১৫৫তম অধ্যায়
উপদ্রবদর্শনে উৎকণ্ঠিত পাণ্ডবগণের ভীমান্বেষণ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর ভীমসেন সেই মহামূল্য অনেকরূপ বহুসংখ্যক সৌগন্ধিক-কুসুম সংগ্ৰহ করিলেন। এদিকে বদরিকাশ্রমে সংগ্রামসূচক খরস্পর্শ সমীরণ আবির্ভূত হইয়া বালুকা-বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল; ভয়ঙ্কর সনির্ঘাত উল্কা মহীতলে পতিত হইতে লাগিল; সূৰ্য্যদেব তিমিরে আচ্ছন্ন ও প্রভাশূন্য হইলেন; মৃগ-পক্ষীরা কর্কশরব করিতে লাগিল; ভূমিকম্প, পাংশুবৃষ্টি, দিকসকল লোহিতবর্ণ, সমুদয় জগৎ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইল, আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। ইহা ভিন্ন অন্যবিধ উৎপাতও উৎপন্ন হইতে লাগিল।
রাজা যুধিষ্ঠির এইসকল অলক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “হে যুদ্ধদুর্ম্মদ পাণ্ডবগণ! সকলে সুসজ্জিত হও; বোধ হয়, কেহ। আমাদিগকে পরাভব করিতে আসিতেছে।” তিনি এই কথা কহিয়া চারিপার্শ্বে দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক ভীমসেনকে দর্শন না করিয়া কহিলেন, “হে পাঞ্চালি! ভীমসেন কোথায়? কি কাৰ্য্যে ব্যাপৃত আছেন? এই সমরসূচক আকস্মিক উৎপাত চতুর্দ্দিকে প্রাদুর্ভূত হইয়াছে দেখিয়া সেই সাহসপ্রিয় ভীমসেন কি সাহস প্রকাশ করিয়াছেন!
প্রিয়কারিণী প্রিয়তমা দ্রৌপদী কহিলেন, “রাজন! তিনি বায়ুবেগে আনীত একটি সৌগন্ধি-পুষ্পপ্রাপ্ত হইয়া আমাকে প্রদান করিয়াছিলেন। আমি সেই কুসুমটি গ্রহণ করিয়া কহিলাম, “যদি আপনি এই পুষ্প অধিক অবলোকন করিয়া থাকেন, তাহা হইলে শীঘ্ৰ সেই সমুদয় পুষ্প আনয়ন করুন।” বোধ হয়, সেই মহাবাহু আমার প্রতি স্নেহপরতন্ত্র হইয়া অপরূপ পুষ্প আহরণের নিমিত্ত এ স্থান হইতে পূর্বোত্তরদিকে গমন করিয়াছেন।”
রাজা যুধিষ্ঠির দ্ৰৌপদীর বাক্য শ্রবণ করিয়া নকুল ও সহদেবকে কহিলেন, “চল, আমরাও তাহার অনুবতী হই। নিশাচরগণ নিতান্ত কৃশ ও পরিশ্রান্ত বিপ্রগণকে বহন করুন। হে অমরসঙ্কাশ ঘটোৎকচ! তুমি কৃষ্ণাকে বহন কর। ভীমসেন বায়ু ও বৈনতেয়সমান তরস্বী, তিনি আকাশে উৎপতিত হইতে ও যথেচ্ছ ভ্ৰমণ করিতে সমর্থ তথাপি যখন এতাদৃশ বিলম্ব হইতেছে, তখন স্পষ্ট বোধ হয়, তিনি অতি দূরতর প্রদেশে প্রবিষ্ট হইয়াছেন। তিনি ব্ৰহ্মবাদী সিদ্ধগণের নিকট অপরাধী না হয়েন, এইজন্যই আমি তোমাদিগের প্রভাবে অগ্ৰে তাঁহার সহিত মিলিত হইব।”
ঘটোৎকচ প্রভৃতি নিশাচরগণ কুবেরের সরসীস্থান অবগত ছিল; তন্নিমিত্ত ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া পাণ্ডব ও বিপ্ৰগণ প্রভৃতি সকলকে গ্রহণপূর্ব্বক প্রীতিপ্ৰফুল্লমানসে দ্রুত পদে গমন করিয়া শুভকামনা সৌগন্ধিকবতী সরসী সমীপে সমুপস্থিত হইল।
মহাত্মা ভীমসেন তৎকালে সেই সরসীতীরে যুগান্তকালীন দণ্ডহস্ত অন্তকের ন্যায় ভুজদণ্ডে প্রচণ্ড গদা গ্রহণপূর্ব্বক ক্ৰোধস্তব্ধনেত্ৰে স্বীয় অধরাপত্ৰ [অধরপ্রান্ত] দংশনপূর্ব্বক দণ্ডায়মান আছেন, বহুসংখ্যক যক্ষ নিহত হইয়া ধরাতলে নিপতিত রহিয়াছে। তাহাদিগের মধ্যে কাহারও শরীর ভিন্ন, কাহারও বাহুদ্বয় ছিন্ন, কাহারও চক্ষু বিদীর্ণ এবং কাহারও বা শিরোধর [গ্ৰীবা—গলা] বিচূৰ্ণিত হইয়াছে। রাজা যুধিষ্ঠির এই সকল অবলোকন করিয়া ভীমসেনকে পুনঃ পুনঃ আলিঙ্গনপূর্ব্বক মধুরবাক্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে ভ্ৰাতঃ! তোমার কি সাহস! এ কি করিয়াছ! তুমি কি দেবগণের অপ্ৰিয়াচরণ করিলে? যাহা হউক, যদ্যপি আমার প্রিয়কারী হও, পুনরায় আর এরূপ কর্ম্ম করিও না।”
রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুশাসনবাক্য পরিসমাপ্ত হইলে অমরোপম পাণ্ডবগণ সেই সকল কমল গ্রহণপূর্ব্বক সেই সরোবরতীরে বিহার করিতে লাগিলেন, এমন সময়ে উদ্যানরক্ষক রাক্ষসগণ আবির্ভূত হইয়া ধর্ম্মরাজ, মহর্ষি লোমশ, নকুল, সহদেব ও অপরাপর ব্রাহ্মণগণকে অবলোকনমাত্র বিনয়াবনত হইয়া প্ৰণিপাত করিল। তখন রাজা ধর্ম্মরাজ তাহাদিগকে সান্ত্বনা করিলে তাহারাও প্রসন্নচিত্ত হইল। অনন্তর কুরুধুরন্ধরগণ কুবেরের অনুজ্ঞানুসারে গন্ধমাদনসানুতে ধনঞ্জয়ের প্রতীক্ষায় কিয়দ্দিন অতিবাহিত করিলেন।