১৫০. জতুগৃহদাহে কৌরবদিগের কপট শোক
পঞ্চাশদধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন,-রজনী প্রভাত হইলে পৌরগণ পাণ্ডুনন্দনদিগকে দেখিবার নিমিত্ত তথায় আগমন করিয়া অগ্নি নির্বাণানন্তর দেখিল যে, জতুগৃহ দগ্ধ হইয়াছে এবং অমাত্য পুরোচন ভস্মসাৎ হইয়াছে। তখন তাহারা যৎপয়োনাস্তি শোকার্ত হইয়া রোদন করিতে করিতে কহিতে লাগিল, “হায়! পাপকর্মা দুৰ্য্যোধনই পাণ্ডবগণকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত এই গর্হিত কাৰ্য্য করিয়াছে। এই কর্ম অবশ্যই ধৃতরাষ্ট্রের জ্ঞাতসারে হইয়াছে। তিনিও স্বীয় পুত্রকে এই গর্হিতানুষ্ঠান হইতে নিবৃত্ত করেন নাই, মহাত্মা ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর ও কৃপ ইহারাই বা কি বলিয়া এই নৃশংস কাৰ্যানুষ্ঠানে অনুমোদন করিলেন।” যাহা হউক, আইস আমরা দুরাচার ধৃতরাষ্ট্রের নিকট “তোমার মনস্কামনা সিদ্ধ হইয়াছে, তুমি পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করিয়াছ” বলিয়া সংবাদ পাঠাই।
তদনন্তর পৌরগণ পাণ্ডবগণের অন্বেষণার্থে অগ্নি নির্বাণ করিতে করিতে ভস্মীভূত নিরপরাধ নিষাদী ও তাহার পঞ্চপুত্রকে দেখিতে পাইল; তাহারা উহাদিগকেই পঞ্চপুত্র-সমবেতা কুন্তী বলিয়া স্থির করিল। খনক জতুগৃহ পরিষ্কার করিবার ছলে স্বকৃত গহ্বর পাংশুদ্বারা এরূপ পূরাইয়া দিল যে, কেহই উহার বিন্দুবিসর্গমাত্রও অনুসন্ধান পাইল না। তৎপরে পৌরগণ, গৃহদাহে মাতৃসমবেত পাণ্ডবগণ ও অমাত্য পুরোচন দগ্ধ হইয়াছে, এই সংবাদ ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে পাঠাইল। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবগণের বিনাশবার্তা শ্রবণে সাতিশয় দুঃখিত হইয়া বিলাপ করিতে করিতে কহিলেন, “হায়! মাতৃসমবেত যুধিষ্ঠিরাদি বীরগণ বিনষ্ট হওয়াতে এতদিনের পর আমার ভ্রাতা পাণ্ডু মৃত হইলেন। মদীয় অধিকৃত পুরুষেরা অতি রায় বারণাবতনগরে গমন করিয়া পাণ্ডবদিগের ও কুন্তীরাজপুত্রী কুন্তীর সৎকার করুক এবং তাঁহাদিগের স্বার্থে তথায় বৃহৎ বৃহৎ কৃত্রিম নদী প্রস্তুত করুক। আর যাহারা ঐ স্থানে মরিয়াছে, তাহাদের সুহৃদ্বর্গও তথায় গমন করুক। যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে, এক্ষণে ধনব্যয় দ্বারা কুন্তী ও পাণ্ডবগণের পারত্রিক হিতসাধন যতদূর হইতে পারে, তাহাতে যেন কোন প্রকারেঞটি না হয়।”
অম্বিকানন্দন ধৃতরাষ্ট্র এইরূপ পরিদেবনানন্তর জ্ঞাতিবর্গ সমভিব্যাহারে সমাতৃক পাণ্ডুনন্দনগণের উদকক্রিয়া সম্পন্ন করিলেন। সকলেই শোকপরবশ হইয়া বোদন করিতে লাগিলেন। কেহ কেহ “হা। যুধিষ্ঠির! হা ভীমসেন। হা অর্জুন! হা নকুল! হা সহদেব! এবং হা কুন্তী!” বলিয়া শোক করিতে লাগিল। এইরূপে সমস্ত পৌরবর্গ পাণ্ডবগণের নাম করিয়া যৎপরোনাস্তি অনুতাপ করিতে লাগিল। কেবল সৰ্ববৃত্তান্তজ্ঞ বিদুর লোক প্রত্যয়ের নিমিত্ত অতি অল্পমাত্র কৃত্রিম শোক প্রকাশ করিলেন।
এদিকে পাণ্ডবগণ মাতৃসমভিব্যাহারে রজনীযোগে বারণাবত নগর হইতে বহির্গমনানন্তর নৌকাররাহণপূর্বক নাবিকগণের ভুজবল, নদীর স্রোতবেগ ও বায়ুর অনুকূলতাবশতঃ অতি ত্বরায় গঙ্গা পার হইলেন। পরে নক্ষত্ৰদ্বারা দিঙ নিরূপণ করিয়া স্থলপথে ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে গমন করিতে লাগিলেন। তাহারা পথিমধ্যে এক মহারণ্যে প্রবেশ করিয়া একান্ত পরিশ্রান্ত ও নিতান্ত পিপাসার্ত এবং নিদ্ৰান্ধ হইয়া ভীমসেনকে কহিলেন, দেখ, এই নিবিড় অরণ্যামধ্যে আমাদের সাতিশয় কষ্ট হইতেছে; আমরা কোনপ্রকারেই দিঙ্নির্ণয় করিতে পারিতেছি না, চলিতে নিতান্ত অসমর্থ হইতেছি, সেই দুরাত্মা পুরেচন দগ্ধ হইয়াছে কি না, তাহাও জানিতে পারিলাম না; এক্ষণে কিরূপে এই বিষম ভয় হইতে বিমুক্ত হই। তুমি আমাদের সর্বাপেক্ষা বলবান্, অতএব তুমিই পূর্বের ন্যায় আমাদিগকে লইয়া চল। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের বাক্যে স্বীয় জননী কুন্তী ও ভ্রাতৃগণকে পূর্বের ন্যায় লইয়া বায়ুবেগে গমন করিতে লাগিলেন।