১৪২তম অধ্যায়
ভূরিশ্রবার সাত্যকি আক্রমণ-ভীষণ যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাবীর ভূরিশ্রবা যুদ্ধদুর্ম্মদ সাত্যকিকে আগমন করিতে দেখিয়া ক্রোধভরে তাঁহার সন্নিধানে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে শৈনেয়! আজ ভাগ্যক্রমে তুমি আমার নেত্রগোচর হইয়াছ। আমি এক্ষণে রণস্থলে চিরসঞ্চিত মনোরথ পূর্ণ করিব, সন্দেহ নাই। যদি তুমি সমরে পরাঙ্মুখ না হও, তাহা হইলে প্রাণসত্ত্বে কদাচ আমার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হইবে না। তুমি সতত শৌৰ্য্যাভিমান করিয়া থাক; আজ আমি তোমার প্রাণসংহার করিয়া কুরুরাজ দুৰ্য্যোধনকে আনন্দিত করিব। আজ মহাবীর কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন সমবেত হইয়া তোমাকে আমার শরানলে দগ্ধ ও ভূতলে নিপাতিত নিরীক্ষণ করিবেন। তুমি যাহার আদেশানুসারে সমরসাগরে প্রবেশ করিয়াছ, সেই ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির আজ তোমাকে আমার শরজালে বিনষ্ট শ্রবণ করিয়া অতিশয় লজ্জিত হইবেন। আজ তুমি নিহত ও রুধিরোক্ষিকলেবর হইয়া রণস্থলে শয়ন করিলে মহাবীর অর্জ্জুন আমার বিক্রমের সম্যক পরিচয় লাভ করিবেন। হে শৈনেয়! তোমার সহিত সংগ্রামে সমাগম আমার চিরপ্রার্থনীয়। পূর্ব্বে দেবাসুরযুদ্ধে দানবরাজ বলির সহিত দেবরাজ ইন্দ্রের যেমন যুদ্ধ হইয়াছিল তদ্রূপ আজ তোমার সহিত আমার ঘোরতর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইলে, তুমি আমার বল, বীৰ্য্য ও পৌরুষ সম্যক অবগত হইবে। আজ তুমি রামানুজ লক্ষ্মণের শরে নিহত রাবণাত্মজ ইন্দ্রজিতের ন্যায় শরনিকরে বিনষ্ট হইয়া যমরাজের রাজধানীতে গমন করিবে। আজ কৃষ্ণ, অর্জ্জুন ও যুধিষ্ঠির তোমার বিলাপদর্শনে উৎসাহশূন্য হইয়া নিশ্চয়ই যুদ্ধ পরিত্যাগ করিবেন। আজি আমি তোমাকে নিশিতসায়কে সংহার করিয়া তোমার শরনিহত বীরবর্গের রমণীগণকে আনন্দিত করিব। হে মাধব! তুমি সিংহের নয়নপথে নিপতিত ক্ষুদ্র মৃগের ন্যায় আমার নেত্রগোচর হইয়াছ; আর তোমার নিস্তার নাই।
“হে মহারাজ! মহাবীর সাত্যকি ভূরিশ্রবার এই সমস্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া হাস্যমুখে কহিলেন, “হে কৌরবেয়! আমি যুদ্ধে ভীত নহি। কেবল বাক্যদ্বারা আমাকে ভয় প্রদর্শন করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। হে কৌরব! যে আমাকে অস্ত্রশূন্য করিবে, সেই আমাকে সংহার করিতে পারিবে এবং যে আমাকে বিনাশ করিবে, সেই চিরকাল অপ্রতিহতগতি হইয়া অবস্থান করিতে সমর্থ হইবে। যাহা হউক, এক্ষণে বৃথা বাগ্জাল বিস্তার করিবার প্রয়োজন কি? তুমি যাহা কহিলে, তাহা কাৰ্য্যে পরিণত কর। তোমার এই আস্ফালন শরৎকালীন মেঘগর্জ্জনের ন্যায় নিতান্ত নিষ্ফল; উহা শ্রবণ করিয়া আমি হাস্যসংবরণে অসমর্থ হইতেছি। এক্ষণে আমাদিগের চিরপ্রার্থিত যুদ্ধ উপস্থিত হউক। তোমার সহিত সংগ্রাম করিবার নিমিত্ত আমার মন অতিশয় ব্যগ্র হইতেছে। রে নরাধম! আজি আমি তোমাকে বিনষ্ট না করিয়া কদাচ প্রতিনিবৃত্ত হইব না।’
“হে মহারাজ! এইরূপে সেই মহাতেজস্বী স্পৰ্দ্ধাশীল বীরদ্বয় পরস্পরের প্রতি কটুক্তিপ্রয়োগপূর্ব্বক করিণীগ্ৰহণার্থ রোষাবিষ্ট মদোৎকটী মাতঙ্গযুগলের ন্যায় ক্রুদ্ধমনে পরস্পর জিঘাংসাপরবশ হইয়া প্রহারে প্রবৃত্ত হইলেন এবং মেঘ যেমন জলধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ অনবরত শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া দশশরে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় অনবরত শরজাল বিস্তার করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর সাত্যকি শরবর্ষণপূর্ব্বক সেই সমস্ত সুতীক্ষ্ণ সায়ক উপস্থিত না হইতেই অন্তরীক্ষে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে সেই বীরদ্বয় পরস্পরের প্রতি অনবরত শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। যেমন শার্দুলদ্বয় নখদ্বারা ও কুঞ্জরদ্বয় দন্তদ্বারা পরস্পরকে প্রহার করিয়া থাকে, তদ্রূপ তাঁহারাও রথ, শক্তি ও বিশিখজালদ্বারা পরস্পরকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন তাঁহাদের কলেবর ছিন্নভিন্ন ও গাত্র হইতে অনবরত রুধিরধারা প্রবাহিত হইতে লাগিল; এইরূপে তাঁহারা পরস্পরের প্রাণসংহারে প্রবৃত্ত হইয়া পরস্পরকে স্তম্ভিত করিলেন।
সাত্যকিরক্ষাৰ্থ পার্থের প্রতি কৃষ্ণের ইঙ্গিত
“অনন্তর সেই ব্রহ্মলোকপুরস্কৃত [দেববন্দিত] বীরযুগল মৃত্যুর পর দেবলোকে গমন করিবার বাসনায় যূথপতি মাতঙ্গদ্বয়ের ন্যায় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া পরস্পরের প্রতি তর্জ্জনগর্জ্জনপূর্ব্বক প্রহৃষ্ট হইয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রগণসমক্ষে অনবরত শরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। সমরদর্শী, মনুষ্যেরা করিণীগ্ৰহণার্থ যুদ্ধে প্রবৃত্ত যুথপতি কুঞ্জরযুগলের ন্যায় তাঁহাদের সেই ঘোরতর যুদ্ধ অবলোকন করিতে লাগিল। তখন সেই মহাবীরদ্বয় পরস্পরের অশ্ব বিনষ্ট ও কার্মুকচ্ছেদন করিয়া রথ পরিত্যাগপূর্ব্বক অসিযুদ্ধ করিবার নিমিত্ত একত্র সমবেত হইলেন এবং অতি বৃহৎ বিচিত্র ঋষভচর্ম্মনির্মিত চর্ম্ম গ্রহণ ও কোষ হইতে অসি নিষ্কাশন করিয়া রণস্থলে সঞ্চরণ করিতে লাগিলেন। তৎপরে সেই বিচিত্র বর্ম্ম ও কনকাঙ্গদধারী বীরদ্বয় মণ্ডলাকারে ভ্রমণ এবং ভ্রান্ত, উদভ্রান্ত, আবিদ্ধ, আপ্লুত, প্লত, সম্পাত ও সমুদীর্ণ প্রভৃতি বিবিধ গতি প্রদর্শন করিয়া ক্রোধভরে পরস্পরকে অসিপ্রহার করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহারা পরস্পরের ছিদ্রান্বেষী হইয়া আশ্চৰ্য্য বল্গন এবং শিক্ষালাঘব ও সৌষ্ঠব প্রদর্শন করিয়া পরস্পরকে আকর্ষণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই বীরদ্বয় সেনাগণসমক্ষে পরস্পরকে কিয়ৎক্ষণ প্রহার করিয়া বিশ্রাম করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর সেই বিস্তীর্ণবক্ষা, দীর্ঘ ভুজযুগলসম্পন্ন, বাহুযুদ্ধকুশল বীরদ্বয় পরস্পরের অসি ও শতচন্দ্রক-সমলঙ্কৃত চর্ম্ম ছেদনপূর্ব্বক বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন এবং লৌহময় অর্গতুল্য বাহুযুগলদ্বারা পরস্পরের বাহুবেষ্টন করিয়া ভুবন্ধন ও ভজমোক্ষণ প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। অন্যান্য যোদ্ধারা তাঁহাদের শিক্ষাবলসন্দর্শনে পরমপরিতুষ্ট হইলেন। তখন সেই বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত বীরদ্বয় বজ্রাহত পর্ব্বতের ন্যায় ঘোরতর শব্দ করিতে আরম্ভ করিলেন। তৎপরে যেমন মাতঙ্গদ্বয় বিষাণাগ্রদ্বারা এবং ঋষভদ্বয় শৃঙ্গদ্বারা যুদ্ধ করে, তদ্রূপ তাঁহারা কখন ভুবন্ধন, কখন মস্তকাঘাত, কখন চরণাকর্ষণ, কখন তোমর, অঙ্কুশ ও চাপ নিক্ষেপ, কখন পাদবেষ্টন, কখন ভূতলে উভ্রমণ, কখন গত প্রত্যাগত ও আক্ষেপ প্রদর্শন এবং কখন বা পতন, উত্থান ও প্রদানপূর্ব্বক ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। এইরূপে তাঁহারা দ্বাত্রিংশৎক্রিয়াবিশেষসম্পন্ন যুদ্ধ প্রদর্শন করিতে আরম্ভ করিলেন।
অর্জ্জুনশরে ভূরিশ্রবার বাহুকৰ্ত্তন
“ঐ সময় মহাবীর সাত্যকির আয়ুধসমুদয় অল্পমাত্রাবশিষ্ট হইলে বাসুদেব অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! ঐ দেখ, সর্ব্বধনুর্দ্বরাগ্রগণ্য সাত্যকি রথশূন্য হইয়া সংগ্রাম করিতেছেন। সাত্যকি তোমার পশ্চাদভাগে কৌরবসৈন্যগণকে ভেদ করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক মহাবলপরাক্রান্ত যোদ্ধাদিগের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিয়াছিলেন। এক্ষণে ভূরিদক্ষিণ ভূরিশ্রবা উহাকে একান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া আগমন করিতে দেখিয়া যুদ্ধার্থ উঁহার সম্মুখীন হইয়াছেন; ইহা কিছুতেই যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বোধ হইতেছে না।’ ঐ সময় যুদ্ধদুর্ম্মদ ক্রোধাবিষ্ট ভূরিশ্রবা রথস্থ কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের সমক্ষে মত্তমাতঙ্গের ন্যায় সাত্যকিকে আঘাত করিলেন। মহাবাহু কৃষ্ণ তদ্দর্শনে অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! ঐ দেখ, বৃষ্ণিবংশাবতংস সাত্যকি অতি দুরূহ কাৰ্য্য সম্পাদনপূর্ব্বক নিতান্ত পরিশ্রান্ত ও ভূরিশ্রবার বশবর্তী হইয়া ভূতলে অবস্থান করিতেছেন। উনি তোমার শিষ্য; উঁহাকে রক্ষা করা তোমার অবশ্যকর্ত্তব্য। ঐ মহাবীর তোমার নিমিত্তই এইরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়াছেন; অতএব উনি যাহাতে ভূরিশ্রবার বশবর্তী না হয়েন, শীঘ্র তাহার চেষ্টা কর।’ তখন ধনঞ্জয় হৃষ্টচিত্তে বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! ঐ দেখ, বনমধ্যে মত্তমাতঙ্গের সহিত যূথপতি পশুরাজের যেরূপ ক্রীড়া হইয়া থাকে, তদ্রূপ বৃষ্ণিবীর সাত্যকির সহিত কুরুপুঙ্গব ভূরিশ্রবার ক্রীড়া হইতেছে।’
“হে ভরতকুলতিলক! মহাবীর ধনঞ্জয় এইরূপ কহিতেছেন, এমন সময়ে ভূরিশ্রবা আঘাতদ্বারা সাত্যকিকে ভূতলে পাতিত করিলেন। তদ্দর্শনে সৈন্যমধ্যে হাহাকার শব্দ সমুত্থিত হইল। তখন সিংহ যেমন কুঞ্জরকে আকর্ষণ করে, তদ্রূপ ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে আকর্ষণ করিতে লাগিলেন এবং তরবারি কোষমুক্ত করিয়া সাত্যকির বক্ষঃস্থলে পদাঘাত করিয়া তাঁহার কুণ্ডলালঙ্কৃত মস্তক ছেদন করিতে উদ্যত হইলেন। ঐ সময়ে মহাবীর সাত্যকি দণ্ডদ্বারাচালিত কুলালচক্রের ন্যায় কেশধারী ভূরিশ্রবার হস্তের সহিত মস্তক বিঘূর্ণন করিতে লাগিলেন। মহাত্মা বাসুদেব সাত্যকিকে তদবস্থ অবলোকন করিয়া পুনরায় অর্জ্জুনকে কহিলেন, “হে মহাবাহো! ঐ দেখ অন্ধকশ্রেষ্ঠ সাত্যকি ভূরিশ্রবার ধনুবশবর্তী হইয়াছেন। উনি তোমার শিষ্য এবং ধনুর্বিদ্যায় তোমা অপেক্ষা ন্যূন নহেন; কিন্তু আজ ভূরিশ্রবা উঁহাকে পরাভব করাতে উঁহার সত্যবিক্রম নাম ব্যর্থ হইতেছে।’ মহাবাহু অর্জ্জুন কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া মনে মনে ভূরিশ্রবাকে ভূয়সী প্রশংসাপূর্ব্বক কহিলেন, ‘কুরুকুলকীৰ্ত্তিবৰ্ধন ভূরিশ্রবা বৃষ্ণিপ্রবীর সাত্যকিকে বিনাশ না করিয়া, মৃগেন্দ্র যেমন অরণ্যমধ্যে মহাগজকে আকর্ষণ করে, তদ্রূপ যে আকর্ষণ করিতেছেন, ইহাতে আমি যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইলাম।’ মহাবীর অর্জ্জুন মনে মনে ভূরিশ্রবার এইরূপ প্রশংসা করিয়া বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে মাধব! আমি নিয়ত সিন্ধুরাজকেই নিরীক্ষণ করিতেছি, তন্নিমিত্ত ভূরিশ্রবা আমার দৃষ্টিপথে পতিত হয়েন নাই। যাহা হউক, এক্ষণে আমি সাত্যকির রক্ষাৰ্থ এই দুরূহ কাৰ্য্যসম্পাদনে প্রবৃত্ত হইলাম।’ মহাবীর অর্জ্জুন বাসুদেবকে এই কথা বলিয়া গাণ্ডীবশরাসনে নিশিত ক্ষুর সংযোজনপূর্ব্বক নিক্ষেপ করিলেন। সেই অর্জ্জুনবিসৃষ্ট দারুণ ক্ষুর আকাশচ্যুত মহোল্কার ন্যায় ভূরিশ্রবার অঙ্গদসুশোভিত খড়্গসমবেত বাহু ছেদন করিয়া ফেলিল।”