১৫২তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরের যুদ্ধে অনুমতি
হে, মহারাজ! ধৰ্মরাজ! যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের বাক্য অনুধ্যান [অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা] করিয়া পুনরায় কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! মন্দবুদ্ধি দুৰ্য্যোধন এ কথা কিরূপে কহিল আর এক্ষণে আমাদিগের কর্ত্তব্যই বা কি এবং কিরূপ অনুষ্ঠান করিলেই বা আমরা ধৰ্মরক্ষা করিতে সমর্থ হই? তুমি দুৰ্য্যোধন, কৰ্ণ, শকুনি, সৌবল ও আমার ভ্রাতৃগণের এবং আমার অভিপ্ৰায় সম্যক বিদিত হইয়াছ, মহাবীর বিদুর ও ভীষ্মের বাক্য কর্ণগোচর করিয়াছ এবং আৰ্য্যা কুন্তীর অভিলাষও সম্যক অবগত হইয়াছ; এক্ষণে এইসমস্ত বিষয় বারংবার বিবেচনা ও ইহা ভিন্ন অন্য উৎকৃষ্ট বিষয়ও উদ্ভাবন করিয়া যাহাতে আমাদিগের শ্রেয়োলাভ হয়, অবিলম্বে এইরূপ উপদেশ প্রদান কর।”
বাসুদেব অতি গভীরস্বরে কহিলেন, “হে ধৰ্মরাজ! আপনি যে ধর্ম্মার্থসঙ্গত হিতজনক বাক্য প্রয়োগ করিলেন, দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন তাহার অনুসরণে অভিলাষী নহে। সে মহাত্মা ভীষ্ম ও বিদুরের এবং আমার কথায় কদাচ কৰ্ণপাত করে না; সে সকলকেই অতিক্রম করিয়াছে। তাহার ধর্ম্মভয় নাই ও যশোলাভের অভিলাষ নাই। সে একমাত্র কর্ণকে আশ্রয় করিয়া সকলকেই পরাজিত করিয়াছি বিবেচনা করিয়া থাকে। সেই পাপাত্মা আমাকে বন্ধন করিতে আদেশ করিয়াছিল; কিন্তু তাহার সে অভিলাষ পূর্ণ হয় নাই। তৎকালে ভীষ্ম এবং দ্রোণ ইহারাও যুক্তিযুক্ত কথা কহেন নাই। বিদুর ব্যতিরেকে আর সকলেই তাহার মতানুসারী হইয়াছিল। শকুনি, সৌবল, কর্ণ ও দুঃশাসন আপনার প্রতি একান্ত অযুক্ত [অবক্তব্য] ও নিতান্ত দুঃসহ বাক্য প্রয়োগ করিয়াছে। দুৰ্য্যোধন আপনাকে যেরূপ কহিয়াছে, তাহার উল্লেখ করিবার আর প্রয়োজন নাই; ফলতঃ সে আপনার সহিত উপযুক্ত ব্যবহার করিতেছে না। এই সমস্ত পার্থিব এবং সৈনিকগণের মধ্যে যে পাপ ও অকল্যাণ নাই, একমাত্র দুৰ্য্যোধনে তাহা বিদ্যমান আছে। এক্ষণে আমরা সমর পরিত্যাগ করিয়া রাজ্যে উপেক্ষা প্রদর্শনপূর্ব্বক কদাচ কৌরবগণের সহিত সন্ধি করিব না।”
অনন্তর ভূপালগণ কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণে বাঙনিষ্পত্তি [বাক্যপ্রয়োগ] না। করিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরের মুখাবলোকন করিতে লাগিলেন। তখন ধৰ্মরাজ পাণ্ডুতনয় ভ্রাতৃচতুষ্টয়ের সহিত মিলিত ও তাঁহাদের অভিপ্রায় সম্যক অবগত হইয়া সমরের উদ্যোগ করিতে অনুমতি প্রদান করিলেন। আদেশপ্ৰাপ্ত হইবামাত্র সেনাগণের মধ্যে এক মহৎ হর্ষধ্বনি সমুত্থিত হইল; তাহাদিগের আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না। ধর্ম্মরাজ অবধ্য জ্ঞাতিবর্গের বন্ধসাধন করিতে হইবে বিবেচনা করিয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক ভীমসেন ও অর্জ্জুনকে কহিলেন, “হে ভ্রাতৃগণ! আমরা যাহা পরিহার করিবার নিমিত্ত অরণ্যবাসপ্রভৃতি বহুবিধ ক্লেশপরম্পরা স্বীকার করিলাম সেই কুলক্ষয় রূপ অনর্থ আজি অনিবাৰ্য্যরূপে সমুপস্থিত হইতেছে। আমরা এই অনিষ্ট নিবারণ করিবার নিমিত্ত যে যত্ন করিয়াছি, তাহা সম্পূর্ণরূপে নিস্ফল হইল। যুদ্ধের উদ্যোগ করি নাই, তথাপি ঘোরতর সংগ্রাম ঘটিয়া উঠিল, আমরা অবধ্য আৰ্য্যগণের সহিত কিরূপে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব এবং কিপ্রকারেই বা বয়োবৃদ্ধ গুরুলোকদিগকে সংহার করিয়া বিজয় লাভ করিব?”
অনন্তর অর্জ্জুন পুনরায় ধর্ম্মরাজকে বাসুদেবের কথা শ্রবণ করাইয়া কহিলেন, “মহারাজ! আপনি মহামতি কৃষ্ণের মুখে আৰ্য্যা কুন্তী ও বিদুরের যেসমস্ত কথা শ্রবণ করিলেন, তাহা সম্যক অবধারণ করিয়াছেন। আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, তাঁহারা ধর্ম্মানুগত কথাই কহিয়াছেন; সুতরাং এক্ষণে সমরে পরাঙ্মুখ হওয়া আপনার নিতান্ত অন্যায়।” তখন বাসুদেব স্মিতমুখে [ঈষৎ হাস্যবদনে] অর্জ্জুনের বাক্য অনুমোদন করিলেন। অনন্তর পাণ্ডবগণ সৈন্যমণ্ডলীসমভিব্যাহারে যুদ্ধার্থ কৃতনিশ্চয় হইয়া পরমসুখে রজনী অতিবাহিত করিলেন।