১৪৭. ভীম-হনূমানের পরস্পর কথোপকথন

১৪৭তম অধ্যায়

ভীম-হনূমানের পরস্পর কথোপকথন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাবীর ভীমসেন বানরেন্দ্ৰ হনূমানের বাক্যশ্রবণানন্তর তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, “তুমি কে? কি নিমিত্ত বানরশরীর ধারণ করিয়াছ? আমি ক্ষত্ৰিয়, কুরুকুলোৎপন্ন সোমবংশীয় পাণ্ডুর পুত্র; কুন্তীর গর্ভে বায়ুর ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, আমার নাম ভীমসেন।”

বানরাগ্রণ্য হনূমান কুরুবীর ভীমসেনের বাক্যশ্রবণে ঈষৎ হাস্য করিয়া তাহাকে কহিলেন, “হে ভদ্রে! আমি বানর, তোমাকে অভিলাষানুরূপ পথ প্রদান করিব না; এক্ষণে এস্থান হইতে প্রতিনিবৃত্ত হও, মৃত্যুগ্রাসে নিপতিত হইও না।”

ভীমসেন কহিলেন, “আমার মৃত্যুই হউক বা অন্য কোন বিপদই হউক, তদ্বিষয় তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি না। তুমি আমাকে পথ প্রদান কর; বৃথা আমার হস্তে ব্যথাপ্ৰাপ্ত হইও না।”

হনূমান কহিলেন, “আমি ব্যাধিতে নিতান্ত অভিভূত হইয়াছি উঠিবার শক্তি নাই; যদি নিতান্তই গমন করিবে, তবে আমাকে লঙ্ঘন করিয়া গমন কর।”

ভীম কহিলেন, “নির্গুণ পরমাত্মা সমুদয় প্রাণীগণের দেহে অধিষ্ঠান করেন, আমি তাঁহাকে অবমাননা বা লঙ্ঘন করিতে সমর্থ হইব না। যদি আমি সেই ভূতভাবন ভগবান পরমাত্মাকে না জানিতাম, তাহা হইলে যেমন হনূমান সাগর-লঙ্ঘন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তোমাকে ও এই পর্ব্বতকে অনায়াসেই লঙ্ঘন করিতাম।”

হনূমান কহিলেন, “হে নরশ্রেষ্ঠ! হনূমান সাগর-লঙ্ঘন করিয়াছিলেন, তিনি কে? যদি সবিশেষ জ্ঞাত হইয়া থাক, তবে বর্ণন কর।”

ভীমসেন কিহলেন, “সেই বানররাজ আমার ভ্রাতা; তিনি পরামগুণবান, বুদ্ধিসত্ত্ব ও বলসমন্বিত এবং রামায়ণে অতি সুবিখ্যাত। তিনি রামপত্নীর উদ্ধারার্থ শতযোজন-বিস্তৃত সাগর একলম্ফে লঙ্ঘন করিয়াছিলেন। আমি বল, বিক্রম ও যুদ্ধে সেই স্বীয় ভ্রাতা হনূমানের সদৃশ, অনায়াসেই তোমার নিগ্রহ করিতে পারি; অতএব শীঘ্ৰ গাত্ৰোত্থান করিয়া পথ প্ৰদান কর, নতুবা এইক্ষণেই তোমাকে শমনসদনে প্রেরণ করিব।”

মহাবলপরাক্রান্ত হনূমান ভীমসেনকে বলোন্মত্ত ও বাহুবীৰ্য্যদর্পিত জ্ঞান করিয়া মনে মনে হাস্য করিয়া পুনরায় কহিলেন, “মহাশয়! জরাপ্রভাবে আমার উত্থানশক্তি একেবারে বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে; অতএব অনুগ্রহ করিয়া আমার লাঙ্গুল [লেজ] উত্তোলনপূর্ব্বক গমন কর।”

ভীম-হনূমানের পরস্পর পরিচয়–বলপরীক্ষা

বাহুবলদপিত ভীমসেন হনূমানের বাক্য-শ্রবণানন্তর মনে মনে চিন্তা করিলেন, “এই বানরের কিছুমাত্র বলবিক্রম নাই; অতএব ইহার লাঙ্গুল ধারণপূর্ব্বক ইহাকে যমালয়ে প্রেরণ করিব।” এই স্থির করিয়া অবজ্ঞাপূর্ব্বক বামকরদ্বারা হনূমানের লাঙ্গুল ধারণ করিলেন, কিন্তু কোনক্রমেই উত্তোলন করিতে সমর্থ হইলেন না। তখন দুই হস্তদ্বারা ধারণ করিয়া যথাশক্তি আকর্ষণ করিতে লাগিলেন, কিন্তু কোনরূপেই চালিত করিতে পারিলেন না। তাঁহার চক্ষুদ্বয় বিবৃত্ত, মুখমণ্ডল ভ্রূকুটিবদ্ধ ও অঙ্গ হইতে শ্রমবারি নিৰ্গত হইতে লাগিল; কিন্তু হনূমানের লাঙ্গুল কোনক্রমেই উদ্ধৃত হইল না। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন যখন সাতিশয় যত্নসহকারেও লাঙ্গুলচালন করিতে সমর্থ হইলেন না, তখন লজ্জানম্রমুখে তাঁহার পার্শ্বদেশে গমনপূর্ব্বক প্ৰণিপাতপুরঃসর কৃতাঞ্জলিপুটে কহিতে লাগিলেন, “হে কপিশ্রেষ্ঠ! তুমি প্রসন্ন হও, আমি অজ্ঞানবশতঃ তোমার প্রতি দুর্ব্বাক্য-প্রয়োগ করিয়াছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তুমি কি সিদ্ধ বা দেবতা কি গন্ধর্ব্ব অথবা গুহ্যক? তুমি কে, বানররূপ ধারণ করিয়া এ স্থানে রহিয়াছ? যদি তোমার বৃত্তান্ত নিতান্ত গোপনীয় না হয় ও আমার শ্রোতব্য হয়, তবে আমি শিষ্টের ন্যায় জিজ্ঞাসা করিতেছি, অনুগ্রহ করিয়া আপনার পরিচয় প্ৰদান কর।”

হনূমান কহিলেন, “হে অরতিনিপাতন! আমাকে জানিবার নিমিত্ত তোমার সাতিশয় কৌতুহল হইয়াছে, অতএব আমার সমুদয় বৃত্তান্ত বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করা। আমি কেশরীর ক্ষেত্রে জগৎপ্ৰাণ সমীরণের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, আমার নাম হনূমান। পূর্ব্বে সমুদয় বানর-রাজ ও বানরযূথগণ যে সূৰ্য্যপুত্ৰ সুগ্ৰীব ও ইন্দ্রসূত বালীর উপাসনা করিতেন, যেমন অগ্নির সহিত বায়ুর প্রীতি তদ্রূপ সেই সুগ্ৰীবের সহিত আমার প্রণয় হইয়াছিল। সুগ্ৰীব কোন কারণবশতঃ স্বীয় ভ্রাতা বালীর নিকট অবমানিত হইয়া ঋষ্যমূকপর্ব্বতে আমার সহিত বহুদিন বাস করিয়াছিলেন। অনন্তর দেবগ্রগণ্য বিষ্ণু মনুষ্যরূপে দশরথের ঔরসে জন্মপরিগ্রহপূর্ব্বক রামনামে বসুধাতলে বিখ্যাত হইলেন। পরে সর্ব্বধনুৰ্দ্ধরাগ্রগণ্য রামচন্দ্র পিতার প্রিয়ানুষ্ঠান জন্য ভাৰ্য্যা ও অনুজ লক্ষ্মণ-সমভিব্যাহারে দণ্ডকারণ্যে বাস করিয়াছিলেন। তখন রাক্ষসাধিপতি মহাবলপরাক্রান্ত দুরাত্মা রাবণ সুবর্ণমৃগরূপধারী মারীচ নিশাচরদ্বারা রামকে বঞ্চনা করিয়া ছলপূর্ব্বক জনস্থান হইতে তাঁহার সহধর্ম্মিণী সীতাকে অপহরণ করে।”