১৪৭তম অধ্যায়
বংশগৌরব প্রদর্শনপূর্ব্বক ধৃতরাষ্ট্রের উক্তি
বাসুদেব কহিলেন, “হে নরনাথ! মহানুভব গান্ধারীর বাক্যাবসান হইলে নরপতি ধৃতরাষ্ট্র ভূপতিগণসমক্ষে দুৰ্য্যোধনকে কহিতে লাগিলেন, “হে পুত্র! যদি তোমার পিতৃগৌরব রক্ষা করিতে বাসনা থাকে, তবে আমি যাহা কহিতেছি, তাহা অবধানপূর্ব্বক [মনোযোগের সহিত] শ্রবণ করিয়া তদনুসারে কাৰ্য্য করিতে যত্নবান হও। প্রজাপতি সোম কুরুকুলের পূর্ব্বপুরুষ। নহুষনন্দন যযাতি সেই সোমের অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ। সেই যযাতির পঞ্চপুত্র জন্মে; তন্মধ্যে মহাতেজা যদু সর্ব্বজ্যেষ্ঠ ও পুরু সর্ব্বকনিষ্ঠ। মহাত্মা পুরু আমাদিগের কুলবৰ্দ্ধন করিয়াছেন; তিনি বৃষপৰ্ব্বার দুহিতা শৰ্মিষ্ঠার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
“ ‘সর্ব্বজ্যেষ্ঠ যদু অমিততেজঃ শুক্রের ন্যায় দেবযানীর গর্ভে সমুৎপন্ন হয়েন। ঐ মহাবলপরাক্রান্ত বীর হইতেই যাদবগণের বংশ বিস্তুত হইয়াছে। তিনি সর্ব্বাপেক্ষা সমধিক বলবান ছিলেন বলিয়া কেহই তাঁহাকে পরাজয় করিতে পারে নাই। এই নিমিত্ত তিনি দৰ্পে নিতান্ত বিমোহিত হইয়া পিতার শাসনে অনাস্থা প্রদর্শনপূর্ব্বক তাঁহাকে, ভ্রাতাদিগকে ও অন্যান্য ক্ষত্ৰিয়গণকে অবমাননা করিতে আরম্ভ করিলেন এবং পৃথিবীস্থ সমস্ত ভূপালগণকে বশীভূত করিয়া হস্তিনানগরে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। তাঁহার পিতা যযাতি পুত্রের গর্ব্বদর্শনে নিতান্ত ক্রোধাভিভূত হইয়া তাহাকে অভিশপ্ত ও রাজ্যচ্যুত করিলেন। যদুর অপর যেসকল ভ্রাতারা তাঁহার অনুবর্ত্তী ছিলেন, তাঁহারাও ক্ৰোধান্ধ মহারাজ যযাতির শাপগ্ৰস্ত হইলেন। সর্ব্বকনিষ্ঠ পুরু পিতার বশবর্ত্তী ছিলেন বলিয়া তিনি তাঁহাকে স্বীয় রাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। হে পুত্ৰ! জ্যেষ্ঠ গর্ব্বিত হইলে কদাপি রাজ্যলাভ করিতে পারে না। আর পিতার বশবর্ত্তী ও সৎস্বভাবসম্পন্ন হইলে কনিষ্ঠও রাজ্যাধিকারী হইয়া থাকে।
“ ‘আরও দেখ, আমার পিতার পিতামহ ত্ৰিলোকবিশ্রুত সর্ব্বধৰ্মজ্ঞ মহীপাল প্রতীপ। ধর্ম্মানুসারে রাজ্যশাসন করিতেন। তাঁহার দেবতুল্য তিনপুত্র জন্মে, তন্মধ্যে দেবাপি সর্ব্বজ্যেষ্ঠ, বাহ্লীক মধ্যম ও শান্তনু সর্ব্বকনিষ্ঠ। মহাত্মা শান্তনু আমার পিতামহ।
“ ‘মহাতেজাঃ দেবাপি সাতিশয় ধাৰ্মিক, সত্যবাদী, পিতৃশুশ্রুষানিরত [পিতৃসেবায় অনুরক্ত], সজ্জনসৎকৃত [সাধুজনের সম্মান], বদান্য [দাতা], সত্যপ্রতিজ্ঞ, সর্ব্বভূতহিতৈষী [সর্ব্বপ্রাণীর উপকারী], পিতার শাসনে স্থিত, ব্রাহ্মণগণের আজ্ঞানুবর্ত্তী, পুর ও জনপদবাসী আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেরই প্রিয় এবং চক্রাকার [চাকা চাকা দাগযুক্ত] কুণ্ঠরোগে দূষিত ছিলেন। দেবাপি, বাহ্লীক ও শান্তনু এই তিনজনের পরস্পর বিলক্ষণ সৌভ্রাত্ৰ [ভ্রাতৃঅনুরাগ] ছিল।
“ ‘কিয়ৎকাল পরে বৃদ্ধ রাজা প্রতীপ জ্যেষ্ঠপুত্র দেবাপির অভিষেকাৰ্থ সমুদয় মঙ্গলদ্রব্যসম্ভার [মাঙ্গলিক। বস্তুসমূহ] আহরণ করিলেন। তখন সমুদয় ব্রাহ্মণ ও বৃদ্ধগণ পৌর ও জনপদদিগকে সমভিব্যাহারে লইয়া ভূপতির সমীপে গমনপূর্ব্বক দেবাপির অভিষেক নিবারণ করিয়া কহিলেন, “রাজন্! দেবাপি সাতিশয় বদান্য, ধৰ্মজ্ঞ, সত্যপ্রতিজ্ঞ ও প্ৰজাগণের নিতান্ত প্রিয়, ইহাতে কোন সংশয় নাই; কিন্তু উনি কুণ্ঠরোগে দূষিত বলিয়া রাজ্যাধিকারী হইতে পারেন না। হে রাজন্! দেবগণ হীনাঙ্গ ব্যক্তিকে কদাপি অভিনন্দন করেন না।” মহারাজ প্রতীপ এইরূপে সেই সমাগত মহাত্মাগণকর্ত্তৃক প্রিয় পুত্রের অভিষেকে নিবারিত ও নিতান্ত ব্যথিত হইয়া অশ্রুগদগদম্বরে [দুঃখে বিগলিতাশ্রু ও গদগদকণ্ঠে] বিলাপ করিতে লাগিলেন। মহাত্মা দেবাপি রাজত্বলাভে বঞ্চিত হইয়া অরণ্যে প্রস্থান করিলেন। তাঁহার মধ্যমভ্রাতা বাহ্লীক পিতা, ভ্রাতা ও পিতৃরাজ্য প্রভৃতি পরিত্যাগপূর্ব্বক পরমসমৃদ্ধিসম্পন্ন মাতুলকুলে গমন করিয়া বাস করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দিন পরে বৃদ্ধরাজা প্ৰতীপ পরলোকযাত্ৰা করিলে লোকবিশ্রুত শান্তনু বাহ্লীকের আজ্ঞানুসারে পৈতৃক রাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া ধর্ম্মানুসারে প্রজাপালন করিতে লাগিলেন।
“ ‘হে পুত্ৰ! হীনাঙ্গ হইলে রাজ্যলাভ করিতে পারে না বলিয়া মতিমান পাণ্ডু কনিষ্ঠ হইয়াও আমার প্রাপ্য রাজ্য গ্ৰহণ করিয়াছিল। এক্ষণে তাহার অবর্ত্তমানে তাহার পুত্ৰগণই এই রাজ্যের যথার্থ অধিকারী। হে দুৰ্য্যোধন!! যখন আমি রাজ্যপ্রাপ্ত হই নাই, তখন তুমি কি বলিয়া রাজ্যগ্রহণে অভিলাষী হইয়াছ? তুমি রাজপুত্র বা রাজা নও। এক্ষণে এই রাজ্যগ্রহণে অভিলাষী হইয়া পরস্ব [পরধন] হরণে প্রবৃত্ত হইতেছ। দেখ, মহাত্মা যুধিষ্ঠির রাজপুত্র, ন্যায়ানুসারে এই রাজ্যপ্রাপ্তি তাঁহারই হইতে পারে, সেই মহানুভবই এই কৌরবকুলের প্রভু ও পালনকর্ত্তা। ঐ মহাত্মা সত্যপ্রতিজ্ঞ, অপ্ৰমত্ত [প্রমাদ-দোষহীন], বন্ধুবর্গের শাসনানুবর্ত্তী, প্ৰজাগণের প্রিয়, দয়াবান, জিতেন্দ্ৰিয় ও সাধুগণের পালনকর্ত্তা। ঐ মহাত্মাতে ক্ষমা, তিতিক্ষা [ত্যাগশক্তি], আৰ্জব [সরলতা], সত্য, শ্রুত [বেদবিদ্যা], অপ্রমাদ [ভ্রমশূন্যতা], ভুতানুকম্পা [প্রাণীগণে দয়া] ও শাসন প্রভৃতি সমুদয় রাজগুণ বর্ত্তমান আছে। তুমি নিতান্ত অভদ্র, লুব্ধ ও পাপবুদ্ধি; তাহাতে আবার রাজপুত্র নও; অতএব কিরূপে এই পরের রাজ্যহরণ করিতে সমর্থ হইবে? যদি স্বীয় অনুজগণসমভিব্যাহারে জীবিত থাকিয়া সুখে কালাতিপাত করিতে বাসনা থাকে, তাহা হইলে পাণ্ডবগণকে অচিরাৎ সবাহন [গজঅশ্বাদি বাহনের সহিত]। সপরিচ্ছদ [রাজ্যোচিত-ভূষণাদিসহ] রাজ্যাদ্ধ প্ৰদান কর।’ ”