রাম সীতা রহিলেন পর্ব্বত উপরে।
হেথা দশরথ রাজা হইল সৎবৎসরে।।
কহিল শ্রীরাম, সীতা আর লক্ষ্মণেরে।
কি দিয়া করিব শ্রাদ্ধ পিতৃদেব তরে।।
তখন করেন যুক্তি শ্রীরাম দৈত্যারি।
ভঞ্জিত করিয়া আন মাণিক্য-অঙ্গুরী।।
অঙ্গুরী লইয়া গেল দুই সহোদরে।
সীতা আরম্ভিলা খেলা ফল্গুনদী-তীরে।।
খেলেন লইয়া বালি সীতা বহুমতে।
আসিলেন দশরথ সীতার সাক্ষাতে।।
দশরথ কহিলেন, শুন ওমা সীতে।
ক্ষুধার জ্বালায় আমি না পারি তিষ্ঠিতে।।
তুমি বধূ, আমি তব শ্বশুর-ঠাকুর।
দিইয়া বালির পিণ্ড ক্ষুধা কর দূর।।
রাজা কন সীতাদেবী কহি তব স্থান।
আমার নিকটে তুমি রামের সমান।।
সীতা কহিলেন, দেব কহি যে তোমারে।
কি মতে দিইব পিণ্ড রাম অগোচরে।।
মনে কিছু না করিও, ওমা চন্দ্রমুখি।
লোক জন ডাকি আনি করে রাখ সাক্ষী।।
ভাল ভাল কহিলেন সীতা চন্দ্রমুখী।
আদ্যের তুলসী তুমি হয়ে থাক সাক্ষী।।
জিজ্ঞাসা করেন রাম আসিয়াই যদি।
বটবৃক্ষ কহিবেক আর ফল্গুনদী।।
ব্রাহ্মণ দেখিয়া সীতা করেন জ্ঞাপন।
দশরথ-কথা সব কহিবে ব্রাহ্মণ।।
ইহা শুনি দশরথ হর্ষে উঠি রথে।
লইয়া বালির পিণ্ড গেলা স্বর্গপথে।।
হেথা প্রভু রামচন্দ্র অতি ত্বরাপর।
শ্রাদ্ধের সামগ্রী লয়ে আইলা সত্বর।।
রামেরে দেখিয়া সীতা হরিষ অন্তরে।
নিবেদন করিলেন রামের গোচরে।।
সীতা কহিলেন, শুন প্রভু রঘুবর।
আশ্রমে আসিয়াছিলা অজের কোঙর।।
আমারে করিতে শ্রাদ্ধ কন দশরথ।
লইয়া বালির পিণ্ড গেলা স্বর্গপথ।।
রাম কহিলেন, কিসে প্রত্যয় হয় কথা।
সাক্ষী করি রাখিয়াছি, কন দেবী সীতা।।
সাক্ষীরে আনিয়া সীতা বলাও এখন।
সাক্ষী পাইলেই মোর প্রত্যয় হয় মন।।
সীতা কহিলেন, গোঁসাই করি নিবেদন।
জিজ্ঞাসা করহ তুমি ডাকিয়া ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ বলেন, খর্ব্ব দিব রঘুনাথে।
মিথ্যা বাক্য কব আজি রামের সাক্ষাতে।।
ডাকিয়া ব্রাহ্মণে জিজ্ঞাসেন রঘুনাথে।
তোমরা দেখেছ মোর পিতা দশরথ।।
ব্রাহ্মণ কহেন তবে রামের সাক্ষাতে।
আমরা না দেখিয়াছি রাজা দশরথে।।
এ কথা শুনিয়া রাম কন হাসি হাসি।
লজ্জায় মলিন হৈল সীতা সুরূপসী।।
মিথ্যা কৈয়া ব্রাহ্মণ এতেক দিলে তাপ।
ক্রোধে তনু থর থর, দিনু তোমা শাপ।।
লক্ষ তঙ্কার দ্রব্য যদি থাকে তব ঘরে।
ভিক্ষার লাগিয়া যেও দেশ-দেশান্তরে।।
রাম কন, কেন কান্দ সীতা চন্দ্রমুখি।
আর কেহ থাকে ত বলাও দেখি সাক্ষী।।
এতেক শুনিয়া কন সীতা সুরূপসী।
আনিয়া বলান প্রভু আদ্যের তুলসী।।
অতঃপর তুলসী-কানন তথা হেরি।
কহিলেন রঘুনাথ,কহ দ্রুত করি।।
পিণ্ড-প্রদানের তুমি জান বিবরণ।
তুলসী কহেন, যথা কহেন ব্রাহ্মণ।।
তুলসী বলেন, রাম মোরে নিবে হাতে।
মিথ্যা কথা কব আমি তোমার সাক্ষাতে।।
শ্রীরাম বলেন, তুলসী শুন মোর কথা।
সাক্ষাতে দেখেছ মোর দশরথ পিতা।।
তুলসী বলেন তবে প্রভু রঘুবরে।
আমরা না দেখিয়াছি তোমার পিতারে।।
কথা শুনি জানকীর জন্মে মনস্তাপ।
যা রে যা তুলসী আমি তোরে দিনু শাপ।।
এত দুঃখ দিলি তুই আমার অন্তরে।
আভূমি জন্মিও তুমি হৈয়া সর্ব্বত্তরে।।
ক্রোধভরে সীতা দেবী কহেন এমন।
তোর পত্র শ্রীহরির আদরের ধন।।
অপবিত্র স্থানে তোর অবস্থিতি হবে।
শৃগাল কুক্কুর মূত্র পুরীষ ত্যজিবে।।
হাসিয়া বলেন রাম, শুনহ জানকি।
আর কেহ থাকে ত, বলাও তারে সাক্ষী।।
সীতা কহিলেন, শুন প্রভু গুণনিধি।
আর সাক্ষী আছ সেই ফল্গু মহানদী।।
ফল্গু বলে, মিথ্যা কব শ্রীরামের স্থলে।
দিবেন কতেই দ্রব্য রাম মোর জলে।।
ফল্গুরে সুধান রাম কমল-লোচন।
তুমি দেখিয়াছ কিবা অজের নন্দন।।
ফল্গুনদী কহে, শুন প্রভু রঘুনাথ।
আমি নাহি দেখিয়াছি রাজা দশরথ।।
এতেক শুনিয়া সীতা কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।
আমি আজি দিব শাপ এ ফল্গুনদীরে।।
অন্তঃশীলা হয়ে তুমি বহিও সর্ব্বকাল।
তোমারে ডিঙ্গিয়া যাবে কুক্কুর শৃগাল।।
শ্রীরাম বলেন, শুন সীতা চন্দ্রমুখি।
আর কেহ থাকে যদি, বলাও আনি সাক্ষী।।
সীতা বলিলেন, রাম লজ্জা-বোধ করি।
বটবৃক্ষ আনি সাক্ষী বলাও দৈত্যারি।।
বটবৃক্ষ আসি কহে প্রভু রঘুবর।
সাক্ষী দিব, যদি মোর জুড়াও অন্তর।।
রাম সীতা দোঁহে আজ হেরিব অন্তর।
তবে আমি সাক্ষ্য দিব তব বিদ্যমানে।।
বৃক্ষ-কথা শুনি সীতা আনন্দিত মন।
রামের বামেতে সীতা দাঁড়ান তখন।।
হেরিয়া যুগল-রূপ নিজের নয়নে।
যোড়হস্তে বলে বৃক্ষ রাম বিদ্যামানে।।
তোমার চরণে প্রভু এই নিবেদন।
চিন্তামণি নাম তুমি ধর কি কারণ।।
দয়াময় নাম তব সর্ব্বলোকে কয়।
পতিতে তরাও, তাই নাম দয়াময়।।
স্থাবর জঙ্গম আদি যত জীবগণ।
সর্ব্ব জীবে সর্ব্বক্ষণে আছ নারায়ণ।।
সংসারের চিন্তা কর নাম চিন্তামণি।
সীতা পিণ্ড দিলা কিনা, না জান নৃমণি।।
চিন্তামণি-নামে তব কলঙ্ক রহিল।
আজি হতে চিন্তামণি নামটি ডুবিল।।
চিন্তায় আকুল হয়ে ভুলেছ আপনা।
মায়ায় মানুষ হলে, কিছু নাহি জানা।।
বটবৃক্ষ কহে, শুন কমল-লোচন।
মিথ্যা সাক্ষ্য ইহারা দিলেক সর্ব্বজন।।
ধনলোভে মিথ্যা কথা কহিল ব্রাহ্মণ।
ব্রাহ্মণের অনুরোধে অন্য দুই জন।।
আমি যদি মিথ্যা বলি একে হবে আর।
অন্তর্য্যামী নারয়ণে ফাঁকি দেওয়া ভার।।
শত-কোটি-জন্ম তপ করে যেই জন।
সত্যবাদী সব কিন্তু না হয় কখন।।
বালি-পিণ্ড লয়েছিলা সীতা ডান হাতে।
আপনি লইলা তাহা রাজা দশরথে।।
খাইয়া সীতার পিণ্ড প্রফুল্ল-অন্তরে।
দেখিতে দেখিতে রাজা গেলা স্বর্গপুরে।।
শুনিয়া বৃক্ষের কথা কন রঘুবর।
চিরজীবী হও বট অক্ষয় অমর।।
পিণ্ড-দান করি মনে ভাবেন জানকী।
বারে বারে সবাকারে করিয়াছি সাক্ষী।।
তুষ্ট হয়ে বর দিব তোমায় কেবল।
শীতকালে উষ্ণ হবে, গ্রীষ্মেতে শীতল।।
পুনর্ব্বার সীতা তারে দিলা এই বর।
ডালে ডালে হবে তব পল্লব বিস্তর।।
মনোহর সুশীতল রবে আনিবার।
নিষ্পত্র না হবে শাখা কদাপি তোমার।।
সুশীতল রাখিবে, যে যাবে তব তলে।
সর্ব্বদা আনন্দে রবে নিজ পত্র-ফলে।।
এইরূপে বটবৃক্ষে আশীর্ব্বাদ করি।
বিদায় দিলেন তারে রামের সুন্দরী।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের কথা সুধাভাণ্ড।
পরম পবিত্র এই অযোধ্যার কাণ্ড।।