১৪৬তম অধ্যায়
দ্রোণাচার্য্যকর্ত্তৃক দুৰ্য্যোধনকে কর্ত্তব্য উপদেশ
কৃষ্ণ কহিলেন, “হে রাজন! ভীষ্মের বাক্যাবসান হইলে আচাৰ্য্য দ্ৰোণ ভূপতিগণের মধ্যে দুৰ্য্যোধনকে কহিতে লাগিলেন, “বৎস! প্রতীপনন্দন শান্তনু ও তাঁহার পুত্র দেবব্রত ভীষ্ম যেমন কুলের হিতসাধনে যত্নবান ছিলেন, সত্যপ্রতিজ্ঞ জিতেন্দ্ৰিয় কুরুনাথ পাণ্ডুমহীপতি তদপেক্ষা ন্যূন ছিলেন না। তিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্র ও কনিষ্ঠভ্রাতা বিদুরের উপর রাজ্যভার অর্পণ করিয়া ধৃতরাষ্ট্রকে সিংহাসনে সংস্থাপনপূর্ব্বক ভাৰ্য্যাদ্ধয়সমভিব্যাহারে অরণ্যে প্রস্থান করিলেন। মহামতি বিদুর বিনীতভাবে কিঙ্করের ন্যায় চামরব্যজসদ্বারা ধৃতরাষ্ট্রের উপসানা করিতে লাগিলেন। সমুদয় প্ৰজাগণ নিরাধিপতি পাণ্ডুর ন্যায় ধৃতরাষ্ট্রকে প্ৰভু বলিয়া জ্ঞান করিতে লাগিলেন।
“ ‘হে বৎস! মহারাজ পাণ্ডু এইরূপে ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুরের প্রতি রাজ্যভার সমর্পণপূর্ব্বক সমুদয় পৃথিবী পৰ্য্যটন করিতে লাগিলেন। এ দিকে সত্যপ্রতিজ্ঞ বিদুর কোষবৰ্দ্ধন [ধন্যবৃদ্ধি], দান, ভৃত্যগণের পৰ্য্যবেক্ষণ [দেখাশুনা], ও সকলের ভরণপোষণে নিযুক্ত হইবেন। অরতিনিপাতন, ভীষ্ম সন্ধি, বিগ্রহ [যুদ্ধাদি] ও দানাদি কাৰ্য্যপৰ্য্যবেক্ষণে নিরত হইলেন এবং মহাবলপরাক্রান্ত নরপতি ধৃতরাষ্ট্র সিংহাসনস্থ হইয়া মহামতি বিদুরের পরামর্শানুসারে অন্যান্য রাজকাৰ্য্যসকল পৰ্য্যালোচনা করিতে লাগিলেন। হে বৎস! তুমি সেই সদ্বংশে সমুৎপন্ন হইয়া কি নিমিত্ত কুলভেদ [বংশের ঐক্যবন্ধননাশ] অভিলাষ করিতেছ? ভ্রাতৃগণের সহিত মিলিত হইয়া স্বচ্ছন্দে রাজ্যভোগ কর। আমি যুদ্ধভয় বা অর্থগ্রহণলালসায় [স্বার্থপরতার] এ কথা কহিতেছি না। আমি তোমার নিকট জীবিকানির্ব্বাহ করিতে বাসনা করি না; ভীষ্ম যাহা প্ৰদান করেন, তাহাই আমি ইচ্ছাপূর্ব্বক গ্রহণ করি। যেখানে ভীষ্ম, সেইখানেই দ্রোণ, ইহা নিশ্চয় জানিবে। এক্ষণে ভীষ্ম যাহা কহিলেন, তদনুসারে কাৰ্য্য কর। পাণ্ডবগণকে রাজ্যাদ্ধপ্রদানে সম্মত হও; আমি পাণ্ডবগণের ও তোমাদের উভয় পক্ষেরই আচাৰ্য্য; তোমাদের উভয় পক্ষেই আমার সমান স্নেহ আছে। আমি অশ্বথামা ও অর্জ্জুনকে তুল্য জ্ঞান করিয়া থাকি। এক্ষণে অধিক বলিবার প্রয়োজন নাই; যেখানে ধর্ম্ম, সেইখানেই জয়।’
দুৰ্য্যোধনের দৌর্জ্জন্যদলনে ভীষ্মের উত্তেজনা
“অমিততেজাঃ দ্রোণ এই কথা কহিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিতে মহামতি বিদুর ভীষ্মের দিকে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে দেবব্ৰত! পূর্ব্বে আপনি বিনষ্টপ্রায় কৌরববংশের সমুদ্ধারণ [উদ্ধার-রক্ষা] করিয়াছেন; এক্ষণে কি নিমিত্ত আমার বাক্য উপেক্ষা করিতেছেন? কুলপাংশুল [কুলকলঙ্ক—কুলাঙ্গার] দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন কে যে, আপনি উহার মতের অনুবর্ত্তী হইতেছেন? ঐ অনাৰ্য্য, অকৃতজ্ঞ, লোভাভিভূত, দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন ধর্ম্মার্থদর্শী [ধর্ম্ম ও অর্থের গৌরব রক্ষাকারী] স্বীয় পিতার শাসন অতিক্রম করিতেছে। স্পষ্টই বোধ হইতেছে, ঐ দুরাত্মার দোষে সমুদয় কৌরবগণ বিনষ্ট হইবে; অতএব যাহাতে সকলের রক্ষা হয়, এরূপ উপায় করুন। যেমন চিত্রকর আলেখ্য [পাট-ছবি] রচনা করিয়া পুনরায় অনায়াসে বিনষ্ট করে, তদ্রূপ। আপনি এই কৌরবকুল বিনাশ করিবেন না। যেমন প্রজাপতি প্ৰজাগণের সৃষ্টি করিয়া অনায়াসে তাহাদিগকে সংহার করেন, তদ্রূপ। আপনি এই কুলের সৃষ্টি করিয়া এক্ষণে সংহার করিবেন না এবং কুলক্ষয় সমুপস্থিত হইয়াছে দেখিয়া উপেক্ষা [ঔদাসীন্য] করিবেন না। বোধ হইতেছে, এই মহাবিনাশ সমুপস্থিত হওয়াতে আপনার বুদ্ধিভ্রংশ [মতিভ্ৰম] হইয়াছে। এক্ষণে প্ৰসন্ন হইয়া হয় আমাকে ও ধৃতরাষ্ট্রকে সমভিব্যাহারে লইয়া বনে গমন করুন, না হয় এই কপটাচার্য্যপরায়ণ [শঠতাপূর্ণ ব্যবহারে নিরত] দুৰ্য্যোধনকে বন্ধন করিয়া পাণ্ডবগণ-পরিরক্ষিত এই রাজ্য শাসন করুন।” মহাত্মা বিদুর এই কথা কহিয়া দীনচিত্তে বারংবার দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক নিস্তব্ধ হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন।
গান্ধারীর দুৰ্য্যোধন, তিরস্কার
“সুবলনন্দিনী গান্ধারী কুলনাশভয়ে একান্ত ভীত হইয়া ভূপতিগণের সমক্ষে পাপমতি দুরাচার দুৰ্য্যোধনকে কহিতে লাগিলেন, “হে পাপপরায়ণ দুৰ্য্যোধন! এই সভামধ্যে যেসমুদয় পার্থিব [নৃপতি], ব্রহ্মর্ষি ও অন্যান্য জনগণ প্রবিষ্ট হইয়াছেন, আমি তাঁহাদের সমক্ষে তোমার ও তোমার অমাত্যদিগের অপরাধ কহিতেছি, উহারা শ্রবণ করুন। হে পাপবুদ্ধে! কৌরবগণ পুরুষানুক্রমে কুরুরাজ্য ভোগ করিবে, এই আমাদের কুলধৰ্ম, তুমি সেই রাজ্য বিনষ্ট করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছ। হে মূঢ়! মনীষী ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁহার অনুজ দীর্ঘদর্শী [বহুজ্ঞ] বিদুর বর্ত্তমান থাকিতে তুমি কি বলিয়া তাঁহাদিগকে অতিক্রমপূর্ব্বক রাজ্য প্রার্থনা করিতেছ? দেখ, মহাত্মা ভীষ্ম বর্ত্তমান থাকিতে ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুর ইঁহারা উভয়েই পরাধীন হইবেন। এই ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মা শান্তনুনন্দন রাজ্যাভিলাষ করেন না। পূর্ব্বে ধর্ম্মাত্মা পাণ্ডু এই রাজ্য ভোগ করিয়াছিলেন, সুতরাং এই রাজ্যে পাণ্ডুতনয়গণ ও তাঁহাদের পুত্রপৌত্ৰাদিরই যথার্থ অধিকার আছে; অন্য কেহ ইহার অধিকারী নহে। এক্ষণে কুরুবংশাবতংস সত্যপ্রতিজ্ঞ ধর্ম্মাত্মা ভীষ্ম যাহা কহিলেন এবং তাহার মতানুসারে মহাত্মা ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুর যাহা আজ্ঞা করিবেন, আপনাদের [নিজ নিজ] ধর্ম্ম প্রতিপালনপূর্ব্বক তদনুসারে কার্য্য করা আমাদের অবশ্য কর্ত্তব্য। আমার মতে ধৰ্মপুত্র যুধিষ্ঠির মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্মের নির্দ্দেশানুসারে এই কৌরবরাজ্য শাসন করুন। সেই ধর্ম্মাত্মাই ইহার যথার্থ অধিকারী।’ ”