, শুল, পট্টিশ, খড়্গ, গদা, ভিন্দিপাল, মুষল, অসি, তোমর, কুণপ, কম্পন, মূল, ভূশুণ্ডী, অশ্মগুড়, লৌহময় স্থান এবং শত্রুদারণ ঘোর মুদগরসকল নিক্ষেপ করিতে লাগিল। হে মহারাজ! আপনার পক্ষীয় যোদ্ধৃগণ ভীষণ অস্ত্রসমুদয় অশ্বত্থামার মস্তকোপরি নিপতিত হইতে দেখিয়া সাতিশয় ব্যথিত হইল; কিন্তু মহাবলপরাক্রান্ত দ্রোণতনয় অসম্ভ্রান্তচিত্তে শিলানিশিত বজ্রকল্প শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক অনায়াসে সেই ঘোরতর শরজাল নিবারণ করিয়া সত্বর দিব্যমন্ত্রপূত সুবর্ণপুঙ্খ শরনিকরে বিপুলবক্ষাঃ রাক্ষসগণকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। নিশাচরগণ অশ্বত্থামার ভীষণশরে সমাহত হইয়া সিংহবিদলিত গজযূথের ন্যায় একান্ত সমাকুল হইয়া ক্রোধভরে তাঁহার বিনাশবাসনায় ধাবমান হইল। তখন অস্ত্রবিদগণের অগ্রগণ্য মহাবীর অশ্বত্থামা অতি দুষ্কর আশ্চর্য্যজনক বিক্রম প্রদর্শনপূর্ব্বক একাকী ঘটোৎকচের সমক্ষে প্রজ্বলিত শরানলে সেই রাক্ষসী সেনা দগ্ধ করিয়া যুগান্তকালীন সংবৰ্ত্তক হুতাশনের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। ঐ সময় পাণ্ডবপক্ষীয় অসংখ্য নরপতিমধ্যে মহাবলপরাক্রান্ত ঘটোৎকচ ভিন্ন আর কেহই তাহাকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইলেন না।
“অনন্তর রাক্ষসেন্দ্র ভীমতনয় ক্রোধে নয়ন বিঘূর্ণন, করতালি প্রদান ও ওষ্ঠাধর দংশনপূর্ব্বক স্বীয় সারথিকে কহিলেন, “হে সারথে! তুমি সত্বর দ্রোণপুত্রসমীপে রথ সঞ্চালন কর। সারথি আজ্ঞাপ্রাপ্তিমাত্র অশ্বত্থামার সমীপে রথ সমানীত করিল, ভীমবিক্রম অরাতিঘাতন ঘটোৎকচ পুনরায় সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক জয়পতাকাসমাযুক্ত বিকটবেশধারী দ্রোণপুত্রের সহিত দ্বৈরথযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া তাঁহার প্রতি অষ্টঘন্টাযুক্ত দেবনির্মিত অশনি নিক্ষেপ করিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা কার্মুক পরিত্যাগ ও লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক সেই অশনি গ্রহণ করিয়া ঘটোৎকচের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। মহাপ্রভাবসম্পন্ন সেই ঘোররূপ অশনি রাক্ষসেন্দ্রের অশ্ব, সারথি ও ধ্বজ ছেদনপূর্ব্বক পৃথিবী বিদীর্ণ করিয়া ধরাতলে প্রবিষ্ট হইল। তদ্দর্শনে সকলেই দ্রোণপুত্রকে প্রশংসা করিতে লাগিল। অনন্তর ভীমপরাক্রম ভীমতনয় ধৃষ্টদ্যুম্নের রথে আরোহণপূর্ব্বক ইন্দ্রায়ুধসদৃশ অতি ভীষণ কার্মুক গ্রহণ করিয়া পুনরায় অশ্বত্থামার উপর নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নও নির্ভীকচিত্তে আচাৰ্য্যপুত্রের বক্ষঃস্থলে আশীবিষসদৃশ সুবর্ণপুঙ্খ শরসমুদয় নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা তাঁহাদের দুইজনের উপর অসংখ্য নারাচ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তাঁহারাও হুতাশনসদৃশ শরনিকরে তাহার নারাচসকল ছেদন করিয়া ফেলিলেন।
“হে মহারাজ! এইরূপে যোদ্ধৃগণের ও মহাবীর অশ্বত্থামার প্রীতিজনক অতি ভীষণ সংগ্রাম উপস্থিত হইল। ঐ সময়ে মহাবীর ভীমসেন সহস্র রথ, তিনশত হস্তী এবং ছয় সহস্র অশ্বে পরিবৃত হইয়া সেই স্থানে আগমন করিলেন। তখন বিক্রমশালী অশ্বত্থামা ঘটোৎকচ ও অনুজসহায় ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তৎকালে তিনি এরূপ অদ্ভুত পরাক্রম প্রদর্শন করিলেন যে, পৃথিবীমধ্যে আর কেহই সেরূপ পরাক্রমপ্রদর্শনে সমর্থ নহেন। তিনি নিমেষমাত্রে মহাবীর ভীমসেন, ঘটোৎকচ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল, সহদেব, ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির, বিজয় ও কেশবের সমক্ষে সেই অসংখ্য হস্তী, অশ্ব, সারথি ও রথসমবেত এক-অক্ষৌহিণী রাক্ষসীসেনা নিপাতিত করিলেন। দ্বিরদগণ অশ্বত্থামার অবক্ৰনারাচে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া শৃঙ্গবিহীন পর্ব্বতসমুদয়ের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। নিকৃত্ত করিশুণ্ডসকল সমরভূমিতে বিলুণ্ঠিত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন ভীষণ ভুজগগণ ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতেছে। কাঞ্চনময় দণ্ড ও শ্বেতচ্ছত্ৰসকল ছিন্ন ও নিপতিত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল যেন, আকাশমণ্ডল যুগান্তকালে চন্দ্র, সূৰ্য্য ও গ্রহমণ্ডলে সমাকীর্ণ হইয়াছে। ঐ সময় দ্রোণাত্মজের শরনিকরপ্রভাবে অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণ নিহত হওয়াতে সমরাঙ্গনে এক ভীষণ তরঙ্গযুক্ত ভীরুজনের মোহজনক শোণিতনদী প্রবাহিত হইল। বৃহদাকার ধ্বজসকল উহার ম
ণ্ডূক [ভেক ব্যাঙ।]; ভেরীসকল বৃহদাকার কচ্ছপ; শ্বেতচ্ছত্ৰসমুদয় হংসাবলী; চামর, ফেন, কঙ্ক ও গৃধ্রুসকল মহান; অসংখ্য আয়ুধ মৎস্য; বৃহদাকার হস্তিসমুদয় পাষাণ; অশ্বগণ মকর; রথসকল তীরভূমি; পতাকানিচয় তীরস্থ মনোহর বৃক্ষ, প্রাস, শক্তি ও ঋষ্টিসকল ডুণ্ডুভ [ঢোঁড়াসাপ]; মজ্জা ও মাংস পঙ্ক, কবন্ধগণ ভেলক [ভেলা] এবং কেশকলাপ শৈবালস্বরূপ দৃষ্ট ও যোদ্ধৃগণের আর্ত্তনাদ উহার শব্দস্বরূপে শ্রুত হইতে লাগিল।
অশ্বত্থামার শরে দ্রুপদপুত্র সুরথাদিবধ
“মহাবীর অশ্বত্থামা, এইরূপে রাক্ষসগণকে নিহত করিয়া ঘটোৎকচকে শরনিকরে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। তৎপরে তিনি পুনরায় সাতিশয় রোষাবিষ্ট হইয়া দ্রুপদ ও মহারথ পাণ্ডবগণকে শরজালে বিদ্ধ করিয়া দ্রুপদপুত্র সুরথকে সংহারপূর্ব্বক সুরথের অনুজ শত্রুঞ্জয়, বলানীক ও জয়কে বিনাশ করিয়া ফেলিলেন এবং সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক সুতীক্ষ্ণশরে পৃষধ্রু ও চন্দ্রসেনকে নিহত করিয়া দশশরে কুন্তিভোজের দশপুত্রকে ও সুপুঙ্খ সুশাণিত তিনশরে শ্রুতায়ুধকে শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। তৎপরে সেই মহাবীর ক্রোধাবিষ্ট হইয়া শরাসন আকর্ণ আকর্ষণপূর্ব্বক ঘটোৎকচকে লক্ষ্য করিয়া এক যমদণ্ডোপম ভয়ঙ্কর শর পরিত্যাগ করিলেন। সেই শর পরিত্যক্ত হইবামাত্র ঘটোৎকচের হৃদয় ভেদপূর্ব্বক ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইল। তখন মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন ঘটোৎকচকে নিহত ও নিপতিত বোধ করিয়া অশ্বত্থামার নিকট হইতে পলায়ন করিলেন; তদ্দর্শনে পাণ্ডবসৈন্যগণও সমরে পরাঙ্মুখ হইতে লাগিল। এইরূপে মহারীর অশ্বত্থামা শত্রুগণকে পরাজিত করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন সমরভূমি শরনিকরে ভিন্নকলেবর, নিহত ও নিপতিত গিরিশৃঙ্গসদৃশ রাক্ষসগণে সমাচ্ছন্ন হওয়াতে নিতান্ত দুর্গম ও ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিল। হে মহারাজ! তখন আপনার পুত্রগণ ও অন্যান্য বীরগণ এবং সিদ্ধ, গন্ধর্ব্ব, পিশাচ, নাগ, সুপর্ণ, পিতৃলোক, পক্ষী, রাক্ষস, ভূত, অপ্সরা ও দেবতাগণ অশ্বত্থামার প্রশংসা করিতে লাগিলেন।”