১৫১তম অধ্যায়
কৌরবগণের সেনাসন্নিবেশ
জনমেজয় কহিলেন, হৈ তপোধন!! রাজা দুৰ্য্যোধন সপুত্ৰ বিরাট ও দ্রুপদ এবং কেকয়, বৃষ্ণি ও অন্যান্য শতসহস্ৰ মহীপালগণে পরিবৃত, বাসুদেবকর্ত্তৃক সুরক্ষিত, সসৈন্য রাজা যুধিষ্ঠিরকে আদিত্যগণ [দ্বাদশ আদিত্য-আদিত্যাদি পৃথক পৃথক দ্বাদশ সূৰ্য্য] পরিবেষ্টিত সুররাজ ইন্দ্রের ন্যায় সেই তুমুল সংগ্রামের নিমিত্ত কুরুক্ষেত্রে সমাগত শ্রবণ করিয়া কিরূপ অনুষ্ঠান করিলেন? হে ব্ৰহ্মন! এই বীরসমাগম ইন্দ্ৰপ্ৰভৃতি দেবগণকেও ব্যথিত করিতে সমর্থ; বিশেষতঃ পাণ্ডবগণ, কৃষ্ণ, বিরাট, দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও যধামনু—এই সমস্ত মহাবীর দেবগণেরও দুরধিগম্য [সম্মুখে যাইতে শঙ্কাজনক]। অতএব সেই সময় কৌরব ও পাণ্ডবগণের তৎকালীন বিচেষ্টিত [চেষ্টা-উদ্যম] ও কাৰ্য্যসকল সবিস্তার কীর্ত্তন করুন, উহা শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইতেছে।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! বাসুদেব প্ৰতিগমন করিলে রাজা দুৰ্য্যোধন কৰ্ণ, দুঃশাসন ও শকুনিকে কহিলেন, দেখ, বাসুদেব যে কাৰ্য্য সংসাধনোদেশে আগমন করিয়াছিলেন, তাহা সফল না হওয়াতে তিনি নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া পাণ্ডবগণসন্নিধানে প্রতিনিবৃত্ত হইয়াছেন; অতএব অবশ্যই কৌরবগণকে ভস্মাবশেষ করিবেন। পাণ্ডবগণের সহিত আমার সমরানল প্রজ্বলিত হয়, ইহা তাঁহার নিতান্ত অনুমোদিত। ভীমসেন ও অজুন তাঁহারই ছন্দানুবর্ত্তী [অভিপ্ৰায়ের অনুসরণকারী]। রাজা যুধিষ্ঠির ভীমসেনের বশংবদ। পূর্ব্বে আমি অনুজগণের সহিত তাঁহার অপ্রিয় অনুষ্ঠান করিয়াছি, বিরাট ও দ্রুপদের সহিত আমার শত্রুভাব জন্মিয়াছে; তাঁহারাই এক্ষণে বাসুদেবের বশবর্ত্তী হইয়া সেনাপতিপদ পরিগ্রহ করিয়াছেন। এই লোমহর্ষণ তুমুল সংগ্রাম অবিলম্বেই সমুপস্থিত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। অতএব তোমরা আলস্য পরিহার করিয়া সাংগ্রামিক [সমরসম্বন্ধীয়] কাৰ্য্যের আয়োজন কর। এক্ষণে কুরুক্ষেত্রের প্রশস্ত স্থানে শক্রগণের দুরাক্রম্য, বিবিধায়ুধপূর্ণ, ধ্বজপতাকাশোভিত, উন্নত ও দৃঢ়তর আবরণে পরিবেষ্টিত, শতসহস্ৰ শিবির সন্নিবেশিত কর। তথায় সমরোপযোগী সামগ্ৰীসকলের আহরণার্থ যে পথ প্ৰস্তুত করিবে, তাহা যেন শত্রুপক্ষ সহসা আক্রমণ করিতে সমর্থ না হয়। জল ও কাষ্ঠভার শিবিরমধ্যে স্থাপিত করিয়া রাখিবে এবং তথায় গমনাগমন করিবার নিমিত্ত নগরের বহির্ভাগে অবন্ধুর [সমতল] পথ প্রস্তুত করিবে। হে বীরগণ! কল্যই যুদ্ধযাত্ৰা করিতে হইবে, অবিলম্বে সর্ব্বত্র এইরূপ ঘোষণা কর।” তখন তাহারা ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া পরদিন প্ৰভাতে স্থানে স্থানে উক্তরূপ ঘোষণা করিয়া মহীপালগণের নিবাসের নিমিত্ত শিবিরসমূহ সন্নিবেশিত করিতে লাগিলেন।
দুৰ্য্যোধনপক্ষীয় যুদ্ধসজ্জা
অনন্তর পার্থিবগণ রাজাজ্ঞা শ্রবণ করিবামাত্ৰ সত্বরে স্ব স্ব মহার্হ। সিংহাসন হইতে উত্থিত হইয়া কাঞ্চনাঙ্গদসমলঙ্কৃত, চন্দন অগুরুবিভূষিত [অগুরুচন্দনে অঙ্কিত], অর্গলতুল্য ভুজযুগল বারংবার মর্দন ও উত্তরীয় প্রভৃতি বসন এবং নানাবিধ ভূষণ পরিধান ও উষ্ণীষ বন্ধন করিতে লাগিলেন। রথিগণ রথ, অশ্বকোবিদেরা [অশ্বের দোষগুণে অভিজ্ঞ] অশ্ব এবং হস্তিশিক্ষায় নিযুক্ত পুরুষেরা হস্তিসকল সুসজ্জিত করিতে লাগিল। অধিকৃত [সমরবিভাগে নিয়োজিত] ভৃত্যেরা কাঞ্চনময় বিচিত্র বর্ম্ম ও বিবিধ অস্ত্রশস্ত্ৰসকল আহরণ করিল। পদাতিক পুরুষেরা সুবর্ণচিত্ৰিত বহুবিধ আয়ুধসকল ধারণ করিতে লাগিল। তখন প্ৰহৃষ্ট-জনসমাকীর্ণ [হর্ষযুক্ত জনগণে সমাকুল] মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের রাজধানী উৎসবময় হইয়া উঠিল। যোদ্ধৃগণসমাকীর্ণ কুরুরাজমণ্ডল [কৌরবপক্ষীয় রাজগণ] চন্দ্ৰোদয়কালীন মহার্ণবের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন; জনসমূহ আবর্তের [জলের ঘূর্ণী] ন্যায়, হস্তী, রথ ও তুরগসকল মীননিকারের [মৎস্যসমূহের] ন্যায়, বিচিত্র আভরণ বৰ্মসকল ঊৰ্মিমালার ন্যায়, কোষসমূহ রত্নজাতের ন্যায়, শঙ্খদুন্দিভিনিনাদ গভীর নির্ঘোষের ন্যায়, প্রাসাদপংক্তি পর্ব্বতরাজির ন্যায়, অস্ত্রশস্ত্ৰসকল ফেননিচয়ের ন্যায়, রথ্যা [পৰ্থ] ও আপণসকল সমুদ্রগামী হ্রদনিবাহের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল।