১৫৬তম অধ্যায়
পাণ্ডবসাহায্যাৰ্থ সসৈন্য রুক্মীর আগমন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! এই অবসরে ইন্দ্রের প্রিয়সখা দক্ষিণাত্যপতি অতি যশস্বী ভোজরাজ হিরণ্যরোমা [স্বর্ণবর্ণরোমযুক্ত] ভীষ্মকের সত্যসঙ্কল্প [সংকল্পের সত্যতা, রক্ষক] ভুবনবিখ্যাত পুত্র রুক্মী গন্ধমাদনবাসী কিম্পপুরুষদিগের মধ্যে প্রধান এক ব্যক্তির শিষ্য হইয়া চতুষ্পদ ধনুৰ্বেদ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। তিনি গাণ্ডীব, বিজয় ও শার্ঙ্গ, এ তিন দিব্যশরাসনের মধ্যে গাণ্ডীব ও শার্ঙ্গ ধনুর তুল্য তেজস্বী দিব্যলক্ষণসম্পন্ন বিজয়নামক মাহেন্দ্ৰধনু লাভ করিয়াছিলেন। স্বৰ্গবাসিগণমধ্যে বরুণের গাণ্ডীব, মহেন্দ্রের বিজয় ও বিষ্ণুর শার্ঙ্গ—এই তিন ধনুই দিব্য ও অতি তেজস্বী বলিয়া বিখ্যাত। ভগবান বাসুদেব অন্ত্রময় [নাড়ীনির্মিত] পাশ সংছেদন করিয়া স্ববীৰ্য্যপ্রভাবে মুরনামক এক অসুরকে বিনাশ, ভৌম, নরককে পরাজয় এবং মণিকুণ্ডল হরণ করিয়া ষোড়শসহস্ৰ মহিলা, বিবিধ রত্ন ও বিপক্ষের ভয়াবহ তেজোময় উত্তম শার্ঙ্গ-নামে শরাসন প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন। আর মহাবীর অর্জ্জুন খাণ্ডবদাহে ভগবান হুতাশন হইতে গাণ্ডীব লাভ করেন। রুক্মী জলধরনির্ঘোষের [বজ্রধ্বনির] ন্যায় গভীরধ্বনিসম্পন্ন সেই মাহেন্দ্ৰধনু লাভ করেন। প্রভূতবলবীৰ্য্যশালী ভোজপতি রুক্মী বহু গজবাজি-পরিবৃত হইয়া সমস্ত জগৎ বিত্ৰাসিত করিয়া পাণ্ডবগণের নিকট আগমন করিলেন। বাহুবলগর্ব্বিত রুক্মী পূর্ব্বে ধীমান বাসুদেবের রুক্মিণীহরণ সহ্য করিতে না পারিয়া, আমি কৃষ্ণকে বিনষ্ট না করিয়া কদাচ প্রতিনিবৃত্ত হইব না’, এইরূপ প্রতিজ্ঞাপূর্ব্বক প্রবৃদ্ধ [বেগে পরিবর্দ্ধিত] ভাগীরথীর ন্যায় বেগবতী বিচিত্র আয়ুধধারিণী চতুরঙ্গিণী সেনাসমভিব্যাহারে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইয়াছিলেন। পরে তাঁহার সন্নিহিত হইবামাত্র পরাজিত ও লজ্জিত হইয়া প্ৰতিগমন করিলেন। কিন্তু যেস্থানে বাসুদেবকর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন, তথায় ভোজকটকনামক প্রভূত সৈন্য ও গজবাজি সম্পন্ন সুবিখ্যাত এক নগর সংস্থাপন করিয়াছিলেন। এক্ষণে সেই নগর হইতে ভোজরাজ রুক্সী এক-অক্ষৌহিণী সেনাসমভিব্যাহারে সত্বর পাণ্ডবগণের নিকট আগমন করিয়া তাঁহাদের জ্ঞাতসারে কৃষ্ণের প্রিয়ানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত কবচ, ধনু, তরবার, খড়্গ ও শরাসন ধারণ করিয়া আদিত্যসঙ্কাশ [সূৰ্য্যতুল্য প্রভাবশালী] ধ্বজের সহিত পাণ্ডবসৈন্যমণ্ডলমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন।
কুরুপাণ্ডবপ্রত্যাখ্যাত রুক্মীর প্রস্থান
অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁহার প্রত্যুদগমন ও যথোচিত সৎকার করিলেন! ভোজরাজ রুক্মী পূজিত ও অভিসংস্তুত [সম্মানিত] হইয়া তাঁহাদিগকে অভিনন্দনপূর্ব্বক কিয়ৎক্ষণ সসৈন্যে বিশ্রামসুখ অনুভব করিয়া বীরগণমধ্যে ধনঞ্জয়কে কহিতে লাগিলেন, “হে অর্জ্জুন! তুমি এইরূপ সহায়সম্পন্ন হইয়া যুদ্ধ করিতে ভীত হইও না; আমি অসহ্য বিষয়ও সহ্য করিব; আমার তুল্য বলবিক্রমশালী পুরুষ আর নাই। তুমি শত্রুসৈন্যের যে অংশ নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিবে, আমি অনায়াসেই তাহা সংহার করিব। এক্ষণে মহাবীর দ্রোণ, কৃপ, ভীষ্ম, কর্ণ এবং সমাগত ভূপালগণ স্বচ্ছন্দে অবস্থান করুন। আমি একাকী যুদ্ধে শক্রগণকে বিনাশ করিয়া তোমাকে পৃথিবী প্ৰদান করিব।”
অনন্তর মহাবলপরাক্রান্ত অর্জ্জুন রুক্মীকর্ত্তৃক পার্থিবগণসমক্ষে এইরূপ অভিহিত হইয়া ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠির ও কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক সখ্যভাব প্রকাশ করিয়া সহাস্যমুখে রুক্মীকে কহিতে লাগিলেন, “হে ভোজরাজ! আমি কৌরব বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছি; মহারাজ পাণ্ডুর পুত্র, দ্রোণাচাৰ্য্যের শিষ্য, বাসুদেব আমার সহায়তা করিয়া থাকেন ও গাণ্ডীব আমার শরাসন; সুতরাং এক্ষণে যুদ্ধে ভীত হইতেছি, এই কথা কিরূপে বলি? হে বীর! যখন আমি ঘোষযাত্রাকালে মহাবল গন্ধর্ব্বের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলাম, তখন কে আমার সহায় ও সখা হইয়াছিল? যখন আমি দেবদানবসঙ্কুল ভয়ঙ্কর খাণ্ডবারণ্যে যুদ্ধ করিয়াছিলাম, তখন কে আমার সহায় হইয়াছিল? যখন আমি নিবাতকবচ ও কালকেয় দানবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলাম, তখন কে আমার সহায় হইয়াছিল? যখন আমি বিরাটনগরে কৌরবগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলাম, তখনই বা কে আমার সহায় হইয়াছিল? কোন ব্যক্তি যুদ্ধার্থে রুদ্র, শক্র, কুবের, যম, বরুণ, পাবক, কৃপ, দ্রোণ ও মাধবের আরাধনা করিয়া, তেজোময় সুদৃঢ় দিব্যগাণ্ডীবধারণ, অক্ষয় শর ও দিব্যাস্ত্র পরিগ্রহ করিয়া ‘ভীত হইতেছি’ এই অযশস্কর কথা কহিতে সমর্থ হয়? হে মহাবাহো! আমার সহায়সম্পত্তি কিছুই নাই, তথাপি আমি ভীত নাহি। এক্ষণে তুমি যথেচ্ছ গমন বা এইস্থানেই অবস্থান কর, তদ্বিষয়ে আমার কোনো আপত্তি নাই।”
অনন্তর রুক্মী সাগরসন্নিভ সেনাসকল প্রতিনিবৃত্ত করিয়া রাজা দুৰ্য্যোধনসন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন এবং তাঁহার নিকট পূর্ব্ববৎ এই কথা উল্লেখ করিলে বীরাভিমানী দুৰ্য্যোধন তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ দেবের ন্যায় সমরপরাঙ্মুখ হইয়া তীৰ্থপর্য্যটনাৰ্থ বিনির্গত হইলেন। এদিকে পাণ্ডবেরা মন্ত্রণানিমিত্ত পুনরায় উপবেশন করিলেন। তখন পার্থিবগণসমাকুল সেই পাণ্ডবসভা তারকানিকর [নক্ষত্ররাজি]-সুশোভিত চন্দ্ৰমণ্ডিত নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল।