১৫১. পথশ্রান্তা কুন্তীর জন্যে জলাহরণ, কুন্তী প্রভৃতির ক্লেশে ভীমের ক্ষোভ
একপঞ্চাশদধিকশততম অধ্যায়।
মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেনের গমনকালে তদীয় ঊরুবেগে বনস্থ বৃক্ষসকল শাখা প্রশাখার সহিত কম্পমান হইতে লাগিল। তাহার জপবনে পার্শ্বস্থ বৃক্ষ ও লতা সকল ভূতলশায়ী হইল, তিনি সমীপন্থ কলপুষ্পবনত বৃক্ষ সমুদয় ভগ্ন করিয়া গমনপূর্বক ক্রোধান্বিত তেজস্বী দাবী ষষ্টিবর্ষবয়স্ক মাতঙ্গের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। অন্যান্ট পাণ্ডবগণ ভীমের গমনবেগ সস্থ করিতে না পারিয়া মুচ্ছিতায় হইলেম। ভীমসেম উন্নত ও বিষম প্রদেশে, স্বীয় জননী কুন্তীকে অতি সাবধানে পৃষ্ঠে করিয়া বহন করিতে লাগিলেন। এইরূপে তাঁহারা অতি কষ্টে অনেক বন অতিক্রম করিয়াও দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের ভয়ে প্রচ্ছন্নবেশে বাইতে লাগিলেন। ক্রমে সায়ংকাল উপস্থিত হইল; ঐ সময়ে তাহারা আর এক নিবিড় অরণ্যানী মধ্যে প্রবেশ করিলে। ঐ অরণ্যে জল বা কোনপ্রকার ফলমূল কিছুই নাই। উহার চতুর্দিকে হিংস্র জন্তু ও ক্রুর পক্ষিগণ ভ্রমণ করিতেছে। ক্রমে ক্রমে ঘোরতর অন্ধকার সমুপস্থিত হইল; অকস্মাৎ প্রবল বায়ু দ্বারা বৃক্ষের ফলপত্র পতিত, বৃক্ষগুল্মাদি উৎপাটিত ও অবনামিত হইয়া দশ দিক্ একেকারে আচ্ছন্ন হইয়া গেল।
পাণ্ডবগণ পরিশ্রান্ত, পিপাসার্ত ও নিতান্ত নিদ্রাতুর হইয়া গমনে অসমর্থ হইলেন। তাঁহারা সেই আহারদ্রব্যশূন্য বনে অবস্থিতি করিলেন। তাহার পর কুন্তী নিতান্ত তৃষাতুরা হইয়া, স্বকীয় পুত্রদিগকে কহিলেন, হায়! আমি পাণ্ডবগণের মাতা হইয়া এবং তাঁহাদিগের মধ্যে অবস্থিতি করিয়াও পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ হইলাম। ভোজরাজনন্দিনীর ঐ প্রকার কাতরোক্তি শ্রবণে মাতৃভক্তিপরায়ণ ভীমসেনের মন কারুণ্যরসে পরিপূর্ণ হইল। তিনি কিঞ্চিন্মাত্রও বিলম্ব না করিয়া মাতা ও ভ্রাতৃচতুষ্টয়কে পূর্ববৎ গ্রহণ করিয়া আর এক পরম রমশীয় কাননে উপস্থিত হইলেন। তথায় গিয়া এক বৃহৎ বটবৃক্ষ দেখিতে পাইলেন। তখন তিনি সেই বিপুল ন্যগ্রোধ পাদপমূলে মতা ও ভ্রাতৃগণকে রাখিয়া তাঁহাদিগকে কহিলেন, আপনারা এই স্থানে ক্ষণেক বিশ্রাম করুন; আমি জল অন্বেষণার্থে গমন করি। ঔ দেখুন, জলচর সারসগণ কনস্বরে ধ্বনি করিতেছে। বোধ হয়, অনতিদূরেই অতি বৃহৎ জলাশয় আছে। তাহাদিগকে এই কথা কহিয়া জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্বক সারগণের কলরবানুসারে ক্রোশদ্বয় গমন করিয়া এক মহৎ সবোবর দেখিতে পাইলেন। তখন তিনি ঐ মোবৰুে অকগাহনপূর্বক সুন ও জলপান করণানন্তর মাতা ও ভ্রাতদিগের নিমিত্ত স্বী উত্তরীয় শস্ত্রে করিয়া জল গ্রহণপূর্বক মুহূৰ্তমধ্যে তাঁহাদের সমীপে সমাগত হইলেন। আসিয়া দেখিলেন, মাতৃসমবেত ভ্রাতৃতুল্টয় ধরণী তলে শয়ন করিয়া নিদ্রাভিভূত হইয়াছেন।
তাঁহাদিগের সেই অবস্থা দর্শনে ভীমসেনের শোকের আর পরিসীমা রহিল না। তিনি বিলাপ করিতে করিতে কহিলেন, হায় কি কষ্ট! আমার কি দুরদৃষ্ট! অজি ভাতাদিগকে ধরাতলে নিদ্রিত দেখিতে হইল! বারণাবত নগরে দুগ্ধফেনসভি শয্যায় শয়ন করিয়াও যাহাদের নিদ্রা হইত না, এক্ষণে তাঁহার ভূমিশয্যায় শয়ান হইয়া অনায়াসে সুষুপ্ত হইয়াছেন! হায়! কি পরিতাপের বিষয়! মিনি শত্রুঘাতী বসুদেবের ভগিনী, যিনি কুম্ভীরাজের পুত্রী, যিনি সৰ্বলক্ষণসম্পন্ন, যিনি মহারাজ বিচিত্রবীর্যের স্নুষা, যিনি মহাত্মা পাণ্ডুর পত্নী, যিনি আমাদিগের জননী, যিনি প্রফুল্ল পুণ্ডরীকের ন্যায় প্রভাশালিনী এবং যিনি ধর্ম, ইন্দ্র ও বায়ু হইতে এই সকল সন্তান প্রসব করিয়াছেন, অন্য সেই সুকুমাঙ্গী মহাশয়নোচিত। কুন্তীকে ভূতলশায়িনী দেখিতে হইল! ইহা অপেক্ষা আর দুঃখের বিষয় কি আছে? যে ধর্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির ত্রিলোকীরাজ্যের আধিপত্য হইতে পারেন, তিনি পরিশ্রান্ত হইয়া ভূতলে শয়ন করিয়া আছেন! নবীন জলধরের ন্যায় শ্যামলবর্ণ আলোকসামান্য অর্জুন প্রাকৃত লোকের ন্যায় ভূমিশয্যায় শয়ন করিয়া আছেন। ইহা কি সামান্য দুঃখের কথা! যে মাদ্রীনন্দনদ্বয় অশ্বিনীতনয়ের ন্যায় রূপবান, ইহার প্রাকৃত মনুষ্যের ন্যায় ধরাতলে শয়ন করিয়া অনায়াসে নিদ্রা যাইতেছেন; ইহার পর আর দুঃখ কি আছে? যাহার কুলকলঙ্কস্বরূপ বিষম জ্ঞাতিবর্গ নাই, সে পরমসুখে কালযাপন করে। গ্রামে একটিমাত্র বৃক্ষ থাকিলে সে পুষ্পফলোপশোভিত হইয়া চৈত্য নামে খ্যাত ও সকলের পূজিত হয়। যাহাদের বলবান্ পরম ধার্মিক জ্ঞাতি সকল থাকে, তাহারা নির্বিঘ্নে পরমসুখে বাস করে। আমাদের এমনই দুরদৃষ্ট যে, পরম সুহৃৎ ধুতরাষ্ট্র পুত্রের পরামর্শানুসারে আমাদিগকে দগ্ধ করিবার মানসে দেশ হইতে নির্বাসিত করিয়াছেন; কেবল দৈবের অনুকূলতায় একাল পর্যন্ত জীবিত আছি! দারুণ অগ্নিভয় হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছি বটে, কিন্তু এক্ষণেও এই নিবিড় অরণ্যে প্রবেশ করিয়া কোন দিকে যাইব বা কি করিব, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। হা দুরাত্মন্ কুরুকুলকলঙ্ক দুর্য্যোধন! তুই এত দিনের পর কৃতার্থ হইলি। নিশ্চয় জানিলাম, তোর দৈব সুপ্রসন্ন; তন্নিমিত্তই ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির কুপিত হইয়া আমাকে আজ্জা প্রদান করেন না। যদি পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ একবার ইঙ্গিতে আমাকে অনুজ্ঞা করেন, তাহা হইলে আমি অদ্যই তোমাকে অমাত্য, সহোদর, কর্ণ ও শকুনি সমভিব্যাহারে শমনভবনে পাঠাই। মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন কহিতে কহিতে ক্রোধে কম্পিতকলেবর হইয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক করে করে মর্দন করিতে লাগিলেন। তিনি ক্ষণকাল পরে নির্বাণোন্মুখ হুতাশনের ন্যায় ক্রমে ক্রোধশূন্য হইয়া সেই স্থানে উপবেশনপূর্বক ইতরের ন্যায় মহীতলে সুষুপ্ত মাতা ও ভ্রাতাদিগকে নিরীক্ষণ করিতে করিতে কহিলেন, বোধ হয়, এই বনের অনতিদূরেই নগর আছে; এক্ষণে ইহাদের জাগরণ সময়, কিন্তু ইহায় স্বচ্ছন্দে নিদ্রা যাইতেছেন; কি করি, আমিই জাগিয়া থাকি, ইহার নিদ্রান্তে গাত্রোত্থান করিয়া জলপান করিবেন। এই বলিয়া ভীমসেন তথায় অপ্রমত্তভাবে জাগরিত হইয়া রহিলেন।
জতুগৃহ পর্বাধ্যায় সমাপ্ত।