১৫২তম অধ্যায়
দুর্য্যোধনের দ্রোণনিন্দা—পুনঃ যুদ্ধার্থ উদ্বোধন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! দ্রোণাচাৰ্য্য এইরূপ কহিলে আপনার পুত্র দুর্য্যোধন রোষাবিষ্টচিত্তে যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইয়া কর্ণকে কহিতে লাগিলেন, “হে রাধেয়! দেখ, একাকী অর্জ্জুন একমাত্র কৃষ্ণকে সহায় করিয়া তোমার, দ্রোণাচার্য্যের এবং অন্যান্য প্রধানতম যোদ্ধৃগণের সমক্ষেই দেবগণেরও দুর্ভেদ্য সেই আচার্য্যবিরচিত ব্যূহ ভেদ করিয়া সিন্ধুরাজকে নিহত করিল। সিংহ যেমন অন্যান্য মৃগসমুদয় বিনষ্ট করে, তদ্রূপ অর্জ্জুন তোমার ও দ্রোণাচার্য্যের সমক্ষেই প্রধান প্রধান নরপতিগণকে সংগ্রামে বিনাশ করিয়া আমার সৈন্য নিঃশেষিতপ্রায় করিয়াছে। মহাত্মা দ্রোণাচাৰ্য্য যদি যত্নপূর্ব্বক অর্জ্জুনকে নিগ্রহ করিতেন, তাহা হইলে সে কখনই দুর্ভেদ্য ব্যূহ ভেদপূর্ব্বক সিন্ধুরাজকে বিনাশ করিয়া প্রতিজ্ঞাভার হইতে উত্তীর্ণ হইতে সমর্থ হইত না। অর্জ্জুন মহাত্মা দ্রোণাচার্য্যের অতিশয় প্রিয়; সেই জন্যই আচার্য্য যুদ্ধ না করিয়া তাহাকে পথ প্রদর্শন করিয়াছেন। আমার কি দুর্ভাগ্য! শত্রুতাপন আচার্য্য পূর্ব্বে সিন্ধুরাজকে অভয় প্রদান করিয়া এক্ষণে অর্জ্জুনকে সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিতে পথ প্রদান করিলেন। যদি তিনি পূর্ব্বেই সিন্ধুরাজকে গৃহগমনে অনুমতি করিতেন, তাহা হইলে কখনই এরূপ জনক্ষয় উপস্থিত হইত না। আমিও নিতান্ত অনাৰ্য্য সিন্ধুরাজ যখন জীবনরক্ষাৰ্থ গৃহে গমন করিতে প্রার্থনা করিয়াছিলেন, তখন আমি অভয়প্রদানে আশ্বস্ত করিয়া তাঁহাকে নিবারণ করিলাম। হায়! আজ আমাদের সমক্ষেই আমার চিত্রসেন প্রমুখ সহোদরেরা ভীমহস্তে কলেবর পরিত্যাগ করিল।’
দ্রোণবাক্যে অপক্ষপাত কর্ণোপদেশ-যুদ্ধারম্ভ
“কর্ণ কহিলেন, ‘হে মহারাজ! দ্রোণাচার্য্য জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া বলবীৰ্য্য ও উৎসাহ অনুসারে যুদ্ধ করিতেছেন; তুমি তাঁহার নিন্দা করিও না। শ্বেতবাহন অর্জ্জুন আচাৰ্য্যকে অতিক্রম করিয়া যে সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, তদ্বিষয়ে তাঁহার অণুমাত্রও অপরাধ লক্ষিত হইতেছে না। দ্রোণাচার্য্য স্থবির, শীঘ্রগমনে নিতান্ত অক্ষম ও বাহুব্যায়ামে [দ্রুত ভুজচালনে] একান্ত অশক্ত; কিন্তু কৃষ্ণসারথি মহাবীর অর্জ্জুন কৃতকাৰ্য্য, যুবা, শিক্ষিতাস্ত্র ও লঘুবিক্রম; সে দুর্ভেদ্যবর্ম্মসংবৃতকলেবর ও ভুজবলদর্পিত হইয়া দিব্যাস্ত্রযুক্ত বানরলাঞ্ছিত রথে আরোহণ, অজয় গাণ্ডীবশরাসন ধারণ ও সুতীক্ষ্ণ শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক যে দ্রোণাচাৰ্য্যকে অতিক্রম করিয়াছে, উহা আশ্চর্যের বিষয় নহে, সুতরাং আমি তদ্বিষয়ে দ্রোণের কিছুমাত্র দোষদর্শন করি না। যাহা হউক, যখন ধনঞ্জয় দ্রোণকে অতিক্রম করিয়া সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, তখন পাণ্ডবগণকে পরাজয় করা তাঁহার সাধ্যায়ত্ত নহে। হে মহারাজ! দৈবনির্দ্দিষ্ট বিষয় কদাচ অন্যথা হয় না। দেখ, আমরা সকলেই শক্তি অনুসারে সংগ্রাম করিতেছিলাম; কিন্তু আমাদের মধ্যে সিন্ধুরাজ নিহত হইলেন। অতএব এই বিষয়ে দৈবই বলবান্, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। আমরা তোমার সহিত মিলিত হইয়া শঠতা ও বিক্ৰম প্ৰকাশপূর্ব্বক পরমযত্নসহকারে জয়লাভের চেষ্টা করিতেছিলাম; কিন্তু দৈবই আমাদিগের পুরুষকার নষ্ট করিলেন। দুর্দৈবগ্রস্ত মনুষ্য যে কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে, দৈবই তাহার সেই বিষয়ে বারংবার বিঘ্ন উৎপাদন করিয়া থাকেন। মনুষ্য সতত অধ্যবসায়সম্পন্ন হইয়া যে কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়, নিঃশঙ্কচিত্তে তাহার তাহা অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য; কিন্তু সিদ্ধিলাভ দৈবায়ত্ত। আমরা শঠতা প্রকাশ ও বিষপ্রয়োগপূর্ব্বক পাণ্ডবগণকে বঞ্চনা এবং জতুগৃহে দগ্ধ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম; তাহারা দ্যূতে পরাজিত ও রাজনীতি অনুসারে অরণ্যে প্রব্রাজিত হইয়াছিল, কিন্তু দৈব আমাদিগের যত্নসম্পাদিত সেই সমস্ত বিষয়ে বিঘ্নানুষ্ঠান করিয়াছেন। অতএব হে মহারাজ! তুমি জীবিত নিরপেক্ষ হইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। তোমাদের উভয়পক্ষের মধ্যে যাহারা সুদৃঢ় যত্নশালী হইবে, দৈব তাহাদেরই অনুকূল হইবেন। পাণ্ডবগণের বুদ্ধিপূর্ব্বক অনুষ্ঠিত সকাৰ্য্য বা তোমার দুর্বুদ্ধিকৃত অসৎকাৰ্য্য কদাচ এ বিষয়ে কারণরূপে লক্ষিত হয় না; তবে যে তাহাদের জয় ও তোমার পরাজয় হইতেছে, এই বিষয়ে দৈবই প্রমাণ। মনুষ্যগণ যখন নিদ্রায় অভিভূত হয়, অনন্যকর্ম্মা দৈব তখনও জাগরিত থাকে। হে মহারাজ! প্রথম যুদ্ধ আরম্ভের সময় তোমার পক্ষে বহুসংখ্যক সৈন্য ও যোদ্ধা ছিল; কিন্তু পাণ্ডবগণের তাদৃশ ছিল না, তথাচ তাহারা তোমার পক্ষীয় বহু বীরকে সংহার করিল। অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে, দৈবই আমাদিগের পুরুষকার বিনষ্ট করিতেছেন।’
“হে মহারাজ! তাঁহারা উভয়ে এইরূপে বহুবিধ কথা কহিতেছেন, ইত্যবসরে সংগ্রামস্থলে পাণ্ডবগণের সৈন্যসমুদয় নিরীক্ষিত হইল। তখন উভয়পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল। হে রাজন্। কেবল আপনার দুর্ম্মমন্ত্রণাপ্রভাবেই এই মহান জনসংক্ষয় সমুপস্থিত হইয়াছে।”
জয়দ্রথবধপৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।