১৫২. হিড়িম্ববধ পর্বাধ্যায়, পাণ্ডবসমীপে হিড়িম্বার আগমন
দ্বিপঞ্চাশধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! ঐ বনের অনতিদূরবর্তী বিশাল এক শালবৃক্ষ ছিল। তদুপরি মহাবল পরাক্রান্ত নরমাংসাশী হিড়িম্বনাম রাক্ষস বাস করিত। ঐ দুরাত্মা অত্যন্ত ক্রুর ও জলদকালের জলধরের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ ছিল। উহার শরীর সুদৃঢ়, চক্ষুদ্বয় পিঙ্গলবর্ণ, মুখ অতি ভীষণ, দন্তজাল বিশাল, জঙ্ঘামূল ও জঠর লম্বমান, শ্মশ্রু ও শিরোরুহ তাম্রবর্ণ, স্কন্ধ প্রকাণ্ড বৃক্ষকাণ্ড সদৃশ ও কর্ণদ্বয় রাসভ-শ্রবণোপিম ছিল। রাক্ষস বৃক্ষে বসিয়া মাতৃসমবেত পাণ্ডবদিগকে নিদ্রিত দেখিতে পাইল। দুরাত্মা বহুদিবসাবধি মনুষ্যশোণিত পান করে নাই, বিশেষতঃ তৎকালে সাতিশয় ক্ষুধার্ত হইয়াছিল; মনুষ্যগন্ধ আঘ্রাণেও পাণ্ডবদিগের দর্শনে যৎপরোনান্তি পরিতুষ্ট হইল; পরে ঊদ্ধাঙ্গুলিদ্বারা শিরঃকণ্ডুতি করিতে করিতে মুখব্যাদনপূর্বক জৃম্ভনচ্ছলে বারংবার তাহাদিগকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। হিড়িম্ব পাণ্ডবগণের মাংস ভক্ষণ ও রুধির পান করিবার নিমিত্ত সাতিশয় ব্যগ্র হইয়া স্বীয় ভগিনী হিড়িস্বাকে আহ্বান করিয়া কহিল, ঐ দেখ, বহুদিনের পর আমার পরম ভক্ষ্যসকল স্বয়ং সমুপস্থিত হইয়াছে, উহাদিগের দর্শনে আমার জিহ্বা হইতে জল নিঃসৃত ও মুখ বিচলিত হইতেছে। অদ্য আমি বহুদিনের পর সুকোমলমাংসযুক্ত মনুষ্যদেহে সুতীক্ষ্ণ বিশাল দশন নিমগ্ন করিব, মনুষ্যকণ্ঠ আক্রমণ ও ধমনীচ্ছেদনপূর্বক অভিনব কবোষ্ণ ফেনিল রুধির পান করিয়া চরিতার্থ হইব। তুমি শাস্ত্র গিয়া জান, উহারা কে? উহাদের গন্ধ আম্রাণ করিয়া আমার পরম পরিতোষ হইতেছে। শীঘ্র বাও, উহাদের সকলকে বধ করিয়া আমার নিকট আনয়ন কর। উহারা আমার অধিকারে নিদ্রিত রহিয়াছে, ভয় করিও না। যাও, ত্বরায় উহাদিগকে মারিয়া আন। আমরা দুইজনে একত্র হইয়া নরমাংস ভক্ষণে উদর পূর্ণ ও পরম পরিতোষে তাল প্রদান পূর্বক নৃত্য করিব।
হিড়িম্বা রাক্ষসী ভ্রাতৃবাক্য শ্রবণ করিয়া সত্বরে পাণ্ডবগণের সমীপে উপস্থিত হইয়া দেখিল, মাতৃসমবেত পাণ্ডবচতুষ্টয় নিদ্রিত আছেন, কেবল একাকী ভীমসেন জাগরিত হইয়া প্রহরীর কাৰ্য্য করিতেছেন। রাক্ষসী বিশাল শালবৃক্ষ সদৃশ মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেনের অলোকসামান্য রূপলাবণ্য দর্শনে সাতিশয় কামার্ত হইয়া মনে মনে স্থির করিল যে, এই মহাবাহু সিংহস্কন্ধ, কমুগ্ৰাব, কমলনয়ন, সুরূপ, যুবা পুরুষকে আমি পতিত্বে বরণ করিব। আমি কখনই ভ্রাতার ক্রুর বাক্যানুসারে কাৰ্য্য করিব না। পতিস্নেহ সোদরহে অপেক্ষ। বলবান্; বিশেষতঃ আমি ইহাদিগকে বধ করিয়া ভ্রাতৃসন্নিধানে উপস্থিত করিলে মাংসভক্ষণ ও রুধির পানদ্বারা আমার ক্ষণকাল মাত্র তৃপ্তি হইবে, কিন্তু যদি তাহা না করিয়া এই যুবা পুরুষকে পতিত্বে বরণ করি, তাহা হইলে আমি চিরকাল পরম সুখভোগে কালহরণ করিতে পারি। কামরূপিণী হিড়িম্বা মনে মনে এইরূপ সংকল্প করিয়া মুহূৰ্ত্ত মধ্যে দিব্যাভরণ-ভূষিতা ষোড়শবর্ষদেশীয় কামিনীর বেশধারণপূর্বক মৃদুমন্দগমনে ভীমসেনের সমিধানে উপস্থিত হইল এবং লজ্জাবনতসহাস্যবদনে, গদগদরে উঁহাকে কহিতে লাগিল, হে পুরুষশ্রেষ্ঠ! তুমি কে? কোথা হইতে আসিয়াছ? এই যে দেবরূপী পুরুষগণ ধরাতলে শয়ান রহিয়াছেন, ইহারা তোমার কে? আর এই যে তপ্তকাঞ্চনসন্নিভ রূপশালিনী সুকুমারী আপনার গৃহের ন্যায় এই নির্জন বনে বিশ্বস্তচিত্তে নিদ্রা যাইতেছেন, ইনিই বা তোমার কে? শুনিতে ইচ্ছা করি; তোমরা কি জান না যে, এই গহনবন রাক্ষসগণের আবাস স্থান? ইহাতে হিড়িম্বনামে এক পাপাত্মা রাক্ষস বাস করে। সেই দুরাত্মা আমার ভ্রাতা; সে তোমাদিগের মাংস ভক্ষণে ও রুধিরপানে লোলুপ হইয়া তোমাদিগের বধসাধনাৰ্থ আমাকে পাঠাইয়াছে। যাহা হউক, আমি তোমার রূপলাবণ্য দর্শনে মোহিত হইয়া তোমাকে পতিত্বে বরণ করিতে ইচ্ছা করি, হে ধর্মাত্মন্! এক্ষণে যাহা-তোমার উচিত হয়, কর। আমি কামাতুর হইয়া স্বয়ং তোমাকে বরণ করিবার প্রার্থনা করিতেছি; হে মহাত্মন্! বিবাহ করিয়া আমার মনোরথ সফল কর। হে মহাবাহে! আমি স্বীকার করিতেছি, দুরন্ত রাক্ষসভয় হইতে তোমাকে পরিত্রাণ করিব। আমি কি জল, কি হল, কি অম্বরতল সর্বত্র ভ্রমণ করিতে পারি, তোমাকে লইয়া গিরিদুর্গমধ্যে বাস করিব; তুমি আমার সহিত একত্ৰ থাকিলে পরমাহলাদে কালযাপন করিতে পারিবে; অতএব, অনুগ্ৰহ করিয়া অধিনীর মনোবাঞ্ছা পরিপূর্ণ কর।
মহাত্মা ভীমসেন হিড়িম্বার বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাকে কহিলেন, হে রাক্ষসি! আমি তোমার কথায় কিরূপে এই গহন কানন মধ্যে মাতা, জ্যেষ্ঠ সহোদর ও অনুজগাকে পরিত্যাগ করিয়া গমন করি। মদ্বিধ লোক কি কামার্ত হইয়া এই সমস্ত সুখসুপ্ত ভ্রাতৃসমবেত ভ্রাতৃগণকে রাক্ষসমুখে প্রদান করিয়া স্বচ্ছন্দে গমন করিতে পারে? হিড়িম্বা কহিল, হে ধর্মাত্মন। তোমার হাতে প্রীতি জন্মে, আমি তদনুষ্ঠানে কখনই পরখ হইব না। তুমি ইহাদিগকে জাগরিত কর; আমি সকলকেই নরমাংসাদ রাক্ষসের হস্ত হইতে পরিত্রাণ করিব। ভীমসেন কহিলেন, হে রাক্ষসি! আমি তোমার দুরাত্মা ভ্রাতার ভয়ে সুখসুপ্ত জননী ও ভ্রাতৃগণকে কখনই প্রবোধিত করিতে পারিব না। হে ভীরু! কি রাক্ষস, কি মানব, কি গন্ধর্ব কেহই আমার পরাক্রম সহ্য করিতে সমর্থ নহে, আমি কাহাকেও ভয় করি না; অতএব তুমি এই স্থানেই থাক বা এখান হইতে গমন করিয়া তোমার ভ্রাতাকে পাঠাইয়া দাও; যাহা ইচ্ছা হয় কর, আমি সকল বিষয়েই সম্মত আছি, কিছুতেই কিছুমাত্র ক্ষতিবোধ করি না।